তীর্থের পথে পথে শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম , আগরপাড়া কোয়েলী ঘোষ
তীর্থের পথে পথে
শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম , আগরপাড়া
কোয়েলী ঘোষ
দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন আমরা পানিহাটি লঞ্চঘাট থেকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম । গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি থেকে দর্শন করে আমরা পৌঁছলাম মা আনন্দময়ীর আশ্রমে । বাইরে দেওয়ালে লেখা মায়ের অসংখ্য বাণী , পড়তে পড়তে এগিয়ে চলেছি ।
এই প্রসঙ্গে মা আনন্দময়ীর জীবনের কথা কিছু বলি । ১৩০৩ সালের ১৯ শে বৈশাখ ইং ১৮৯৬ সালে মা আনন্দময়ী ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত খেওড়া গ্রামে জন্ম নেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি দিব্যভাবে বিভোর থাকতেন । কীর্তন শুনলে মায়ের নানা অলৌকিক প্রকাশ ঘটতো । কখনো তিনি ঢলে পড়তেন , কখনও বা অজ্ঞান হয়ে যেতেন । তাঁর অসংখ্য লীলাকাহিনী ছড়িয়ে আছে যা আমাদের বুদ্ধির অগোচরে । দেওঘর আশ্রমে যখন তিনি এসেছিলেন শ্রীশ্রী বালানন্দ মহারাজ দেখলেন , মায়ের পা মাটিতে পড়ছে না । ধ্যান মন্দিরে তাঁর ভাব সমাধি দেখে তিনি বলেছিলেন যে ইনি সাধিকা নন ,ইনি নিত্যসিদ্ধা । কোন কর্মের উপলক্ষ্যে জন্ম নিয়েছেন আবার কর্ম শেষে চলে যাবেন ,এনাদের কোন সাধন ভজন করতে হয় না ।
তাঁর অনির্বচনীয় জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি , মধুর হাসি ,সুমধুর কণ্ঠস্বরে তিনি মা আর আমরা মায়ের সন্তান ,এই উপলব্ধিতে মায়ের কৃপায় সবাই এক অনাবিল আনন্দ আস্বাদন করতেন ।
মা বলেছিলেন – ” হরিকথাই সার কথা , আর সব বৃথা ব্যথা । ”
উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত আগরপাড়ায় মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ১৯৫৮ সালে এই আশ্রম তৈরি হয় ।গঙ্গার নিজস্ব বাঁধানো ঘাটটি মা আনন্দময়ী ঘাট নামে পরিচিত । মূল মন্দির হল হিমালয়ের পাদদেশে হরিদ্বারের কংখলে ।এ ছাড়া মোট পঁচিশটি শাখা আছে ।
১৯৭৫ সালে আগরপাড়ায় এক বিশাল কর্মযজ্ঞ মহোৎসব হয়েছিল । মাতৃ সান্নিধ্যে এসেছিলেন শ্রী মৎ সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথজী , মায়ের গোপাল শ্রী শ্রী মোহনানন্দ মহারাজ , ড: মহানাম ব্রত ব্রক্ষচারী , আরও কত মহাপুরুষ , এসেছিলেন অনেক শিল্পী আর অসংখ্য ভক্ত । সন্তানের মৃত্যুর পরই প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসেছিলেন মায়ের কাছে ।
গঙ্গার ধারে শান্ত নির্জন আধ্যাত্মিক পরিবেশে বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আগরপাড়ায় এই আশ্রম । চারিদিকে এমন সবুজের সমারোহ , গোলাপ বাগান , একদিকে পুকুর , বড় বড় গাছপালায় সাজানো এই আশ্রম দেখে সবাই মুগ্ধ হলাম । ভিতরে ঢুকে বাগানের ভিতর দোলমঞ্চে রাধাকৃষ্ণের অপূর্ব মূর্তি দেখলাম । নাটমন্দিরে মায়ের বড় ছবি , পাশে জগন্নাথ দেব । সামনে মণ্ডপে মা দুর্গার মূর্তি । তখন পুজো সমাপ্ত হয়েছে । মায়ের হাসি মুখের ছবি দেখে মন শান্তিতে ভরে গেল ।
মাতৃমন্দিরে আছে স্বামী মুক্তানন্দ গিরি মহারাজের শ্বেতপাথরের বিগ্রহ, ভোলানাথ, যোগেশ্বর, নির্মলেশ্বররূপী তিন শিবলিঙ্গ, অষ্টধাতুর তৈরী রাধাগোবিন্দ, গৌর নিতাই, লক্ষ্মীনারায়ণ, শ্রী গণেশ , গরুড়, ও হনুমানজীর বিগ্রহ ।
বাগানের মধ্যে আছে পঞ্চবটী, জপ কুটীর। এছাড়াও আশ্রমে রয়েছে যজ্ঞশালা, গোশালা, , আনন্দ ধ্যানপীঠ, ও ভক্তদের থাকার জন্য ভক্তনিবাস।
ধ্যানপীঠে দেখলাম মায়ের সুন্দর শ্বেত পাথরের মূর্তি । মাকে অনন্ত কোটি প্রণাম জানিয়ে এলাম — ” মাগো আনন্দময়ী ,নিরানন্দ করো না ‘ গানটি মনে পড়ল । সেদিন শান্ত স্নিগ্ধ এক পবিত্র মন নিয়ে ফিরে এলাম । তখন রাত্রি নেমেছে । গঙ্গার ওপর দিয়ে লঞ্চ চলেছে ওপারে । আবার আসবো ফিরে এই আশ্রমে মায়ের আশ্রয়ে ।
এখানে দুর্গাপূজা,রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, দোল উৎসব, মায়ের আবির্ভাব তিথি ,অন্নকূট ,গীতা জয়ন্তী উৎসব ,চৈতন্য দেবের আবির্ভাব তিথি ইত্যাদি পালিত হয়। আশ্রম পরিচালিত একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও আছে।
বেলা ১২টার মধ্যে এলে মন্দিরে ভোগ খাবার বন্দোবস্ত আছে।
শিয়ালদহ থেকে আগরপাড়া স্টেশনে নেমে অটো ভাড়া করে আসা সুবিধে হবে ।
ছবি ঋণ – সুরঞ্জন দেব