উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী

উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জ্জন
লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী
ধারাবাহিক
নবম পর্ব(৯)

সত্য সেই রাত্রিতে মেয়েটির প্রকৃত নাম জানতে পারলো।সে যা ভেবেছিলো ঠিক তাই।এমন সুন্দর সরল দূর্গা প্রতিমার মতোন মুখয়বয়ব তাঁর উপর চোখের দীপ্তিময়ী প্রভা,ক্ষণকালের জন্য যেন মনে হয় একজন তেজস্বিনী নারী আবার পরমুহুর্তেই শান্ত সহনশীলা করুণ সারল্যে পরিপূর্ণ শান্ত ধীরমতি তনয়া।তাঁর নাম যে এমনই হবে,সে বিষয়ে সত্যর আর কোনো সংশয় রইলো না।প্রথমেই উমার চোখ দেখে তাঁকে মনে হয়েছিলো বড় পবিত্র তাঁর দুটি আঁখি।ঈশ্বর যেন তাঁকে অতি নিপুণ ভাবে দূর্গা প্রতিমার ন্যায় গড়েছেন।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে সত্যর চোখে পড়লো একটি ভাঙ্গা কেদারার উপর পড়ে রয়েছে দুটি রুটি আর একটু শব্জী।সম্ভবত নৈশভোজন।রাত্রির খাবার।যা উমা অনীহা বশতই মুখে তোলে নি।যার এমন করুণ পরিস্থিতি সে কি করে খাদ্যের কথা চিন্তা করবে।সত্য তাই উমাকে বললো,”আপনার খাবার তো রাখা আছে।আপনি খান নি কেন?না খেলে তো শরীর খারাপ হয়ে যাবে।”উমা আবার পরম বিস্ময়ের সাথে সত্যের দিকে তাকিয়ে বললো,”জিসকা জিন্দেগী হি খাতাম হো চুকে হ্যায়,সিরফ এক জিন্দা লাশ হোকে জি রাহে হ্যায়,উসকা খানে অওর না খানে সে ক্যায়া আতা যাতা সাব।হাম তো জীনেকি উম্মিদ হি ছোর দিয়ে হ্যায়।আব খাকে ক্যায়া ফায়েদা?”
সত্য উমাকে বললো,”যতদিন দেহে প্রাণ আছে ততো দিন আশা ছাড়া উচিত না।প্রতিটি মানুষই আশায় বাঁচে।আপনি কেন হেরে যাবেন?লড়াই না করেই।তাদের কথোপকথনে খানিক বাংলার টান আছে দেখে তাঁরা পরস্পর পরস্পর কেই বুঝতে পারলো যে তাঁরা উভয়েই বাঙ্গালী।তাই তাঁরা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলতে শুরু করলো।আর সত্য ও জানালো আগের রাত্রিতেই সে নাকি উমা কে দেখেছিলো।শুধু তার নাম জানতে আর সে এখানে কি করে পৌঁছলো এ সমস্ত জানতেই আজ সে উমার খরিদ্দার রূপে এখানে এসেছে।উমার করুণ পরিস্থিতির কথা যে সত্য পূর্বেই আভাস পেয়েছে সে সেটাই উমা কে জানালো।আর এও জানালো সে বাবা ও তাঁর চৌধুরী পরিবারের সাবেকী দূর্গা পুজোর মাটি নিতেই মুলত এখানে এসেছে।

উমা সত্য কে বললো,”বাবু আপনি একজন সত্যিকারের পুরুষ মানুষ।আমি আপনার মতোন দেবতুল্য মানুষ এখানে আসা অবধি দেখিই নি তা বললেই অত্যুক্তি করা হবে না।তবে কেন নিজেকে এসবের মধ্যে জড়াচ্ছেন।আমার তো নিয়তিই আমাকে এই নরকে টেনে এনেছে।যতোদিন স্বশরীরে বেঁচে আছি ব্যস ততোদিনই এখানেই আমায় পচতে হবে।আত্মা বলে তো আর কিছুই আমার অবশিষ্ট নেই।আমি এক নষ্টা অপবিত্রা মেয়ে মানুষ বৈ তো নই।আপনি বরং আজই আপনার কার্য সমাধা করে বাড়ি ফিরে যান।এসবের মধ্যে নিজেকে জড়ালে আপনার প্রাণসংশয় রয়েছে।এরা এই মহল্যার প্রতিটি মানুষ ভীষণ খারাপ। আপনি শুধু শুধু ই আমার কথা জানতে এসেছেন।আপনি খুব ভালো মনের মানুষ।ভদ্দর ঘরের লোক।আপনাকে এসমস্ত জায়গায় বড়ো একটা মানায় না।
সত্য উমাকে বললো,”তোমাকেও তো এই জায়গায় মানায় না উমা।তবু তো তুমি অসহায় হয়ে এত্তো কষ্ট সহ্য করছো বলো।তোমার কি মনে হয় উমা,গঙ্গার উপর দিয়ে তো অনেক জন্জ্ঞাল বয়ে যায়,তাতে কি গঙ্গার জল অপবিত্র হয়ে যায়?তোমার শরীর যদি কেউ জোর করে অপবিত্র করে তো করুক না।তোমার শরীরের শুদ্ধিকরণ তো সম্ভব।কিন্তু তোমার আত্মা,তোমার আত্মা তো মন্দিরসম,অতি পবিত্র।কে বলে তুমি নষ্টা?নষ্টা তো তারা যারা প্রতি রাতে তোমায় অপমান করছে,লাঞ্চনা করে নিজেদের শরীরের নোংরা কামাগ্নি দ্বারা তোমায় ভোগ্যপণ্য রূপে ভোগ করছে।তাহলে তারা পবিত্র।আর তুমি অপবিত্র?না উমা আমি ছোটো থেকেই কোনো অন্যায় অবিচার সহ্য করিনি আর আজও করবো না।সেটা নারীর প্রতি হোক বা যে কোনো পুরুষের প্রতি।শেষ অবধি লড়াই করবো।এতো সহজে আমি হাল ছেড়ে দেবো না।
উমা অশ্রুসিক্ত নয়নে সত্যর দিকে চেয়ে বললো,”আমার মতোন কতো মেয়েই তো এখানে প্রতি মুহুর্তে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। আপনি কি তবে তাদের কেও বাঁচাতে পারবেন।পারবেন না।তাহলে আমাকে বাঁচাতে চাইছেন কেন?কে হই আমি আপনার বাবু?
সত্য শুধু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো,কিন্তু কিছু সঠিক যুক্তি খাড়া করতে পারলো না।শুধু এটুকুই উমা কে বললো,আমার চোখে আপনি বড়ই পবিত্র।আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না।সকলে এখানে নিজেদের জীবনটার সাথে আপোষ করে নিয়েছে দেখছেনই তো।শুধু আপনিই পারছেন না।আর পারবেন ও না কোনো দিন।কারণ আপনি সম্পূর্ণ রূপে এক অন্য ধাতু তে গড়া।
উমা এবার একটু হেসে বললো,জানেন আজ কতো দিন পর আমার সাথে কেউ দুদন্ড বসে কথা কইলো।আমার নিজের নামে আমায় সম্বোধন করলো।আপনি আমাকে যে এই নরকের জীবন থেকে ও একটা রাত্রি ধার দিলেন স্বর্গসুখ ভোগ করার।আপনি যে আমাকে কেবলমাত্র পণ্যসামগ্রী না ভেবে,একজন নারীদেহ না ভেবে একজন মানুষ হিসাবে গণ্য করেছেন।এটাই আমার কাছে চরম প্রাপ্তি। আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ ঈশ্বরের কাছে।প্রথমে আপনার কথা শুনে আপনায় বিশ্বাস হয় নি।এখন যতো আপনার সাথে কথা বলছি মনে হচ্ছে বাবু মানুষ টা আপনি একদম অন্য রকম।
সত্য ও তখন ইষৎ হেসে বললো,”আমাকে যখন এতোটাই বিশ্বাস করেছেন,তখন আমি কি আপনার আরেকটু ভরসার প্রার্থী হোতে পারি না বলুন তো?আমাকে কি আরেকটু বিশ্বাস করা যায় না।করলে আমি ও সামিল হোতে পারি আপনার এই কষ্টের জীবনে।কিছুটা কষ্ট কি ধার দিতে পারো আমায় উমা?”
বলো,সুখের ভার তো সকলেই বইতে পারে।কিন্তু মানুষের দুঃখ,কষ্ট ও অপমানের ভার তো সকলে নিতে পারে না।আমি যদি একটু অন্তত নিতে পারি তোমার কষ্টের ভার।তো নিজেকে ধন্য বলে মনে করবো।”
উমা প্রসংঙ্গ টা খানিক লঘু করার আশায় একটু কৌতুক বশত বললো,আচ্ছা বাবু,আপনি ঠিক করুন আগে,আমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করবেন না কি আপনি বলে?
এবার সত্যও সলজ্জ ভাবে উত্তর দিলো,”তুমি যেটা বলে সম্বোধন করতে বলবে,না হয় সেটা বলেই করবো।”
উমা-আমি চাই আপনি আমায় তুমিই বলুন।এতো দুঃখের মাঝেও একজন সুহৃৎ যখন পেয়েছি,তখন সে বড্ড আপন।তার কাছ থেকে তুমি সম্বোধন টা শুনতেই আমি অধিক আগ্রহী।
সত্য বললো “তবে তাই হোক।”
উমা আবার একটু ভেবে মনমরা হয়ে সত্যকে বললো,”বাবু! আজকে তো আপনি ওই নোংরা খারাপ মানুষ গুলোর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।কালকে তো আবার সেই একই অত্যাচারের সম্মুখীন হোতে হবে আমায়,তা আমি জানি।দোহাই আপনাকে বাবু,আর কখনও এ পথে আসবেন না।আমি আজকের এই স্মৃতি টুকু নিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবো।
সত্য বললো তৎক্ষনাৎ ওই দ্যাখো কান্ড,কাল আমাকে তো আসতেই হবে।তোমার বাড়ি কোথায়,কে কে বাড়িতে আছেন।তুমি কি করে এখানে এসে পড়লে,তা তো এইটুকু সময়ে জানা সম্ভব না।তাহলে আমাকে তো সেই কাল আসতেই হচ্ছে। আর হ্যাঁ,”তুমি কিন্তু মনে কোনো দ্বিধা রেখো না।জানবে তোমার না।আমি আমার প্রয়োজনেই তোমাকে আজীবন রক্ষা করে যাবো।ক্ষতি কি প্রিয়ে!এটুকু সুযোগ না হয় তুমি দিলে?

ক্রমশ (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *