চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী
উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন
লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী
ধারাবাহিক
দশম পর্ব (১০)
সত্য উমার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছে এই কথা টা শোনামাত্র উমার চোখ থেকে প্লাবনধারা নামলো।সত্য তাঁকে নিরস্ত করার জন্য তাঁর মাথায় অতি স্নেহ পরবশ অঙ্গুলি ছুঁয়ে দিলো।কিন্তু উমার অশ্রুপাত যে আর কোনো বন্ধন মানবে না।বহুদিনের জমাট বাঁধা মনোকষ্টের উপর যখন আকস্মিক ভাবে কোনো স্নেহের প্রলেপ পড়ে,তখন তা বাঁধ ভাঙ্গা জলোচ্ছাসের ন্যায় বেরিয়ে আসতে চায়।তাকে যে আটকানো নিরর্থক তা বুঝতে পেরে সত্যব্রত খানিক মৌন হয়ে রইলো।পরে নিজহস্তে সে মুছিয়ে দিলো উমার চোখের জল।উমা বললো,”বাবু আপনি আমাকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি কোনো বিপদে পড়েন,সে দায়ভার বয়া আমার পক্ষে অতি দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে।বার বার মনে হবে এর জন্য কোথায় যেন আমিই দায়ী।আমি সারাজীবন এই নরকের নোংরা পাঁকে নিজেকে নিমজ্জিত রাখতে রাজী আছি,তবুও আমার জন্য আপনার কোনো বিপদ ঘটুক,তা যে এই উমার সহ্যের বাইরে।উমা তা সইতে পারবে না।”
সত্য উমার কথার প্রতুত্তরে বললো,”উমা তোমায় তো আগেই বলেছি তোমার জন্য না,এ লড়াই ধরে নাও আমার জন্যই আমি করছি।তাতে তোমার চেয়েও যে আমার সুখ ও প্রাপ্তি অনেকখানি।তা তোমাকে আমি কি করে বোঝাই!তবে আমি যে গতিতে তোমায় চলতে বলবো,তুমি তার অন্যথা করবে না,কথা দাও আমায়।তুমি পূর্বের মতোনই মনমরা হয়ে থাকার অভিনয় করবে।এই মহল্যার কাউকে কোনো কিছু বুঝতে দেবে না যে তোমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে।তা হলেই বিপদ রাখার জায়গা থাকবে না।”
বলা বাহুল্য,সেই রাত্রিতে তারা অযথা চেঁচামিচির অনেক নাটক করে গেছিলো মধ্যে মধ্যে। যাতে কারুর কোনো সংশয়ের উদ্রেক না হয়।উমাও তাঁর পূর্বের খরিদ্দার দের সাথে যে ব্যবহার টা করতো সেও তখন তাই করেছিলো সত্যের নির্দেশ মতোন।সত্য বললো উমা,তুমি কোথায় থাকতে এই নরকে আসার আগে?কে তোমার পিতামাতা?তোমার আসল পরিচয়ই বা কি?আমাকে সবিস্তারে বলো।আমি জানতে ইচ্ছুক।
উমা বললো,কি বলবো,বাবু!আমি মা বাপ মরা এক অনাথিনীর ন্যায় মাসীর বাড়িতে থাকতাম।মাসী কোনোদিনই আমাকে নিজের মেয়ে বৈ অন্য চোখে দেখেনি।কিন্তু মেসো যিনি,তিনি কখনই তাঁর অভাবের সংসারে এক উটকো বোঝা কিংবা গলগ্রহই মনে করে গেছেন।উনি কখনই আমাকে মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি।এছাড়াও মাসীর দুই ছেলে ছিলো।একটি ছেলে আমার চেয়ে কিছু বড় সে ছিলো আমার দাদাভাই আর কনিষ্ঠ টি আমার চাইতে ছোটো,আমার ভাই।ওরাও মাসীর মতোনই আমায় ভালোবাসতো।নিজের আপন দিদি ও বোনের মতোন দেখতো।বাবু,আমার আবছা মনে পড়ে,আমি যখন আট বছরের ছিলাম তখন রেলদূর্ঘটনায় আমার পিতা মাতা উভয়কেই হারাই।আর তার পর থেকেই মাসী আমাকে নিয়ে তাঁর কষ্টের সংসারে এনে রাখে।মাসী কখনও আমায় মায়ের অভাব বুঝতে দেয় নি।দুই বৎসর আমি গ্রামের পাঠশালাতেও পড়াশোনা করি।মেসো সেরকম কোনো কাজকর্ম তো করতেনই না।উপরন্তুর মাসী সংসারের নিমিত্তে কুড়িয়েবাড়িয়ে যে টুকু সঞ্চয় করতেন তা দিয়ে মেসো মদ্যপান ও জুয়াখেলা তেই উড়িয়ে দিতেন।এই নিয়ে মাসী কলহ করতে গেলে,মেসো তার উপর চড়াও হয়ে মারধোর পর্যন্ত করতেন।ক্রমশ আমার পড়া অার্থিক অনটনের দায়ে বন্ধ হয়ে গেলো।দাদা ও ভাইয়ের পড়া আমার থেকেও যে বিশেষ জরুরী হয়ে পড়লো।কিন্তু তারা দুজন ও তাদের পড়া সম্পন্ন করে উঠতে পারলো না।কারণ মেসোর নেশা দিনদিন বাড়তে লাগলো।মাসীর পক্ষে সেলাই করে ও দুই বাড়ি রান্নার কাজ করেও সম্ভব হয়ে উঠলো না তাঁর পুত্রদের শিক্ষার দায়ভার বহন করার।ফলস্বরূপ ভাই কাজ করতে লাগলো গ্রামেরই একজনের সাইকেলের দোকানে।আর দাদাভাই পলাশপুর গ্রামের অনতিদূরে ই একটি পাটকল কারখানায় কাজ ধরলো।আর আমি তখন বছর চৌদ্দের হবো।বাড়ির সমস্ত কাজ মাসীর হাতে হাতে করতাম।মেসো কে আড়াল করে মাসী কিছু ভালো খাবারও কখনও কখনও স্নেহের বশে আমার মুখে পুড়ে দিতো।আজ বড্ড মাসীর কথা মনে পড়ে বাবু!ওই মানুষ টা যে তাঁর সাধ্যের বাইরে গিয়েও আমার মা হওয়ার জন্য কোনো কার্পণ্য করে নি।ছোটোবেলায় মাসীর মুখে শুনেছিলাম,তাঁর নাকি খুব শখ ছিলো,আমার মতোন ফুটফুটে একটা ছোট্ট মেয়ের।ঈশ্বর নাকি আমায় মাসীর কোলে দিয়ে তাঁর সেই অভাব পূর্ণ করেছে।তবু মাসী বিলাপ করতো,বলতো,ওরে পোড়াকপালী কতো সুখে রাখার কথা ছিলো,আমার তোকে।কিন্তু এই অভাবের সংসারে পাঁচ পাঁচ জন মানুষেরই পাত চালানোই কোনোমতে দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।তোকে ভালোমন্দ টি কি করে খাওয়াই বল দেকি।উমা তখন মাসীকে জড়িয়ে সোহাগ করে বলতো,আমি অনেক আনন্দে আছি মাসী।কারণ তুমি আমার পাশে আছো।আমায় স্নেহ করো।ভালোবাসো।আজ অবধি কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দাও নি।এতেই তো আমি ধন্য।আমার আর কিচ্ছুটি চাই না মাসী।মাসী বোনঝি তে উঠোনের উপর বসে সুখ দুঃখের কত কথা বলতো।কখনও হাসতো,কখনো কাঁদতো।আজ সে সবই অতীত।শুধু স্মৃতির মনিকোঠায় সযত্নে তুলে রেখেছে উমা।”
এমন সময়ে বাহাদূর সিং জি র হাঁক শোনা গেল,”চালিয়ে সাব,সুভহে হো চুকে হ্যায়,আব আপকা বাক্ত খাতাম হো চুকে হ্যায়,উস লন্ডিয়া কো আভি কুছ আরাম কারনে দি জিয়ে,সাম কো ফির ম্যাহেফিল সাজে গা।”
সত্য আর উমা কথায় কথায় কখন যে ভোর হয়ে গেছে তার টের টিও পায় নি।বাহাদূর সিং এর কথায় তাঁদের উভয়েরই সম্বিৎ ফিরেছে।উমার মুখ টা ভোর হওয়ার সাথে সাথে কেমন যেন মলিন হয়ে উঠলো।সত্যর বুকেও একটা যেন অব্যক্ত যন্ত্রণা কোথা থেকে তাকে গ্রাস করলো।তবুও সে উমা কে আশ্বাস দিয়ে বললো,”তুমি চিন্তা কোরো না উমা।তোমার জীবনের বাকি গল্পটা তো এখনও জানা হল না।সেই কারণে আজকের রাতেও তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।আমিই আসবো।তোমাকে আর একলাটি ছাড়বো না।কোনো যন্ত্রণা পেতে দেবো না।আজ সত্যব্রত চৌধুরী কথা দিলো একজন নারী কে।উমা এমন সময় কিছু বলতে যাচ্ছিলো, বাইরে দাঁড়ানো একটি ছায়া তাঁদের উভয়কে আরও সচেতন করে তুললো।
ক্রমশ (চলবে)।
খুব সুন্দর