***এভাবেও ভালোবাসা হয়*** _____কলমে/ মৌ দাস

***এভাবেও ভালোবাসা হয়***
_____________________________
মৌ দাস / কলমে

ভোর পাঁচটায় উঠেই উনুন ধরানো, রান্না করা তারপর বাচ্চাদের খাইয়ে কাজে বেরোতে বেরোতে যমুনার ছটা, সাড়ে ছটা বেজে যায়। রোজ এতো কাজ সামলে, বাড়ি বাড়ি ঝি গিরি করাটা খুব সহজ না। তার উপরে বিকেল বেলা আবার বাড়ির রান্নার ঝক্কি সামলে পতি সেবা।আর না পারলেই মাতাল স্বামীর মারধোর আর অত্যাচার। এসব কত সামলানো যায়। আজ একটু দেরি হয়েছে ঘুম থেকে উঠতে যমুনার।
তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েও সকাল আটটার ট্রেন ধরে যমুনা।যথারীতি কাজের বাড়ি দেরি করে আসার জন্য গালমন্দ শুনতে শুনতে, এবার ধৈর্য হারায় সে। আর বলে, “তোমরা লোক দেখে নিও গো দিদিমনি। আমি তোমাদের কাজ আর করতে পারবো নি। তোমাদের মত আমিও মানুষ। আমার ও ঘর সংসার আছে, ছেলে পুলে আছে।সে সব সামলে আসতে গেলে, একটু দেরি তো হতেই পারে। নেহাত টানাটানির সংসার তাই এতো কথা শুনেও কাজ করতি হয়। বাচ্চাগুলোর মুখ চেয়ে, গতর খাটাতি হয়। শরীলে আমাদের ও কষ্ট আচে দিদিমনি। ”
দিদিমনি বলে, “যমুনা আমার তো স্কুলে ঠিক সময়ে যেতে হবে। তুমি দেরি করলে, আমার যে অসুবিধা হয়। তাই তোমায় সময়মত আসতে বলেছি। কাজ যদি তুমি ছেড়ে দাও দিও। আর যদি করো তো সময় মতোই আসতে হবে জেনে রেখো। ” যমুনা গজগজ করতে করতে একঝাঁকা বাসন বেসিনে মাজতে থাকে। আর বলে,কপাল আমার!এমাসের পর এই কাজ আর করবোই না!এভাবেই পরপর সব বাড়ির কাজ সেরে, সে বাড়ি ফেরে যখন, তখন বিকেল। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এসে দশ মিনিট বিশ্রাম নেবে বলে যেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে, ঠিক তখনই তার মাতাল স্বামী ভোলা বলেওঠে, নবাব নন্দিনী এখন যে শুয়ে পড়লি, বলি খেতে দেবে কে?কখন রান্না বসাবি।সারাদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াস, স্বামীর কথা, ছেলে মেয়ের কথা কিছুই তো মনে থাকে না। কি করিস কে জানে!শালি গতর ভাঙিয়ে বেড়াস না,পরপুরুষে নজর তোর। তাই স্বামীর কথা মনে পড়ে না। মদ খেয়ে এসব আবোল তাবোল কথা যমুনাকে বলতে থাকে ভোলা।
এবার যমুনা আর শান্ত থাকতে পারে না,”সেও চিৎকার করে ওঠে, বলে তোর লজ্জা করে না, সংসারে এক টাকা দেওয়ার মুরোদ নেই আবার বড় বড় কথা। এই যমুনা গতর খাটিয়ে টাকা না আনলি তোর পেট ভরতো না রে!ছেলে মেয়েগুলো ভেসে যেত আমার। ছেলেপুলে না হলে, চলে যেতাম যেদিকে দুচোখ যায়,বলে কোলের ছেলেটাকে কাছে টেনে নেয়। গায়ে হাত দিতেই দেখে গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কচির গায়ে এতো জ্বর, দেখতি পারিস নি। কেমন বাপ তুই!ভোলা বলে, তোর ছেলে তুই বোঝ।ও আমার না, কার না কার পাপ আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছিস, শালি!যা দুর হয়ে যা তোর ছেলে নিয়ে। যমুনা কাঁদতে থাকে। আর ভাবে কোথাও থেকে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়, তো ছেলের ওষুধটা, তবে কেনা যায়!এই ভেবে বসতির পাশের ঘরে সে যায়, কিছু টাকা ধার করার জন্য। কিন্তু কোন উপায় হয় না। তাই সে ভাবে কোন কাজের বাড়ি থেকে টাকাটা চেয়ে নেবে। কিন্তু কার কাছে চাইবে। সবার কাছ থেকেই তো কিছু কিছু টাকা এমনিতেই অগ্রিম নিয়ে ফেলেছে সে। কাজ করে তা শোধ করতে হচ্ছে। এখন নতুন করে চাইলে কি কেউ দেবে, এই সব চিন্তা ঘুরপাক খায় যমুনার মাথায়। মনে মনে বলে, কাল সকালেই দিদিমনির কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে ছেলেকে ডাক্তার দেখাবে সে। পরদিন সে ঘুম থেকে উঠে রান্না বান্না করতে থাকে। কাজে বেরনোর তাড়া। সে ঘুম থেকে তুলে তিন ছেলে মেয়েকে রোজ ভাত খাইয়ে বেরোয়। আজও যখন সে তাদের ঘুম থেকে তুলতে যায়, দেখে কোলের ছোট ছেলেটা জ্বরে বেহুঁস। সে ছেলে নিয়ে হাসপাতালে ছোটে, বিনা পয়সায় চিকিৎসার জন্য। সারাদিন পর বিনা পয়সায় ডাক্তার দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে দেওয়া বিনামূল্যের ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফেরে সে। সে এদিন আর কাজে যেতে পারেনি। ছেলে সুস্থ না হলে,সে তাকে ফেলে যেতে পারবে না। চারদিন পর যখন ছেলে একটু সুস্থ হল তখন যমুনা যথারীতি আবার কাজে বেরলো। সেদিন দিদিমনির বাড়ির বেল বাজাতেই, দিদিমনি দরজা খুলে বললো, “যমুনা তোকে আর কাজ করতে হবে না। নতুন লোক কাজে রেখেছি। “___আর তোকে তো, আগাম মাইনের টাকা দেওয়া আছে। এই কথা শোনার পর, আর যমুনা বলতে পারলো না যে, কি কারনে সে কাজে আসতে পারে নি বা তার যে খুব টাকার দরকার। সে আরকিছু না বলেই ধির পায়ে পা বাড়ায় রাস্তার দিকে।
ভাবতে থাকে একটা কাজের খুব দরকার। নাহলে সে সংসার টা টানতে পারবে না। দিদিমনির বাড়ি থেকে বেশ ভালোই বেতন পেতো যমুনা।এখন সে টাকার অভাব কি ভাবে পূরণ হবে, ভাবতে ভাবতে অন্যান্য বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনে তারই এক সঙ্গী লতিকাকে জানায় তার সব কথা। বলে একটা কাজের খুব দরকার। লতিকা বলে তার হাতে একটা রান্নার কাজ আছে। যদি সে তা করতে পারে, তবে ভাল মাইনে দেবে তারা। একজন লোকের রান্না।গঙ্গারাম মণ্ডলের বাড়িতে রান্না করতে হবে। আর কিছু কাচাধোয়ার কাজ। যমুনা জানায় সে কাজটা করবে। পরদিন লতিকার সাথে যমুনা গঙ্গারাম বাবুর বাড়ি যায় এবং কথা পাকা করে আসে। গঙ্গারাম বাবু বলে, কাল সকাল থেকেই নাহয় কাজে এসো যমুনা। আজ আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। এই গঙ্গারাম বাবু, অবিবাহিত একাই থাকেন। একটা চাকরি করেন আর বাকী সময় লেখালেখি করে অবসর সময় কাটান। পরদিন সকালে যমুনা কাজে যোগদেয়। পরিপাটি করে সমস্ত রান্না করে।যত্ন করে ঘরদোর গোছায়। জামাকাপড় কেচে মেলে দিয়ে বেরিয়ে যায়। গঙ্গারাম বাবু কাজ কর্ম সবকিছুই লক্ষ্য করেন।আরও দেখেন যমুনার কালো রূপ যেন কৃষ্ণ কলির মত। তার এতো সুন্দর চোখ, নাক, শ্যামলা চিকন চেহারা মুগ্ধ করার মত।
পরদিন যখন যমুনা কাজে আসে তখন তিনি তার বাড়ির কথা পরিবারের কথা জানতে চান। এবং যমুনাও তার বর্তমান পরিস্থিতির কথা, মাতাল স্বামীর কথা, অসহায় বাচ্চাগুলোর কথা সব বলতে থাকে। গঙ্গারাম বাবু বলেন তোমার টাকার দরকার হলে বা কোন জিনিসের দরকার হলে বলো,লজ্জা করোনা। ওনার আশ্বাসে যমুনা কিছুটা স্বস্তি পায়। এভাবে প্রায় এক বছর হল,যমুনা গঙ্গারাম বাবুর বাড়ির কাজ করতে করতে যেন সংসারেরই একজন হয়ে উঠেছে। এখন যমুনার এই সংসার টাও নিজের বলেই মনে হয়। আলমারির চাবি, ঘরের চাবি সব দায়িত্ব তারই। আর সে তা সততার সাথে পালন করে চলে। গঙ্গারাম বাবুর ও তার প্রতি এক অটুট বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতা স্বাভাবিক ভাবেই গড়ে উঠেছে।যা তার একাকী জীবনে তাকে অনেকাংশে নিশ্চিন্ত করে। এরপর একদিন যমুনা রোজের মতই, গঙ্গারাম বাবুর বাড়িতে কাজে গিয়ে দেখে বাবুর খুব জ্বর। বিছানায় পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। যমুনা তার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে চিন্তা করে, মনে মনে বলে মানুষ টারে দেখার মত কেউ নেই। মানুষটারে সুস্থু করে দাও ঠাকুর। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, বাবু আমি আছি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। গঙ্গারাম বাবুও জ্বরের ঘোরে তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। সবকাজ সেরে যমুনা বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু তার আজ মনটা খুব খারাপ। কোন কাজ তার ভালো লাগছে না। সে শুধু গঙ্গারাম বাবুর কথাই ভেবে যাচ্ছে, তাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। যেটুকু খাবার ঘরে ছিল সে তার ছেলেমেয়েকে খাইয়ে চুপ করে বসে থাকে। এদিকে বাড়িতে যথারীতি ভোলার চিৎকার, গালিগালাজ রোজের মতোই চলতে থাকে। আজ সে একটু বেশী নেশা করে ফিরেছে। ফিরেই খাবার নেই দেখে যমুনাকে উত্তম মধ্যম মারতে থাকে। কাজ থেকে ফিরে সে এখনো রান্না বসাতে পারেনি। কারন মনটা তার কাজে বসছে না। ভোলা তাকে মারতে মারতে ঘর থেকে তাড়িয়ে বের করে দেয়। বলে শালি যেখানে ছিলি, সেখানে চলে যা। যমুনা চুপ করে থাকে। তারপর গঙ্গারাম বাবুর বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে। গিয়ে দেখে বাবু জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে। মনে মনে ভাবে কিছুক্ষণ ঘুমোচ্ছে হয় তো। সে স্নানঘরে গিয়ে স্নান সেরে নেয়। তারপর বাবুর কাছে এসে বসে। কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এক অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করে ।গঙ্গারাম বাবুও তাকে শিশুর মত আঁকড়ে ধরে। যমুনা বুঝতে পারে যে,সে গঙ্গারাম বাবুর প্রতি কতটা দুর্বল। গঙ্গারাম বাবু তাকে যেমন কাছে টেনে নেন, তেমনি যমুনাও অবাধে তার কাছে ধরা দেয়। নিজেকে তার কাছে সমর্পন করে। জ্বরের ঘোরেই মুহূর্তের দুর্বলতায় তারা মধ্যে গড়ে ওঠে আদিম সম্পর্ক। তাতে যমুনার মনে কোন অপরাধ বোধ জন্মায় না। বরং এই প্রথম সে সত্যিকারের ভালোবাসার ছোঁয়ায় চরম তৃপ্তি অনুভব করে। এভাবেই হয়তো পারস্পরিক বিশ্বাস, নির্ভরযোগ্যতা থেকে ভালোবাসা গড়ে ওঠে। যা প্রমাণ করে ভালোবাসা গরীব বড়লোক, উচ্চ নিচ, শিক্ষিত অশিক্ষিতর বাঁধা গন্ডির বাইরে এক চিরন্তন মানসিক ও মানবিক বন্ধন। প্রমাণ হয় এভাবেও ভালোবাসা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *