ঐতিহ্যময় পানিহাটি (পর্ব ২ ) কোয়েলী ঘোষ

ঐতিহ্যময় পানিহাটি (পর্ব ২ )
কোয়েলী ঘোষ

” পানিহাটি সম গ্রাম নাহি গঙ্গাতীরে
বড় বড় সমাজ সব পতাকা মন্দিরে ।”

বৈষ্ণবদের পবিত্র ও জনপ্রিয় তীর্থক্ষেত্র সোদপুর পানিহাটি । গঙ্গাতীরে ফেরিঘাট থেকে নেমে হাঁটাপথে চলেছি রাঘব পণ্ডিতের বাড়ি বা পাট বাড়ি ।
সামনেই সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির ।মন্দির তখন বন্ধ । আমরা বাঁদিকের রাস্তা ধরে একটু এগোতেই পথের নির্দেশ পেলাম ।
ডানদিকে কয়েকটি বাড়ি পেরিয়ে বড় গেট ।গেট পেরিয়ে সামনে মন্দির ।ডানদিকে মাধবী বিতান বা মাধবী কুঞ্জ ।এখানেই ছিল রাঘব পণ্ডিতের টোল । এক মাধবী লতা গাছ দীর্ঘ কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে । ডালপালা মেলে দিয়েছে চারিদিকে ।
ভেতরে প্রবেশ করে রাঘব পণ্ডিতের সমাধি স্থল দেখলাম । বাঁধানো চাতালের থামে শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা আছে ইতিহাস ।


শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ৯২১ বঙ্গাব্দের ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দের আশ্বিন কৃষ্ণা দ্বাদশী তিথিতে এই গৃহে পদার্পণ করেন । ১৫১৫ খ্রিস্ট।ব্দে তিনি দ্বিতীয় বার আসেন ।
মহাপ্রভু নিত্যানন্দ কে বললেন হরিনাম সংকীর্তন করতে । গঙ্গার তীরে তিনি নাম বিলিয়ে গেছেন ।
নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ১২৩ বঙ্গাব্দে এই গৃহে তিনমাস বাস করে গেছেন । তখন থেকেই শুরু হয়েছিল গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের যাত্রা , নিত্যানন্দ লীলা ।
তিনমাস এখানেই চলেছিল সেই ভক্তি বিলাস ।
একে একে লেখা পড়ছি আর ভাবছি কি ঐতিহ্যময় এই রাঘব ভবন ! প্রতি ধূলিকণায় ছড়িয়ে আছে মহাত্মা মহাপুরুষদের পদধূলি ।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব শিষ্যদের নিয়ে বহুবার এসেছেন এই গৃহে । রাধারমন চরণদাস দেব এই বাড়িতে নামসংকীর্তন করে গেছেন ।
শ্রীপাদ রামদাস বাবাজি এই গৃহ থেকেই বৈষ্ণব সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা জনসমক্ষে তুলে ধরেন ।
মাধবী কুঞ্জের ফাঁক দিয়ে বিকেলের নম্র আলো এসে পড়েছে । এই পবিত্র মাটিতে মাথা ঠেকাই । ধন্য পানিহাটি । ধন্য এই গ্রাম ।
সামনে মন্দির তখনও খোলে নি । ডানদিকের ঘরে প্রবেশ করি । সামনে রাঘব পণ্ডিতের এক মূর্তি , শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন । আর কাঁচের শোকেসে সাজানো আছে রাঘবের ঝালি ।
কি এই রাঘবের ঝালি ?
এখানেই বাস করতেন রাঘব পণ্ডিতের বাল্য বিধবা ভগিনী দময়ন্তী দেবী । তিনি সন্তান স্নেহে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্য রান্না করতেন এবং খাওয়াতেন । সেই অতি সুস্বাদু রান্না খেতে মহাপ্রভু খুব ভালোবাসতেন ।
মহাপ্রভু নীলাচল যাওয়ার পরে তিনি প্রতিবছর রথের সময় ঝোলায় ভরে প্রভুর প্রিয় খাদ্যদ্রব্য শ্রীক্ষেত্র পাঠানো হতো। এর নাম “রাঘবের ঝালি”।
সেই ঝালিতে থাকতো খইয়ের মোয়া, শালিকা ধানের খৈয়ের নাড়ু, চিড়ার নাড়ু, বাদামের নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু, ধানিয়া মুহুরী ধানের নাড়ু, শুটিখন্ডের নাড়ু, পেস্টের নাড়ু, আতপচালের মুড়ির মোয়া, আম কাসুন্দি, লেবু, তেঁতুল, আমসি, তেঁতুলের আচার, হরতকি, তিলের নাড়ু, আমসত্ব, আমলকি, কর্পূর মরিচ, লবঙ্গ, এলাচ, আদা কাসুন্দি, লেবু কাসুন্দি, ঝাল কাসুন্দি, ইত্যাদি।
এখনও সেই রীতি মেনে প্রতিবছর রথযাত্রার সময় পানিহাটি থেকে “রাঘবের ঝালি” যায় পুরীতে ।

বাইরে নাট মন্দিরে বেরিয়ে এলাম । লেখা আছে মহাপ্রভুর বাণী —
” শুন শুন ভক্তগণ শুন মোর কথা
রাঘবের ঘরে আমি থাকিব সর্বদা
চার জায়গায় তিনি থাকবেন সূক্ষ্মভাবে বলে গেছেন । শ্রী শচীর রন্ধনে , শ্রীবাস অঙ্গণে , শ্রী নিত্যানন্দ নর্তনে , শ্রী রাঘব ভবনে । ভক্তের বিশ্বাসে তিনি আছেন ।
দেখা হয়ে গেল এক ভক্ত জয়দেব ভাইয়ের সাথে । তাঁর কাছে শোনা হলো কত মন্দিরের অলৌকিক কাহিনী । ভক্ত ও ভগবান মাহাত্ম্য ।
মন্দিরের দরজা খুলে গেল । অপরূপ সুন্দর সাজে রাধা কৃষ্ণ আর মদনমোহন সুসজ্জিত ।
নয়ন না ফেরে না । আরতির আলোয় উদ্ভাসিত হলো মন্দির । এই পূণ্য তীর্থে শত কোটি প্রণাম জানিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম পথে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *