ভিন্ন রূপে একই সত্তা —– মীনা দে

ভিন্ন রূপে একই সত্তা
মীনা দে

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই ভারতীয় সমাজ যখনই দুর্নীতি অনৈতিকতা অধর্ম অনাচার ইত্যাদির শিকার হয়েছে তখনই কোন না কোন মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তারা ভারতীয় সমাজকে সেই পঙ্কিলতার আবর্ত থেকে উদ্ধার করেছেন। আমাদের ধর্মের ইতিহাস এই রকম বহু ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। গীতাতেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “ যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম। ” । যখনই অধর্মের অভ্যুত্থান হয় তখনই আমি নিজেকে সৃজন করি অর্থাৎ আবির্ভূত হই।
এই রকমই এক ধর্ম সংকট কালে ভগবান শ্রীচৈতন্য এবং তার কয়েক শতাব্দী পরে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁরা উভয়েই যে একই সত্তার ভিন্ন প্রকাশ বা একই সত্তা দুই রূপে এ কথা তাঁদের জীবনের বেশ কিছু ঘটনাবলি আলোচনা করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তাঁরা উভয়েই ভারতীয় আধ্যাত্মিকতাকে পুনঃ প্রতিষ্টিত করেছেন। এবং ভারতীয় সমাজকে কুসংস্কার অনাচার ও ধর্ম গ্লানির সংকট থেকে রক্ষা করে নব জাগরনের পথ সুপ্রতিষ্টিত করেছেন। শাস্ত্রে বলা আছে যে উনিশটি প্রধান প্রধান ভাবের সম্মিলনকে মহাভাব বলা হয়। শ্রী রাধিকার এই মহাভাব হয়েছিল। রাধাভাবে ভাবিত শ্রীচৈতন্যদেবেরও এই মহাভাব হয়েছিল আবার শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেও এই মহাভাবের লক্ষণগুলি সর্ব প্রথম ভৈরবী ব্রাহ্মণীর চোখে পড়ে ছিল এবং তাঁকে সমর্থন করে ছিলেন বৈষ্ণবচরণ। এই মহাভাব ধারণ করা কোন সাধারণ মানবের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। একমাত্র অবতার পুরুষেরাই তা পারেন। ঈশ্বরই স্বয়ং নরদেহ ধারণ করে এই পৃথিবীতে আসেন, তখনই আমরা তাঁকে অবতার বলি। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্যকে এই দিক থেকে বুঝতে চেষ্টা করলে উপলব্ধি করা যায় যে তাঁরা একই সত্তার ভিন্ন রূপ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের পরম ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত ছিলেন পরম বৈষ্ণব। তিনিও শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীগৌরাঙ্গের সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীগৌরাঙ্গই এযুগে শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিকার অক্ষয় কুমার সেন লিখেছে
“ এত শুনি প্রভু বাক্যে রাম মহামতি
চৈতন্যচরিতামৃত পড়ে নিতিনিতি।
চৈতন্যচরিত পাঠে হয় এই ফল
রাম দেখে শ্রীচৈতন্য প্রভু অবিকল।
সেকালে আছিল শ্রীচৈতন্য নাম রাষ্ট্র
এই অবতারে নাম প্রভু রামকৃষ্ণ। ”
আরও বলেছেন “ গৌর অবতারে যেন শ্রীদাম অঙ্গন। এবে তেন বলরাম বসুর ভবন ”। শ্রী চৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণের এক বছর আগে থেকেই শ্রীবাসের গৃহে নামসংকীর্তন করতেন ভক্তদের নিয়ে। সেখানে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ এবং হরিসংকীর্তনের জমজমাট আসর বসতো। বলরাম বসু এক বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন, তিনিও ঠাকুরকে চৈতন্য রূপেই দেখতেন। শ্রীচৈতন্যভাগবতে উল্লিখিত আছে গৌরাঙ্গের ভবিষ্যৎবাণী,
“পুনঃ যে করিব লীলা মোর চমৎকার
কীর্তনে আনন্দরূপ হইবে আমার ”।
স্বাভাবিক ভাবেই ঠাকুরকে সংকীর্তনরত অবস্থায় দেখে সকলেরই মনে হতো , চৈতন্য লীলারই পুনরাভিনয় করছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি যেন নবীন বেশে নবীন গৌরাঙ্গ। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার নিজের মুখে তাঁর আদরের নরেনকে বলেছিলেন, “ শ্রীগৌরাঙ্গের নাম শুনেছিস ? আমিই সেই। (কথামৃত)।
শ্রীচৈতন্যের জীবনের সবথেকে বড় অবদান হল নাম সংকীর্তন প্রচলন। অপূর্ব ভাব মন্ডিত এই সংকীর্তন তৎকালীন সমাজকে এক নতুন ভাব সুধায় মাতোয়ারা করে তুলেছিল। হাজার হাজার মানুষ এই সংকীর্তনের সুর লহরিতে মাতোয়ারা হয়েছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণের মধ্যেও এই সংকীর্তের গভীর ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। যাঁরা সেই সময় ঠাকুরকে কীর্তনে ভাবোন্মত্ত অবস্থায় দেখেছিলেন তাঁদের মনে হয়েছিল চৈতন্যদেবই যেন পুনরায় সংকীর্তনের আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন। পেনেটির মহোৎসবে সমবেত সহস্র নরনারীর মনে হয়েছিল এই মহাপুরুষের ভিতর নিশ্চয়ই শ্রীগৌরাঙ্গের আবির্ভাব হইয়াছে। দুই একজন ভাবিতেছেন ইনিই বা সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ। কথামৃতে আমরা এই কথা পাই। ঠাকুর রামকৃষ্ণ কলুটোলার হরিসভায় গিয়েছিলেন বৈষ্ণবচরণের ভাগবত পাঠ শুনতে, সেখানে তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে চৈতন্যাসনের উপর দাঁড়িয়ে পরেন এবং সমাধিস্থ হন , শ্রীচৈতন্যের মতোই ঊর্ধ্ব বাহু অবস্থায়। কথামৃতে আমরা আরও পাই , ঠাকুরের ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি যদি চৈতন্যদেবের নগর সংকীর্তণ দেখতে পেতেন! তাঁর সেই বাসনা রূপ পেয়েছিল তাঁর সাধনভূমি দক্ষিনেশ্বরেই। তিনি ভাব চক্ষে দেখেছিলেন সংকীর্তনের এক জনসমুদ্র এগিয়ে আসছে কালীবাড়ির দিকে। এবং সেই জন সমুদ্রের মধ্যমণি রূপে চৈতন্যকে দেখতে পেয়ে ছিলেন।
বাসুদেব সার্বভৌম শ্রীচৈতন্যদেবকে বেদান্ত শিক্ষা দেবার সময় শ্রীচৈতন্য তাঁর শিক্ষা দেবার পদ্ধতিতে খুশি হতে পারেননি। এবং সার্বভৌমের সঙ্গে তিনি তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই তর্ক বিতর্কে সার্বভৌম পরাজিত হন। তিনি শিষ্যের শাস্ত্র জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হন। শ্রীমৎ তোতাপুরীও ঠাকুরকে বেদান্ত সাধন করাতে গিয়ে দেখেন , যে নির্বিকল্প সমাধি লাভের জন্য তাঁর চল্লিশ বছর লেগেছিল , ঠাকুর তা মাত্র তিন দিনেই আয়ত্ত করলেন। যবন হরিদাস শ্রীচৈতন্যের কাছে প্রার্থনা করে ছিলেন মৃতুকালে যেন শ্রীচৈতন্য তাঁর সামনে উপস্থিত থাকেন শ্রীচৈতন্যও সেই বাসনা পূর্ণ করে ছিলেন। আবার রসিক মেথর যে ঠাকুরের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিল , তার ইচ্ছানুযায়ী ঠাকুরও তার মৃত্যুর সময় তাকে দর্শণ দিয়ে ছিলেন। যদিও ঠাকুর তখন সশরীরে ছিলেন না।
শ্রীচৈতন্য এবং শ্রীরামকৃষ্ণ উভয়েই সাধনকালে ভক্তি এবং ভবের প্রাবল্যে দিব্যোন্মাদ অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গে স্বামী সারদানন্দ বলেছেন, “ ঈশ্বরীয় ভাবের প্রবল বন্যা যখন অতর্কিত ভাবে মানব জীবনে আসিয়া উপস্থিত হয় তখন তাহাকে চাপিবার প্রবল চেষ্টা করিলেও সফল হওয়া যায়না। মানব সাধারনের জড়দেহ উহার প্রবল বেগ ধারণ করিতে সক্ষম হয়না। এইরূপে অনেক সাধক মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে । অবতার পুরুষদিগের শরীর সকল কেবল উহার পূর্ণ বেগ সর্বক্ষণ ধারণ করিয়া সংসারে জীবিত থাকিতে পারে। । ” এই সকল দিক বিবেচনা করে বলা যেতে পারে দুই মহাপুরুষই অবতার ,এবং ভিন্ন রূপে একই সত্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *