মানব-রতন। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, (দিল্লীতে ঘটে যাওয়া একটা ভয়ংকর সত‍্য ঘটনা অবলম্বনে

ধারাবাহিক-গল্প।

মানব-রতন।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
(২০১৩ সালে লেখা।দিল্লীতে ঘটে যাওয়া একটা ভয়ংকর সত‍্য ঘটনা অবলম্বনে)

কাঠের চুল্লিটা গনগন করছে। আগুনের লাল আভায় ভৌতিক আবহের সৃষ্টি হয়েছে যেন।চুল্লির ওপরে বসানো প্রকাণ্ড কালো ডেকচিটায় টগবগ করে ফুটছে ঝোল জাতীয় কোন বস্তু।তার মধ‍্যে মশলা ধরণের কিছু ঢালছে একটা মুশকো মতো লোক।তার বিরলকেশ মুণ্ডুটির ওপর সিলিং থেকে ঝোলানো বাল্ব এর ম্লান আলো মিটমিট করছে,মাথার চুলের অভাব পুষিয়ে দিয়েছে মুখের অজস্র অবিন‍্যস্ত গোঁফদাড়ি।পুরু ঠোঁট দুটির ওপর ঝুলে পড়া ঝাঁকড়া গোঁফের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড়ো বড়ো দাঁত। আর একজন স্বাস্থ্যবান লোক হাতে বোতল নিয়ে মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে আছে।সে হঠাৎ হেঁকে ওঠে-“এই-ই সাল্লা মাহিন্দার,মশল্লা পকা নহি ক‍্যায়া? আরে মাঁস তো ডাল উসমে।”-।মাহিন্দার বলে-“জী উস্তাদ,থরি দের মে বন্ জাবেগা।”- সে এগিয়ে যায় ঘরের এক কোনে পড়ে থাকা একটি বস্তুর দিকে।

একজোড়া বিস্মিত,আতঙ্কে বিস্ফারিত অদৃশ‍্য চক্ষু তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।ঝাপসা কোনে পড়ে থাকা বস্তুটিকে মনে হলো যেন কোনো যুবতীদেহের খণ্ডাংশ।কারণ,অদৃশ‍্য চক্ষু দেখল যে,মাহিন্দার একটি ঝকঝকে ছুরি দিয়ে ঐ দেহটি থেকে চেঁছে তুলে নিল শিশুর মাতৃ-স্নেহ-সুধা ধারার অমৃত ভাণ্ডার দুটি।অভ‍্যস্ত হাতে ড্রেসিং করে ফেলে দিল ডেকচির ফুটন্ত তরলে।দ্বিতীয় লোকটি আবার কোথা থেকে বার করে আনল দুটি শিশু শবদেহ।একই প্রক্রিয়ায় সেগুলিও ডেকচিতে।যুবতীর উদরটি ছুরির একটানে চিরে বার করলো একটা ভ্রুণ।-“মাহিন্দার, ইয়ে আন্ডা ভি ডাল দে উসমে।মির্চা,গোলকি অর লং জাদা ডালনা।”-রান্না চড়িয়ে প্রভু-ভৃত‍্য আবার বসল মদের বোতল নিয়ে।
কী স্বাভাবিক ওদের আচরণ!কোন
পাশবিক ভাব?নেই।রান্নাবান্না করছে যেন কোন হোটেলের সেফ্! অদৃশ‍্য চক্ষুর দৃষ্টি নিষ্পলক হয়ে রইল।

–“কী হলো,ভাতি হাত দে অমুন চোক্ কপালি তুলি বসি আচো ক‍্যান্?খাও।”–স্বপ্নার কথার কোন জবাব দেয় না রতন।তার চোখের শুন‍্যদৃষ্টি তখনো প্রত‍্যক্ষ করছে সেই মহানারকীয় দৃশ‍্যটা। স্বপ্না স্বামীর গায়ে হাত রাখে–“কী হলো গা?শরীল খারাপ নাগতিচে?চোকির তারা অমন থির ক‍্যানে গা”–সংবিত ফেরে রতনের।–“না,কিচু না। এই তো খেতিচি।এডা কী দেচ বাটিতি?-” -“খাসির মাংস”–
মিষ্টা মুখভঙ্গী করে স্বপ্না,যে ভঙ্গীটা রতনের কাছে পরম উপভোগ‍্য।–“মুরগী খেয়ি খেয়ি তো তুমার মুক্ পচি গ‍্যাচে,তাই রমজান ভেয়ের দুকান ঠেঙে
পাঁসসো গেরাম রেয়াজি খাসি নে এইচি।দ‍্যাকো দিনি কেমুন হইচে। ঝাল,মরিচ এট্টু বেশীই দেচি।”-
হঠাৎ বাটিটা তুলে দেয়ালে ছুঁড়ে মারে রতন।তাদের বিয়ের সময়ে দেয়ালে আঁকা বসুধারার ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে লাল-হলুদ মাংসের ঝোল।হতভম্ব স্বপ্না কেঁদে ফেলে।-“দেসসো ট‍্যাকা দে মাংস নে এনু তুমি ফেলি দেলে।”-ভাত ফেলে উঠে যায় রতন।চৌকিতে বসে বিড়ি ধরায়।স্বপ্না মেঝে থেকে মাংসের টুকরোগুলো তোলে,ঝোলটুকুও চেঁছে তুলে নেয় বাটিতে।তারপর রতনের পাশে এসে বসে
।-“কী হইচে বলো দিনি।হটাৎ মাতাগরম!কেউ কিচু
কয়েচে?”-স্বপ্নাকে ঠেলে সরিয়ে শুয়ে পড়ে রতন।কী বলবে সে?ঐ নৃশংস,হিংস্র জিঘাংসা ভরা দৃশ‍্য কেন তাকেই দেখতে হলো?রতন তো এমন কিছু কোমলহৃদয়,সংবেদনশীল মানুষ বলে নিজেকেই চেনে না।বরং সে নিজেই তো একজন কসাই,– মুরগীওয়ালা।
(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *