চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন লেখিকা- বাবিয়া নন্দী

উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন
লেখিকা- বাবিয়া নন্দী
ধারাবাহিক
একাদশ পর্ব (১১)

বাহাদূর সিং এর হাঁক পাওয়ার পরও সত্য ও উমা তাঁদের কিছু প্রয়োজনীয় বাক্য বিনিময়ে রত থাকাকালীন খিড়কির বাইরে একটি ছায়ামূর্তির আবির্ভাব পরিলক্ষিত করে দুজনেই সতর্কতা অবলম্বন করে,উমা একটু অস্ফুটে গোঙ্গানির মতোন শব্দ বাহির করে আর সত্য অভদ্র পুরুষের মতোন কিছু অশ্রাব্য চাটুবাক্য প্রয়োগ করে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে “পিয়ারী বাঈ ” গুরাকুল যোগে কেদারায় বসে হেলান দিয়ে দন্ত মার্জন করছে আর মধ্য মধ্যে থু থু করে ফেলছে।সত্য নিশ্চিত হয়,যে ছায়া মূর্তিটি কোনো মানবের ছিলো না।ছিলো মানবীর।অর্থাৎ এই লাজলজ্জাহীনা,কঠোর হৃদয়ের,শুধু অর্থলোলুপা নারী।যার নিজের জীবন দুঃখে কষ্টে জর্জরিত হওয়ার কারণবশতঃ সে অন্য মেয়েদেরও জীবনকে তারই ন্যায় দূর্বিসহ করে তুলতে পিছু হটে না।আর তার নিকট জীবনের মুল্যবোধ মানে শুধুই অর্থ।অর্থের জন্য সে যে কোনো গর্হিত কাজ অনায়াসে বিবেক বুদ্ধির ধার না ধেড়েই করে দিতে প্রস্তুত থাকে।”পিয়ারী বাঈ” সকালের শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়ে তাঁর নিজভাষায় সত্য কে বললে,”ক্যায়া সাব!রাত কো মাজা আয়া ক্যায়া!কাহা থা না মাল একদামসে ঝাক্কাস হ্যায়।তো ওহ নওয়াবজাদী কুছ যাদা হিচখিচ তো নাহি কিয়ি সাব।কারে তো হামকো বলিয়ে।মার মার কে উসকা হাড্ডি এক কার দুঙ্গি হাঁ।ইয়ে পিয়ারী বাঈ কা ওয়াদা হ্যায়।”সত্যর তো মনে হচ্ছিল সেই মুহুর্তে ই “পিয়ারী বাঈ” এর গলার নোলি কেটে ঝুলিয়ে দিতে ঠিক পূর্ব দিনের মতোনই।কিন্তু সে নিজের ক্রোধ কে যতোদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে এনে মুখে একটু ক্রুর হাসি হেসে বললো,”হাঁ পিয়ারী বাঈ আপনে তো মেরা দিল খুশ কার দিয়া।পার ওহ ক্যায়া হেনা কে এক রাত মেঁ জারা দিল নাহি ভারা।তো ক্যায়া আজভি ম্যাহেফিল মেঁ সামিল রাহুঙ্গা তো আপকো কুছ লুকসান তো নাহি পৌঁয়ছে গা?” “পিয়ারী বাঈ” কিছুক্ষণের জন্য ভেবে চিনতে বললেন,”তো সাভ!হামকো তো মেঁ মাতলাব কে ইস পিয়ারী বাঈ নে হার লড়কি হি দিখা দিয়ি,জারা খুদ হি ইয়াদ কারকে বাতাইয়ে আজ কিসকি ঘারকা মেহেবান বানকে আয়েঙ্গি আপ?”
সত্য অপেক্ষাকৃত গলা নীচু করে “পিয়ারী বাঈ ” এর চোখের সামনে আরও কিছু মোটা অঙ্কের নোট নামিয়ে বললো,দেখিয়ে বাঈ,হামকো তো সাভ লড়কি হি পাসান্দ হ্যায়,লেকিন ওহ ক্যায়া হ্যা না কে ইস রোশনী বাঈ কো বাস মেঁ আননা বহত তাকাতওয়ার কা কাম হ্যায়।শালী নে বহুত জিদ্দি হ্যায়।অওর হামে,জো লড়কি কুছ যাদা শোর মাচায়ে ওওর জাদা সোয়াতি সাবিত্রী বাননে কি কোসিস কারহে,উসসে খেলনে কি আন্দাজাই কুছ অউর হ্যায়।”
পিয়ারী বাঈ ঘার নেড়ে এতোগুলো নোট পেয়ে খুশীর সাথে বলে উঠলো,”কাহা থা না সাভ,ইস লরকি কো জিসনে একবার ছুঁতে হ্যায় না ওহ সিরফ ইসি কোহী চাহতে হ্যায়।অওর আপ ইতনা নেক বান্দা হ্যায় কে হামারা দিল হি জিত লিয়ে।চালিয়ে কই বাত নহি আজকি ম্যাহেফিল মেঁ আব জারুর সামিল হো না।অউর লড়কি ভি ওহ এক হি রাহেগী।রোশনী বাঈ।”
সত্য বুঝতে পারলো তার ঔষধে কাজ হয়েছে।আজকের রাত টাও অন্তত পক্ষে সে উমার সাথে কাটাতে পারবে।উমার অতীতের ঘটনা জানতে পারবে আর এছাড়াও অন্যান্য রাক্ষস ও পিশাচের হাত থেকে সে পবিত্র উমা কে রক্ষা করতে পারবে বলেই নিশ্চিত হয়ে নিজের ডেরায় ফিরলো।এদিকে ডেরায় ফিরে দেখে রন্জ্ঞন বোস তাঁর অতি প্রিয় বন্ধু ততোক্ষণে নীতেশের স্ত্রী রমা বৌদির হাতের নিমকি ও সিঙ্গারা সহযোগে প্রাতঃরাশ সারছে।
সত্য কে দেখে বললো,”কি রে সতু,তোর তো এখানে আসা অবধি কোনো টিকিই পাচ্ছি না রে।কি খবর ভাই,কোথায় এত্তো পরিমরি করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। তাও যদি জানতুম এ শহর তোর চেনাশোনা তাও নয় কথা ছিলো।

সত্যব্রত রন্জ্ঞন এর দুটি হাত ধরে ব্যাকুল স্বরে তাঁর বাল্যবন্ধু টি কে করুন চাহনি ও অধোমুখে বললো,ওরে রঞ্জু আমায় একটু সাহায্য করতে পারিস।বল কথা দে,পারবি কি না।সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমরা একসাথে সব কাজ করেছি।আমি তোর পাশে দাঁড়িয়েছি।প্রয়োজনে তুই আমার পাশে।তবে কি জানিস ভাই,আমার কখনও কিছু প্রয়োজন হয় নি আলাদা করে তোর নিকট কোনো উপকার চাওয়ার।কিন্তু আজ সেই সময় উপস্থিত। তুই কি পারবি তোর নিজের মেরুদণ্ড টা কে একটু সোজা করে তোর এই বাল্য বন্ধুর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার।
রন্জ্ঞন তো হাঁ।সে তো কিছুই বুঝতে পারে না সত্য কি প্রলাপ করে চলেছে।সে শুধু সত্যের কথার বিনিময়ে বললো,”আরে কি হয়েছে,সে টুকু তো বলবি,না জেনেশুনে কি করে বলবো আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি নে।”সত্য বললো কেন?”আমার উপর তোর ভরসা নেই?বিশ্বাস নেই তোর এই বাল্যসখার উপর?তাহলে এতো প্রশ্ন করছিস যে বড়।
রন্জ্ঞন তার ক্রোধ এর কারণ না বুঝেই বললো,”দ্যাখ সতু আমি কিন্তু একটি বারের জন্যও বলিনি,যে তোর কোনো সাহায্য করবো না।শুধু বিষয় টা সম্পর্কে অবগত হোতে চেয়েছি।তুই তো জানিস ভাই ছোট্ট বেলা থেকেই আমি একটু ভীতু ও দূর্বল প্রকৃতির মানুষ বটি।”তাই আসল কারণ না জানতে পারলে,কাজ টা করবো কেমনে?
সত্য বললো,” আমায় একটু সময় দে।কয়েক টা মিনিট মুখ হাত ধুয়ে কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম করে নি।এখনো ঢের সময় আছে।তোকে সব কথা আজই বলবো।আর সমস্ত টা বুঝিয়েও দেবো।তুই শুধু যেমন যেমন নির্দেশ দেবো সেটুকুই করবি।পুরো টা শুনলে তোর ও কাজ টা আপনা থেকে করতেই ইচ্ছে করবে।তার জন্য আমার জোরাজুরির প্রয়োজন হবে না।
রন্জ্ঞন বোস তো বেচারা বরাবরেরই একটু ভীতু প্রকৃতির মানুষ।চোখের সামনে অন্যায় দেখলে সত্য যে ভাবে বুক চিতিয়ে প্রকৃত পুরুষের ন্যায় প্রতিবাদ করতে পারে সে তা পারে না।এই তো গেলো বারে তাঁর প্রেয়সী পাশের গ্রামেরই মেয়ে,তাঁকে যে রন্জ্ঞন এর ভালো লাগে।সে যে তার প্রতি প্রণয়াসক্ত,কিন্তু কিছুতেই পেটের কথা মুখে আনতে পারে না।শ্রেয়সী সামনে এলেই রন্জ্ঞন এর বুকের ভেতর টা তোলপাড় করে,অথচ কথা বলতে গেলেই তোতলামি শুরু হয়ে যায়। সেখানে সত্যব্রতই তাঁর একমাত্র ভরসা ও বিশ্বাসের বন্ধু। সত্যই শ্রেয়সী কে রন্জ্ঞন এর ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।একটা সময়ে ওদের সম্পর্কের সমীকরণ টা আস্তে আস্তে ধীরগতিতে অনেক টা সহজ ও সাবলীল হয়ে ওঠে।শুধু তাই ই নয়,ছোটো বেলা থেকেই রন্জ্ঞন সত্য ছাড়া কিছুই করতে পারতো না।তাঁর জীবনে সত্যর অবদান যে কতোটা সে মর্মে মর্মে তা উপলব্ধি করে চলে প্রতিনিয়ত।গুরুর প্রতি গুরুদক্ষিণা দেওয়া যায়।কিন্তু বন্ধুর উপকারের বদলে উপকার করাটাই যে ধর্ম তা রন্জ্ঞন এর উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না।
তাই সে ভাবে,এবার এসেছে বন্ধুর ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার পালা।সে জানে সত্যের ঋণ সে কখনই শোধ করতে পারবে না।তবু যদি প্রতিদানে কিছু উপকারে সে বন্ধুর আসতে পারে তাহলে মন্দ কি?
তাই সে নীরবে বন্ধুর নিদ্রাভঙ্গের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

ক্রমশ (চলবে)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *