আনন্দ / বাণী চন্দ দেব
আনন্দ / বাণী চন্দ দেব
————————————
তিতলি সেই কোন সকালে উঠে গরমজলে স্নান সেরে নিল। মা ওর জন্য কাঁচা হলুদ বেটে রেখেছিল, স্নানের আগে তাও নিয়ম করে মেখে নিয়েছে। দিদি ওকে মা’র মেরুন জর্জেট শাড়িটা দুভাঁজ করে পরিয়ে দিয়েছে। সুতির দড়ি বাঁধা ফুল প্যান্টের ওপর। গেন্জী কাপড়ের ছোট টপটাই ওর ব্লাউজ। এবার বেশ করে সেজে স্কুলের দিকে রওনা হলো। তখন সবে ফল কাটা হচ্ছে। বন্ধুরা সবাই এসে গেছে। অনুরূপা, শর্বরী, তিতাস, সোমা, কুলসুম, হিরু, তপন। অঞ্জলি শেষ হতে প্রসাদ খেয়ে ওরা গিয়ে ভোগের জন্য লাইন দিল মাঠে। মাঠের একধারে মরশুমি ফুলের বাগান। চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, ডালিয়া, জিনিয়া, ইনকা, গোলাপ তাদের রং রূপের বাহার মেলে বাগান আলো করে আছে। খিচুড়ি, বাঁধাকপির ঘণ্ট, টমেটোর চাটনি আর শেষপাতে বোঁদে। গরম রস ছড়ানো বোঁদে স্যাররা যখন পিতলের বালতি থেকে গোল হাতা দিয়ে ঢেলে দিতেন আহা! তার স্বাদই আলাদা। ” আরেট্টু চাই” বলে তারা বায়না জুড়ে দিত।
রাকার জন্য বাসন্তী শাড়ি আর ওর মাপের ব্লাউজ সায়া বের করতে গিয়ে তিতলির স্মৃতিতে ছেলেবেলার সরস্বতীপূজা হুরমুড়িয়ে নেমে এলো।
– উ হু হু কি শীত! মা শাড়িটা পরিয়ে দাও। রাকার কথায় সে বর্তমানে ফিরে এলো। শাড়ি ব্লাউজ পরিয়ে রাকাকে সুন্দর করে সাজিয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বললো হেঁটে দেখতো কমফর্ট ফিল করছিস কিনা। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে নিল শিব গাড়ি বের করেছে গ্যারাজ থেকে। মেয়েকে তার বাবার জিম্মায় পৌছে দিতে শিব স্টিয়ারিং এ হাত দিয়ে বললে- রাকা মা কতো বড়ো হয়ে গেছে, শাড়ি পরে মায়ের মতো দেখাচ্ছে তোমায়।
রাকা খুব খুশি, বড়ো বললে তার আনন্দ আর ধরেনা।
মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে এবার সে ঘরের কাজে মন দিলো। তার স্নান এখনো বাকি। শাওয়ার ছেড়ে দিতে কুসুম গরম জলের ধারা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। বেশ আরাম বোধ হলো। আবার সে ফিরে গেলো পুরনো দিনে। ভোগ খাওয়া হলে সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বের হতো। জেলখানার উল্টো দিকের মাঠ, কলেজ, বয়েজ স্কুল, বাড়ি ফেরার পথে কোনটাই বাদ দিতনা তারা। ঠাকুর দেখতে দেখতে যে যার বাড়ি ঢুকে পড়েছে। বাকি আছে তিতলি আর পিকু। পিকু আবার ছোট্ট ধুতি পাঞ্জাবী পরে বেশ একটু বড় বড় ভাব দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বয়েজ স্কুলের গেট দিয়ে তারা বেশ খোশ গল্প করতে করতে ঢুকছিল। উ্ঁচু ক্লাসের দাদারা ঐ পুঁচকে শাড়ি আর ধুতি পাঞ্জাবি দেখে বেশ মজা পেলো, সঙ্গে সঙ্গে মাথায় তাদের দুষ্টু বুদ্ধি ও খেলে গেলো। তারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো – -ও দিদি ও জামাইবাবু।
তিতলি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো চেনা কেউ শুনে ফেললো কিনা?
পিকু তো বেজায় রেগে গেলো – -এ্যাই আমি জামাইবাবু না।
দাদারা আরও উৎসাহিত হয়ে বললো – তুই জামাইবাবু নাতো ধুতি পরেছিস কেন?
ওরা জোড়ে হাততালি দিয়ে বলে উঠলো – জামাইবাবু জামাইবাবু।
না: আর তো সহ্য হয়না। পিকু তার ছোট্ট মুঠি তুলে চেঁচিয়ে ওঠে – এই মারবো কিন্তু।
– এমা জামাইবাবু রেগে গেছে।
পিকু এবার মাঠ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ওদের দিকে তাক করে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো। তিতলি কি করবে বুঝতে না পেরে ভ্যা করে কেঁদে একসা। হেডস্যার কি কাজে যেন এদিকেই আসছিলেন। ওদের কাণ্ড দেখে থমকালেন। বাজখাঁই গলায় বললেন- কি হচ্ছে রে, যা ওদিকে খাবার লাইনে দাঁড়া গে যা। নইলে সবকটাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবো সারাদিন।
ব্যস ওষুধে কাজ দিলো। নিমেষে সব ছেলেপিলে উধাও। এতদিন পরে সেসব কথা মনে পড়তে তিতলি একাই হেসে উঠলো। না: আর দেরী করা যাবেনা। কমপ্লেক্সের সরস্বতী পূজার আয়োজনে এখুনি প্যান্ডালে নামতে হবে। কাল অনেক রাত অব্দি আল্পনা, বেদী সাজানো হয়েছে। সকাল সকাল পূজো শেষ হলে বেশ আড্ডা দেওয়া যায় একসাথে সবাই মিলে। দুপুরে জোড় ভুরিভোজের ব্যবস্থা আছে। তিতলি হলুদ কাঞ্জিভরমটা পাটপাট করে পরে যত্ন করে সেজে আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবলো, পূজো তখনও ছিলো, এখনো আছে। কেবল একটু রূপান্তর ঘটেছে। পাড়া কালচার বদলে তা কমপ্লেক্স কালচারে পৌঁছেছে। আগে যা ছিল আড়ম্বরহীন এখন তা অনেক জাঁকজমকে পরিণত হয়েছে। উদ্দেশ্য তো একটাই আনন্দ। সেই আনন্দে যোগ দিতে তিতলি ফুরফুরে মেজাজে প্যান্ডেলে এসে ঢুকলো।