কথা-সাহিত্যিক-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা জীবন ও মৃত্যুর আবর্তে – গৌতমী ভট্টাচার্য
কথা-সাহিত্যিক-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা জীবন ও মৃত্যুর আবর্তে –
গৌতমী ভট্টাচার্য
*************************
উপন্যাসের প্রারম্ভেই এসেছে মৃত্যুর অনুষঙ্গ। এই বইটিতে ঔপন্যাসিকের মার্কসবাদী মনোভাব এবং ফ্রয়েডীয় দর্শনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বারবার মৃত্যু এবং সম্পর্কের অপমৃত্যু বা অবনতি ঘুরে ফিরে এসেছে।
পুতুল নাচের ইতিকথায় জীবনের রঙ্গমঞ্চে অদৃশ্যশক্তির হাতে বাঁধা সুতোয় উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিয়ন্ত্রিত।চরিত্রগুলোর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনদর্শন পরিস্ফূট হয়েছে।
প্রারম্ভেই গাওদিয়া গ্রামের হারুঘোষের মৃত্যু নায়ক ডঃ শশীর জীবনে বৈরাগ্য আনেনি। প্রবল ভাবে বস্তুতান্ত্রিক ভোগবাদী
জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
বার্ধক্যপীড়িত যাদবপন্ডিত কৌতুকময়ী পাগলাদিদির ঘনানো মৃত্যুর স্বাদেও গোছানো সংসারে শশীর শান্তির অনুভূতিতে বস্তুতান্ত্রিক ভোগবাদের চলমানতা স্পষ্ট।
মার্কসবাদী কথাকার সরব হয়েছেন গোপাল ও শশীর চরিত্রে। অসৎ উপায়ে দালালি করে পুঁজিবাদী মহাজন প্রভূত সম্পত্তির মালিক হয়ে ও সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি ডঃ পুত্র শশীর ওপর। শশীর ও বিতৃষ্ণা পিতার ওপর।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনাস্থা সূর্যবিজ্ঞানে বিশ্বাসী যাদবপন্ডিত নিজের খ্যাতির আসন চিরস্থায়ী করতে শশীর কাছে মুখ ফসকে বলে ফেলা স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা রাখতে রথের দিনই সস্ত্রীক মৃত্যুবরণ করেছেন বৈজ্ঞানিক উপায়েই আফিম খেয়ে।
যামিনী কবিরাজের সঙ্গে দাম্পত্যজীবনে অসুখী রূপসী অপুত্রক সেনদিদির শশীর প্রতি অপত্যস্নেহ,গোপালের ঈর্ষা, বসন্তরোগের চিকিৎসায় সুস্থ করে শশী, রোগ উত্তীর্ণ একচোখ অন্ধ কুরূপা সেনদিদির সঙ্গে গোপালের অবৈধ সম্পর্কর জেরে সেনদিদির অপূর্ণ মাতৃত্বেরস্বাদ পূরণ, সেনদিদির ও যামিনীকবিরাজের মৃত্যু হয়েছে। শশীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে সেনদিদির অবৈধ নবাগত সন্তানকে নিয়ে গোপালের পলায়ন শশীর সঙ্গে সম্পর্কের দৈহিক না হলেও মানসিক মৃত্যু হয়েছে।
গাওদিয়ার গ্রাম্যসংস্কার শশীর মধ্যে প্রোথিত। হারুঘোষের পুত্রবধূ পরাণের স্ত্রী দাম্পত্যজীবনে অসুখী গ্রাম্যমেয়ে কুসুমকে শশীর পছন্দ।কুসুমের শশীর কাছে আসলে তার শরীর কেমন করে জানালে শশীর নাগরিক সভ্যতায় পরিশীলিত সাহিত্য পড়া রোমান্টিক স্বপ্নদেখা কল্পনাবিলাসী মন বলে, “শরীর শরীর তোমার মন নেই কুসুম।”এই দুটো চরিত্রে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্বের প্রভাব স্পষ্ট। শশীর মনে দ্বৈত্ব দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। শশীর অবহেলায় কুসুমের মনের মৃত্যু ঘটে, লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ও ঠান্ডা হয়ে যায় একসময়।কুসুম গাওদিয়া ত্যাগ করে।
শশীর গাওদিয়া ছেড়ে নাগরিক জীবনের চাহিদা বিলেতে উচ্চশিক্ষার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় গোপালের সম্পত্তি,যাদবপন্ডিতের সঞ্চিত অর্থে ও তারই নির্দেশে হাসপাতাল তৈরীর খ্যাতি ডঃ শশীর নেতার ভূমিকা।
সম্পর্কগুলোর দৈহিক ও মানসিক মৃত্যুতে শশী মন্থর গতিতে মানুষ খুঁজে বেড়ায়, টিলার উপর উঠে সূর্যাস্ত দেখার শখ আর তার হবে না।