ধারাবাহিক গল্প। মানব-রতন। (তৃতীয় পর্ব)। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

ধারাবাহিক গল্প।
মানব-রতন।
(তৃতীয় পর্ব)।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

পরদিন সকালে আবার দোকান খোলে রতন।মুরগি ওজন করে,কাটে, ব‍েচে,পয়সা গোনে। সামনে দাঁড়ানো তরুণী বধূর দিকে তেরচা চোখে তাকায়।নির্মম হাতে অর্ধমৃত মুরগির ছালচামড়া টেনে ছেঁড়ে। পেট চিরে বের করে নাড়ি-ভূঁড়ি। খইনি টেপা হলদেটে দাঁতে হেসে ইঙ্গিতপূর্ণ সুরে তরুণীকে বলে-“ডিম হইচে বৌদি,দে দোব?”-
তরুণীরও হাসিতে প্রশ্রয়,-“ভীষণ অসব‍্য হয়েচিস তুই!”–একজন ভদ্রলোক এসে বলেন–বেবি চিকেন হবে?”- রতন বলে হবে বাবু,আমার নিজির পোলটির।”–
দড়ির জালে ঢাকা ঝুড়িতে হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট ছোট্ট কতকগুলি মুরগি বের করে ওজন করে সে।তারপর নির্বিকার অথচ নিষ্ঠুর হাতে সেগুলির গলা দু আঙুলে টিপে ধরে মুচড়ে দিতে থাকে।তার হাত যন্ত্রের মতো চলে,দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে সামনে দিয়ে চলে যাওয়া শিশুদের স্কুল ভ‍্যানের দিকে।খাঁচাঘেরা ভ‍্যানের মধ‍্যে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুরা জালের ওপর চোখ রেখে দুনিয়া দেখতে দেখতে স্কুলে যাচ্ছে।হঠাৎ রতনের চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। সে যেন দেখতে পায়,তার ঝুড়ির মধ‍্যে মুরগির বদলে রয়েছে ছোট্ট ছোট্ট খোকাখুকি।চাপা একটা গোঙানির শব্দ তুলে বঁটির পাশে কাৎ হয়ে গড়িয়ে পড়ে রতন এবং চেতনা হারায়।

কিছুদিন বাড়ি বসে থাকে রতন।শান্ত,বিষণ্ন;মুরগির ব‍্যবসা তুলে দেবে স্থির করে।অবশ‍্য তার দরকার আর হলোনা।কোন এক অজানা কারণে মুরগির মড়ক লাগল।সরকার থেকে লোক এল কালিং করতে।ক্ষতিপূরণের টাকা রতনের হাতে তুলে দিয়ে শুরু হলো মুরগি নিধন পর্ব।রতনের চোখ ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চায় যেন,চিৎকার করে বলে -“অমুন করি মাত্তিচেন ক‍্যানে বাবুরা?ওদের ব‍্যাতা নাগেনা?!”-সকলে অবাক হয়ে যায়।বলে কী লোকটা?যে দুবেলা দুহাতে রক্ত মেখে মুরগি ছেঁড়ে,
তার মুখে এমন ধম্মগুরুর মতো বাক‍্যি!কিকরে
বোঝাবে রতন?জীবের মৃত‍্যুযন্ত্রণার স্পন্দন যে তার আঙুলের ডগা বেয়ে,তার সমস্ত দেহটাকে নাড়িয়ে দিয়ে তার চেতনায় চারিয়ে গেছে।

খুদে,রাজা,রহিমরা কদিন ধরেই রতনের ওই
ভাবান্তর লক্ষ‍্য করছিল।তারা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।সেখানে মনস্তত্ত্ব বিভাগের চিকিৎসক তার কাউন্সেলিং করেন।এই প্রথম রতন বলে ওঠে-
–“আমি দেকিচি।”-কী সে দেখেছে তা নানা প্রশ্নের মাধ‍্যমে এবং রতনের অসংলগ্ন উত্তরের মাধ‍্যমে বুঝে নেন তিনি।রতনের বন্ধুদের বুঝিয়ে বলেন যে,
প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ‍্যেই একটা সুপ্ত নিষ্ঠুরতা থাকে।শিশু কেন পিঁপড়ে দেখলে টিপে মারতে চায়
কেন চায় ফড়িং এর ডানা ছিঁড়ে দিতে?এই প্রবৃত্তি সভ‍্য মানুষের মধ‍্যে অবদমিত থাকে।করে রাখেন সমাজতাত্ত্বিকরা,সমাজের কল‍্যাণে।কারণ,মানুষের
মধ‍্যেই কিন্তু থাকে করুণা,দয়া,মায়া,সমবেদনার মতো মানবিক গুণ।রতনের মধ‍্যে ঐ মানবিকতাই সুপ্ত ছিল।পেটের দায়ে মুরগি বেচলেও খবরের কাগজে প্রকাশিত ঐ নারকীয় হিংস্র ঘটনা এবং তারই সামনে তথাকথিত ভদ্রলোকেদের তা নিয়ে সরস আলাপ আলোচনা রতনের মস্তিষ্কে বিরাট প্রভাব ফেলেছে।তাই ও কল্পনায় ঐ ঘটনার নানা রকম বিভৎস প্রতিবিম্ব দেখছে।ডাক্তারবাবু বল্লেন- -“এরকম দেখাকে বলে খোয়াব দেখা।ডাক্তারি ভাষায় বলে হ‍্যালিউসিনেসন।”-রতনকে কিছুদিনের জন‍্য হাসপাতালে ভর্তির ব‍্যবস্থা করেন তিনি।খুদেরা আলোচনা করে–“কী ভয়ানক অসুক বল্ এই হালুয়াচিন অসুক?চোকির তারা ডেঁইড়ে যায়?!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *