বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ…. ✍️ তাপস
বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ….
✍️ তাপস
অনেক ঠাকুরের মধ্যে নরেন ঠাকুর আর রবি ঠাকুর প্রতিটি বাঙালির প্রাণে আর রক্তে মিশে আছে । একজনের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, অন্যজনের জন্ম কলকাতার কাছেই সিমলা স্ট্রিটে, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ বয়সের ব্যবধানে দু বছরের ছোট বড়, তবু দুই মহান ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন, আবার অসংখ্য ভুল তথ্য আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। দু’জনে কি দু’জনার কাছে আসতে পেরেছেন কখনও? শুরু করি নরেন ঠাকুর অর্থাৎ স্বামীজিকে নিয়ে। নরেন্দ্রনাথ দত্তর জন্ম উত্তর কলকাতার সিমলা পাড়ায়, সঠিক ঠিকানা – ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রিট। স্বামীজির কোন লেখাতেই আমরা দত্ত বাড়ির ইতিহাস জানতে পারি না, স্বামীজীর থেকে ছয় বছরের ছোট মহেন্দ্রনাথ অনেক তুলনাহীন বর্ণনা রেখে গেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। সেখান থেকেই আমরা জানতে পারি প্রখ্যাত উকিল বাড়িটি প্রায় দেড় বিঘার জমির উপরে ছিল। তখন গৃহস্থবাড়িতে কাঠের জ্বালে রান্না হত। প্রচারের জন্য বিনামূল্যে বাড়িতে কয়লা দিয়ে যেত লোক। শীতকালে এমন ঠান্ডা পড়তো সেকালের কলকাতায় যে , মালসা করে আগুন রাখতে হত ঘরে। দত্তবাড়ির ছাদে উঠলে জাহাজের মাস্তুল দেখা যেত কারণ সিমলা থেকে জগন্নাথ ঘাট অব্দি কোন উঁচু বাড়ি ছিল না। বাড়ির মধ্যে তিনটে পাতকুঁয়ো ছিল, সেই জলই ব্যবহার হতো রান্নার কাজে। পাতকুঁয়োর জল পরিষ্কার করে রাখার জন্য কচ্ছপ ছিল একটা, সেটা অবশ্য তখনকার দিনের দস্তুর। খাবার জন্য হেদুয়া থেকে চাকররা জল আনতো। মজার বিষয় হচ্ছে এই চাকরদের কারোর গোঁফ ছিল না কারণ তৎকালীন যুগে চাকররা গোঁফ রাখতে পারত না, কিন্তু পাইকরা গোঁফ রাখতে পারতো। এই সিমলে পাড়ায় বড় মাতালের উৎপাত ছিল। লোকে বলত -“সিমলার মাতাল আর বাগবাজারের গেঁজেল। ” স্বামীজীর ছোটভাই ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত Swami Vivekananda (Patriot-Prophet) বলে একটি বই লিখে যান। সেই বইয়ে স্বামীজীর পারিবারিক ইতিহাস অনেকটাই দেয়া আছে। স্বামীজীর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত দরিয়াটোনা বাসিন্দা। এই দরিয়াটোনার দত্তরা মুঘল আমল থেকেই বিখ্যাত, দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থদের যে ত্রিশটি সমাজ ছিল তার মধ্যে দত্তরা ছিল অন্যতম। কোন মোঘল নবাব খুশি হয়ে ওই গ্রামটির নামকরণ করেন দত্ত দরিয়াটোনা। স্বামীজীর এক পূর্বপুরুষ রামনিধি এই দত্ত দরিয়াটোনার থেকে কলকাতায় চলে আসেন। এই দরিয়াটোনার দত্ত বংশের পরিচয় দিতে গিয়ে স্বামীজীর ছোট ভাই ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এক অদ্ভুত পারিবারিক তথ্য প্রকাশ করেন। তথ্যটি হলো স্বামীজীর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত “সুলোচনা” নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। স্বামীজীর মা ভুবনেশ্বরী কবিতা লিখতেন সেটা অবশ্য আমাদের অজানা নয়, কিন্তু স্বামীজীর পিতা বিশ্বনাথ দত্তের এই সাহিত্য সৃষ্টির কথা এর আগে কেউ জানতেন না। কিন্তু অদ্ভুত তথ্যটা হচ্ছে এই লেখাটি বিশ্বনাথ দত্ত তার নিজের নামে ছাপেন নি, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে নিজের নামে ছাপার আর্থিক সঙ্গতি তখন তার ছিল না, এই লেখাটি ছাপা হয় তাঁরই এক জ্ঞাতি খুড়ো
শ্রী গোপাল চন্দ্র দত্তের নামে। “সুলোচনা” উপন্যাস নিয়ে উৎসাহের কারণ একটাই, স্বামীজীর পিতা বেশ কিছু ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ঘটনার একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন এই “সুলোচনা” উপন্যাসে অঘোরস্বামী বলে একটি চরিত্র আছে, যেটি স্বামীজীর পিতামহ দুর্গাপ্রসাদ দত্তর ছায়া বলে বোধ হয়। স্বামীজীর পিতামহ দুর্গাপ্রসাদ দত্ত সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান, অর্থাৎ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়া দত্ত পরিবারের নতুন নয়। এই অঘোরস্বামীর মুখ দিয়ে স্বামীজীর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত কিছু কথা বলিয়েছেন যার সাথে পরবর্তীকালে স্বামীজীর জীবনবোধের আশ্চর্য মিল। যেমন – ” কর্ম ভিন্ন কেবল চক্ষু মুদিয়া ভাবনায় কোন ফল নাই। কর্মের অর্থ অনেক। কেবল আপন শরীরকে যাতনা দেওয়া কর্ম নহে। সংসারের সুখোন্নতি, পরের ইষ্টসাধন, অনিষ্ট সাধন থেকে বর্জিত থাকা, শীতপীড়িত কে বস্ত্রদান, রোগের রোগের সেবা, আশ্রয়হীনকে আশ্রয়দান – এই সকলই কর্ম। যাহারা এইরূপ কর্ম সাধন করিতে যত্নবান না, তাহাদেরই ঈশ্বর ধ্যানের অধিকার নাই। ” এ যেন স্বামীজীর ” জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ” এই মহান বাণীর এক উপন্যাস রূপ। ( চলবে )
✍️ তাপস
( পরের সংখ্যায় দত্তবাড়ির মামলা-মোকদ্দমার ইতিহাস )