জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া ©✍ সায়ন্তন ধর

জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া

©✍ সায়ন্তন ধর
(একাদশ পর্ব)

…ঠিক তখনই ঘুম ভাঙলো দরজায় টোকার শব্দে। সকাল হয়ে গেছে। দরজা খুলে দেখি মূর্তিমান ব্ল্যাকফরেস্ট কেক দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আরে একজন সুন্দরী মেয়ে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে। বলেছিলাম না ওদের পোশাকের সঙ্গে কেকের সাযুজ্যের কথা। মিষ্টি হেসে সে যুবতী আমাকে চা ও স্ন্যাক্স ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। জার্মানিতে বসে চুমুক দিলাম দার্জিলিং চায়ে। এ চা সত্যিই আমাদের ভাগ্যে জোটে না, সবই এক্সপোর্ট হয়ে যায় পাশ্চাত্যে। এরপর বিদায় জানালাম এই অতিথিপরায়ণ জার্মান পরিবারটিকে। স্মৃতিতে ভেসে উঠলো একটি দিনের ঘটনারা –

ঘন স্প্রুসের বনে
মেঘেরা দিক হারায়
আমি আপন মনে
ঘুরেছি সে সময়
পথের বাঁকে বাঁকে
দেখেছি তোমায়
সোনালী ড্যাফোডিল
দুলছিল হাওয়ায়।

নদীর ধারে গাছের নিচে
মৃদুমন্দ হাওয়ায়
একটু রোদ একটু বৃষ্টি
ঢেকে যায় কুয়াশায়
সারাদিন পরে সূর্য ডুবলে
আঁধার ঘন হয়
চাঁদের হাসি বাঁধ ভাঙতেই
মেঘেরা কালো হয়।

মেঘেরা চলে গেলে
ছায়াপথ দেখা যায়
স্প্রুস বনে বাতাসেরা
রোমাঞ্চ জাগায়
নদীটি বনপথে
কুলুকুলু গান গায়
কত ফুল কুঁড়ি হয়ে
রয়েছে ফোটার আশায়।

তারাদের সেই কসমিক আলোয়
দেখি অ্যাট আ গ্লান্স
হাজার সোনালি ড্যাফোডিলেরা
জুড়েছে সে কোন ড্যান্স
পথ হারিয়ে এমন রাতে
ঘুরছি যে একা একা
হয়তো এভাবে কোন একদিন
পেয়ে যাব তার দেখা।

মাঝে মাঝে যখন আমি
শুয়ে পড়ি তরুছায়
মনে হয় যেন আছি
খুব চেনা বিছানায়
ভেসে ওঠে ড্যাফোডিল
হৃদয়ের আয়নায়
রাখবো যত্নে সে স্মৃতি
চিরদিন মনিকোঠায়।

ফিরতে চায় না এই মন শুধু
বিদ্রোহ যে করে
মায়ায় জড়িয়েছে ব্ল্যাক-ফরেস্ট
নিয়েছে আপন করে
আমার হৃদয়ে ড্যাফোডিলেরা
হাতছানি দিয়ে যায়
শেষ হলো এক রাত্রিযাপন
পলক ফেলেছি হায়।

তবু ফিরতে হবে
ফ্রেইবার্গের রাস্তায়
বাকি পথটা শুধু
এলোমেলো হয়ে যায়
নীল কর্নফ্লাওয়ার
নতুনের ডাক দেয়
পথের ধারে চামোমাইল
পথ দেখিয়ে দেয়।

পথের ধারের সাদা চামোমাইল ( ) ফুলগুলি আমাকে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিল ফ্রেইবার্গ। বিকেল নাগাদ ফ্রেইবার্গ থেকে এবার যাত্রা মার্সিডিস বেঞ্জে। বাসের আশায় অনেক্ষণ বসে থেকেও কোন বাস ট্রিয়ের যাবে না। অগত্যা এই ব্যবস্থা। ভাড়া করলেই কি মার্সিডিস তো। যাই হোক তীব্র গতিতে পিছু সরে যাচ্ছে যাবতীয় দৃশ্যপট। অনেকটা পথ আসার পর ড্রাইভার হঠাৎ গতি কমালো গাড়ির। তারপর আস্তে থেমেই গেলো একটি প্রাচীন দুর্গের মত জায়গায়। আমাকে দেখিয়ে বলল যে এটা একটা অ্যাম্ফিথিয়েটার, যা রোমান সভ্যতার আদলে হিটলারের আমলে গড়ে তোলা হয়েছিল। পড়ন্ত আলোয় বাইরে থেকে দেখেই বিদায় জানালাম থিংস্ট্যাটে নামের অ্যাম্ফিথিয়েটারকে। এরপর হেইডেলবার্গ শহরকে বাইপাস করে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ প্রবেশ করলাম দেশের সর্বাপেক্ষা অরণ্যসঙ্কুল (৪২%) রাজ্য রাইনল্যান্ড প্যালাটিনেটে। রাত আটটায় পৌঁছলাম মোসেল্লে নদীর তীরবর্তী ট্রিয়ের শহরে। রাতটা এখানে কাটিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা ঘুরে দেখতে। মোসেল্লে চারটি দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত একটি আন্তর্জাতিক নদী। এর উপত্যকাটি অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য রচনা করেছে। এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য আঙুর ক্ষেত। দ্রাক্ষালতার আর্টিস্টিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ সকলে। শান্তিপূর্ণ বলে এখানে পর্যটকেরাও আসেন বারবার। ট্রিয়ের থেকে থেকে লাচ হ্রদে যাওয়ার সময় পথে পড়লো রাইন নদী। নদীতে ভেসে চলেছে সুদৃশ্য লঞ্চ। নদীর পাড় থেকে উঠে গেছে অনুচ্চ সবুজ পাহাড়। কোহেম শহর কে পাশে রেখে এগিয়ে চলেছি। সদৃশ্য আর্চ করা ব্রীজের নীচ দেয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের লঞ্চ। নদীর তীরে সুদৃশ্য বাড়ি। পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষাবাদ চলছে। কোথাওবা নদীর সমান্তরালে রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। সে এক ছবির মত শহর। এরপর আরও কিছুটা উত্তরে রয়েছে তিনটি অনুচ্চ পাহাড় শ্রেণী – টনাস, ওয়েস্টারওয়াল্ড ও আইফেল। আইফেল পাহাড় কোন কালে আগ্নেয় পাহাড় ছিল, যার সাক্ষ্য বহন করছে পাহাড় চূড়ার ক্যালডেরা হ্রদগুলি। সর্ববৃহৎ লাচ হ্রদের জল ছুঁয়ে চলে এলাম এক খনি অঞ্চলে যা আজ পরিত্যক্ত। আর সেই স্থান দখল করেছে পর্ণমোচী অরণ্য। এই বিপদসঙ্কুল অরণ্যের আঘ্রাণ নিয়ে চলে এলাম আরও উত্তরে তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন শহরে। বন থেকেই শুরু হয়ে যায় রূঢ় শিল্পাঞ্চল। জার্মানির সর্ববৃহৎ মেট্রোপলিটন শহর এটি। শহর থেকে দেখলাম দক্ষিণ-পূর্বে নীল রঙা সেভেন হিলস্ পাহাড়শ্রেণী। বিঠোফেনের জন্মস্থান থেকে বিদায় নিলাম তাঁর মিঠে সুর সঙ্গী করে। সেই সুরে আচ্ছন্ন হয়ে উপস্থিত হলাম রূঢ় শিল্পাঞ্চলে।

রাইন নদীর পূর্ব তীরে রূঢ় শিল্পাঞ্চল
তরঙ্গায়িত মোরেন স্তর বিছিয়ে রেখেছে আঁচল
চারনোজেম বাদামি পডসল নদীবাহিত পলি
বন করেছে নাতিশীতোষ্ণ পর্ণমোচী বলি।
শিল্পাঞ্চলের চারিধারে দূষণ রোধের জন্য
ওক, বীচ, বার্চ, এলমের সংরক্ষিত এ অরণ্য
শিল্পের জন্য কৃষিজমি সংকুচিত যথেষ্ট
মিশ্র কৃষি পদ্ধতিতে তাই ফলে গম, আলু, বীটও।
প্রধান কয়লা খনি হল ওয়েস্ট কোলিয়ার
আকরিক লোহা দেয় সুইডেন, স্পেন, ভেনিজুয়েলা।
ডর্টমুন্ড, ডুসেলডর্ফ, গেলসেনকার্সেন,
বকুম, মুলহাইম আর এসেন-
এই হল লৌহ ইস্পাত শিল্প এখানকার।
ন্যাপথা, সুগন্ধি, স্যাকারিন উপজাত কয়লার।
ক্রেফেল্ডের রেশম আর পশম আচেনে
বিশ্ব বিখ্যাত সুগন্ধি অডিকোলন কোলনের।
কার্পাস বয়নে খ্যাত মুচেনগ্ল্যাডব্যাচ
তাই বুঝি একে বলে জার্মানির ম্যাঞ্চেস্টার।
পোলার বিয়ার রেড পান্ডা গেলসেনকার্সেন চিড়িয়াখানায়
পরিত্যক্ত নর্থ্স্টার খনিও পার্ক হয়ে যায়।

তারপর কোলন তথা কোলগ্নের বিখ্যাত সুগন্ধি অডিকোলন এর সুবাস গায়ে মেখে কোলগ্নে সেন্ট্রাল স্টেশনে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ চেপে বসলাম IC2212 ট্রেনে। ট্রেন ছাড়লো। বিদায় জানালাম গোলাপি চেরী ফুলে সজ্জিত শহরটিকে। পেরিয়ে এলাম রাইন রেল ব্রীজ (Hohenzollern Bridge)। এরপর ট্রেন ছুটে চলল শিল্পাঞ্চল দিয়ে পাঁচটি স্টেশন পর মাত্র তিন ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ব্রেমেন শহরে। রাইনের তীর থেকে চলে এলাম ওয়েসারের তীরে।

(ক্রমশঃ)

©✍ সায়ন্তন ধর
০২/০৯/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *