মানব-রতন। (চতুর্থ তথা অন্তিম পর্ব)। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

ধারাবাহিক গল্প।
মানব-রতন।
(চতুর্থ তথা অন্তিম পর্ব)।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

কিছুদিন পরে বাড়ি ফেরে রতন। অবসাদে,বিষাদে ম্রিয়মান।স্বপ্না প্রথম কয়েকমাস খুব সেবা করলো।তারপর পেটের টানে কাজের সন্ধানে বেরুলো।বন্ধু বান্ধবরা মিলে রতনের দোকানেই ঘুগনি-রুটির দোকান খুলে দিল।কিন্তু রতনের ঐ মনমরা ভাব স্বপ্নাকে ক্রমশ বিরক্ত করে তুলতে লাগল।সে এখন রতনের জন‍্য কোন সহানুভুতি অনুভব করে না।রতন সব সময় বিড়বিড় করে-“মহামাংস,মহামাংস
“- বলে।কত সহ‍্য করবে একটা যুবতী মেয়ে?ফলে ক্রমশ সংসারে অবাঞ্ছিত হয়ে যায় রতন,অবশেষে একদিন নিপাত্তা হয়ে যায়।

কালচক্র ঘুরে চলে।শহরের রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায় এক পাগলকে।পরনে তার শতচ্ছিন্ন নেংটি মাথা-মুখ ঢাকা অজস্র জটধরা চুল দাড়ি গোঁফে।হয়তো কেউ দয়া করে কচুরি-ডাল দিয়েছে,পাগল কিছুটা খেয়ে বাকিটা নিয়ে আসছে ফুটপাতবাসী শিশুদের জন‍্য।চোখে তার বিষাদ ও স্নেহের সহ অবস্থান।দাড়িতে লেগে শুকিয়ে থাকা ডাল,চোখে
শিশুদের জন‍্য উৎকন্ঠা!সে পথশিশুদের কাছে বসে বিড়বিড় করছে-“বেবি চিকেন,বেবি চিকেন!যাঃ যাঃ,পেইলে যা।ঐ,ঐ রাইক্কস আইতেচে,
আচড়ি মাইরবে,খেয়ি ফ‍্যালাবে।ও দিগরে যেওনি বাছা।এই খাবার এনিচি খাও।”-শিশুদের মায়েদের বলে-“মা জননীরা গা ঢেইকে রাকো।বাচাদের নুক্কে
রাকো আঁচলির তলি।রাইক্কস আইতেচে গ’।বাচা
দিগে আচড়ি মারবে,রেঁদি খাবে।সাবধানি থাকো
সবাই।খবদ্দার।”-প্রথম প্রথম ভিখারীরা ভয় পেত,
বিরক্ত হতো।ধীরে ধীরে তারাও আপন করে নিল
পাগলকে।শিশুরা মানুষ চেনে। নির্ভয়ে খেলে তারা
পাগলের সঙ্গে।শিশুর হাসি কাকলিতে ফুটপাতেও
যেন স্বর্গ নামে।সস্নেহে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে
ফুঁপিয়ে কাঁদে পাগল-“আঃহাঃগ’।”-পথশিশুদের যেন অভিভাবকসুলভ গভীর মমতায় দুহাতের ঘেরে আগলে রাখতে চায় সে।ভিখারি-সন্তানদের
সতর্ক প্রহরায় রাখে জগৎসংসারের কাছে নিত‍্য
অবাঞ্ছিত এক পাগল।

আরো কিছুদিন পর।দেখা গেল ফুটপাতের ধারে চোখ উল্টে পড়ে আছে প্রাণহীন উন্মাদের দেহ।
সাধারণ মানুষ নিস্পৃহ তাকিয়ে দেখলো।কৌতুহলী
ও কর্মহীনের দল ঘিরে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।সুস্থ ও বুদ্ধিমানেরা নাকে রুমাল দিয়ে ক্ষিপ্র
গতিতে জায়গাটা অতিক্রম করে গেল।কিন্তু কেউ তার উদ্দেশ্যে বললো না যে,-হে মানবিকতায় উত্তীর্ণ অমৃতপথের যাত্রী,আনন্দলোকে অধিষ্ঠান হোক তোমার।যেখানে নৃশংসভাবে শিশুহত‍্যা হয় না,ধর্ষিতা হয়ে খুন হতে হয় না আমাদের মা বোন কন‍্যাদের।যেখান অবাঞ্ছিত হতে হয় না তোমার মতো অমৃতের বরপুত্রদের।

কারণ,এমন সম্মানের পৃথিবীকে আমরা তো কেউ
চিনিই না।শুধু কর্পোরেশনের মুদ্দোফরাসের অপেক্ষায় পথের পাশে কাঠ হয়ে শুয়ে রইল এক
পাগল।যার একমাত্র পরিচয়——
—————–রতন মুরগিওয়াল।——–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *