বৌদি…. ( তৃতীয় পর্ব ) ✍️ তাপস
বৌদি…. ( তৃতীয় পর্ব )
✍️ তাপস
শিবের গীত প্রায় শেষ পর্যায়ে। কারণ একটাই দিগম্বরী দেবী যে সাহসটা দেখিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর পুত্রবধুদের মধ্যে সেই তেজ দেখা যায়নি। দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদা তৎকালীন ধনী গৃহবধূদের মতই জীবন যাপন করেছেন। তবে ঠাকুরবাড়ির নিয়ম-নীতি মেনে কিছু লেখাপড়াও শিখেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হয়ে গেলও, সারদা দেবীর সেই ব্যাপারে বিশেষ আকর্ষণের কথা জানা যায়নি। বরঞ্চ স্বামীর সেবাতেই তিনি দিন যাপন করেছেন। স্বামীর মঙ্গলের জন্য ব্রহ্মপাসনা আর হিন্দু মতে নিত্য পূজা দুটোতেই তাঁর কোনো আপত্তি ছিল না। তৎকালীন ভন্ড জ্যোতিষীরা স্বামীর মঙ্গলের গল্প বলে অনেক অর্থই সারদার কাছ থেকে নিয়ে চলে যেতেন। একটি তক্তপোশের উপর বসে থাকতেন সারদা দেবী । সেখানে বসে বসেই অন্দরমহলের ঝগড়াঝাঁটি মেটাতেন। রত্নগর্ভা সারদা এখানে বসে বসেই তার জ্ঞানীগুণী ছেলেদের প্রশংসা শুনতেন, পাছে লোক গরবিনী ভাবে, এসব আলোচনায় মাথা নিচু করে মৃদুমন্দ হাসতেন।
যাক, শিবের গীত প্রচুর হল। এবার আসি বৌদি প্রসঙ্গে, অর্থাৎ জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর গল্প। এটা ঠিক গল্প নয়, রূপকথা। জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়ি ছিল নানা কুসংস্কারে ভরা এক ঘোর শাক্ত বংশ। কারো অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে, মা কালীর কাছে জোড়া পাঁঠা আর মদ মানত করা হতো। জ্ঞানদানন্দিনীর বাবা সাত বছর বয়সে মেয়েকে গৌরীদান করেন। ছোট্ট মেয়েটি প্রবেশ করল এক বিশাল দালানওয়ালা বাড়িতে। এ যেন পর্ণকুটির থেকে রাজবাড়ীতে প্রবেশ। যশোরের অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে ঠাকুরবাড়ির এই বিপুল ঐশ্বর্য আর আড়ম্বরের মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণায় বসে থাকতো। এই ভাবেই হয়তো শুয়োপোকা গুটিসুটি মেরে প্রজাপতি হয়। এই প্রজাপতি যিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি ভারতের প্রথম সিভিলিয়ান অফিসার, জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুরুটা অবশ্য ভীষণ মজার আর হাসিরও। তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর, স্বাভাবিকভাবে সত্যেন্দ্রনাথের বয়সও অল্প। সত্যেন্দ্রনাথের প্রানের বন্ধু মনোমোহন ঘোষ। সত্যেন্দ্রনাথের ভারী ইচ্ছা বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দেন জ্ঞানদানন্দিনীর। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?? জ্ঞানদানন্দিনী বাইরে যেতে পারবেন না, আর বাইরের পুরুষ অন্দরে ঢোকা বারণ,তাহলে উপায়?? পরের অংশটা জ্ঞানদানন্দিনীর মুখে শোনা যাক :-
“ওরা দুজনে পরামর্শ করে একদিন বেশি রাতে সমানতালে পা ফেলে বাড়ির ভিতরে এলেন। তারপরে উনি মনমোহনকে মশারির ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজনই মশারির মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম, আমি ঘোমটা দিয়ে একপাশে আর তিনি ভোম্বল দাসের মতো আরেক পাশে। লজ্জায় কারোর মুখেই কোন কথা নেই। আবার কিছুক্ষণ পরে তেমনি সমানতালে পা ফেলে উনি তাকে বাইরে পার করে দিয়ে এলেন। ”
অভিযান শেষ। এই যুগে এটা নিয়ে যতই আমরা হাসাহাসি করি না কেন, তখনকার দিনে এটা বিপ্লবের সমকক্ষ ছিল। সত্যেন্দ্রনাথের মত মুক্তমনা পুরুষ পাশে ছিলেন বলেই হয়তো আমরা জ্ঞানদানন্দিনীকে পেয়েছিলাম। আসলে সত্যেন্দ্রনাথ নারীমুক্তি চেয়েছিলেন, আর সেই নারীমুক্তি এসেছিল তার নিজের স্ত্রীর হাত ধরে। বিদেশে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দেখেছিলেন স্বাধীনচেতা বিদেশিনীদের। তাদের শিক্ষা মনন চারিত্রিক দৃঢ়তাতে মুগ্ধ এক মানুষ স্বপ্ন দেখছিলেন নারীমুক্তির। বিলেত থেকে সত্যেন্দ্রনাথ একের পর এক চিঠি পাঠাতে লাগলেন জ্ঞানদানন্দিনীকে। দু একটি চিঠি মোটামুটি এইরকম :-
“তোমার মনে কি লাগে না যে আমাদের স্ত্রীলোকেরা এত অল্প বয়সে বিবাহ করে, যখন বিবাহ কি তাহারা জানেই না ”
” তোমার বিবাহ তো তোমার হয় নাই, তাহাকে কন্যাদান বলে। তোমার পিতা কেবল তোমাকে দান করিয়াছেন ”
” আমরা স্বাধীনতা-পূর্বক বিবাহ করিতে পারি নাই , আমাদের পিতা-মাতারা বিবাহ দিয়াছিলেন ”
” তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক শিক্ষিত ও সকল বিষয় উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করব না ”
এসব চিঠির উত্তরে কি লিখতেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী?? ইতিহাস আশ্চর্য নীরব। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর একটি চিঠিও পাওয়া যায়নি। মাত্র তেরো বছরের একটি মেয়ের বুক হয়তো কেঁপে উঠতো ভয়ে আশঙ্কায়, আমরা জানি না তবে অনুমান করতে পারি। আরো একটি চিঠির কথা উল্লেখ করি, হয়তো এরপর থেকেই পরিবর্তন হতে থাকে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর।
” আমাদের স্ত্রীলোকদের যা-কিছু আচার, যত লজ্জা, যত ভীরুতা তুমি যেন তার মূর্তিমতী ছিলে। এখনো কি তোমার সবই সেইরূপ ভাব আছে?? ”
ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে থাকলেন জ্ঞানদানন্দিনী। পড়াশোনা শুরু হল দেবর হেমেন্দ্রনাথের কাছে। পড়া হয়ে গেল মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য পর্যন্ত।
ইতিমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ এক কালজয়ী কাজ করে বসলেন। তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের নবীন আচার্য অযোধ্যানাথ পড়শীকে গৃহশিক্ষক নিয়োগ করলেন। সেই প্রথম একজন অনাত্মীয় পুরুষ ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন।
( চলবে )
✍️ তাপস