জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া ©✍ সায়ন্তন ধর
জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া
©✍ সায়ন্তন ধর
(সপ্তম পর্ব)
…পথে পড়লো একটি স্যান্ডস্টোনের ব্রিজ, নাম বাস্তেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০৫ মিটার উঁচুতে জলপ্রপাতের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট রককলামগুলি স্যান্ড স্টোন দিয়ে জুড়ে এই ব্রিজ গঠিত। পূর্বে এই রককলামগুলি কাঠ দিয়ে যুক্ত ছিল। কিছুক্ষণ এই ব্রিজের উপর কাটালাম। প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের সঙ্গে মানবিক ভাস্কর্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে এখানে। প্রবল বেগে বাতাস বইছে আর রক কলামে বাতাস কেটে নানারকম শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখান থেকেই অপরূপ সূর্যাস্ত দেখলাম তারপর রাতের আস্তানা খোঁজার জন্য এগিয়ে চললাম। চলার পথে পড়ল অ্যামসেলসি হ্রদ। সান্ধ্য আলোয় সেই শান্ত জলে হনিগস্টেইন রক কলামের রিফ্লেকশন দেখলাম। এখানকার ঐতিহ্য মেনে কোন তাবু আনা হয়নি সঙ্গে কেবল একটি স্লিপিং ব্যাগ। নির্দিষ্ট স্থানে একটি গুহা খুঁজে বের করে তাতে রাতটা কাটিয়ে দিলেই হল। সঙ্গে কিছু ড্রাই ফুডস রয়েছে। এভাবে রাত কাটানোকে বুফেন বলে। একটু যে ভয় ভয় লাগছিলো না তা নয় তবে স্লিপিং ব্যাগে নিজেকে সুরক্ষিত মনে হচ্ছিলো। দূর থেকে কিছু বন্য প্রাণীর ডাক ভেসে আসলেও গুহার সামনে থাকা আগুনের জন্য বেশ নিরাপদে ছিলাম। একটা অ্যাডভেঞ্চারাস রাত্রি কাটলো। পরদিন আবার হাঁটতে লাগলাম পাহাড়ি পথে অরণ্যের মধ্য দিয়েই। শুকনো পাতা বিছানো ট্রেকিং ট্রেইলের বেশ কিছুটা উৎরাই এখন। গাছগুলির পাতায় হলুদ, সবুজ, নীলচে সবুজ, লাল হরেক রকমের রঙের শেড। এখানে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রকৃতির রূপ। মনে হচ্ছে যেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ক্যাস্পার ডেভিড বা উইলিয়াম টার্ণারের মত ইজেল, তুলি, প্যাস্টেল দিয়ে দৃশ্যগুলি ধরে রাখি ক্যানভাসে। এভাবে প্রায় সাত দিন পথ চললাম। রাতগুলো কাটিয়ে দিলাম বুফেনে। শেষের অংশটুকু খুব চড়াই ছিল। প্রায় ৪০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছে স্যাক্সন সুইজারল্যান্ড জাতীয় উদ্যানকে ওপর থেকে দেখার সৌভাগ্য হল। অনন্য পাহাড়ি সৌন্দর্য্যে মনে পড়ে যায় আমার ডুয়ার্সের কথা। কিছু কিছু জায়গায় চিত্রশিল্পীদের ক্যানভাস হয়ে উঠেছিল বড় বড় পাথর। ধূসর পাথরকে রঙিন করে তুলেছিল উনবিংশ শতাব্দীর তেল রংগুলি। এখানে আসার পথে একটি রাস্তা ডান দিকে বেঁকে গিয়েছিল। ঘুরে আসা যাক একটু সেই পথ থেকে। পথের ধারে চোখে পড়ল কয়েকশো পাথরের ফর্মেশন, কাঠামোগুলো খুবই ভঙ্গুর স্যান্ডস্টোনের। এগুলি হল আরোহীদের স্বর্গ। কিছুটা উঠলাম, কিন্তু আমার দ্বারা সম্ভব নয়। অনেকেই এই ফর্মেশনগুলির মাথায় উঠেই ভীষণ আনন্দিত। আমি তাদের আনন্দ দেখেই আনন্দ পেলাম। তাদের জয়োল্লাস পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম সামনে। ন্যাশনাল পার্কের একদম শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। পাহাড়ের একটি রিজের উপর রয়েছে একটি প্রাচীন দুর্গ। তারপরেই অতল খাদ। দুর্গটি বেশ প্রাচীন তবে এখনো ভগ্নস্তূপ হয়ে যায়নি। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের ফলে এখনো এটি জার্মানির বৃহত্তম অখন্ড দুর্গ। প্রাশিয়ান সাম্রাজ্যে এখানে একটি কারাগার এবং হাসপাতাল বানানো হয়েছিল। জার্মানির প্রাচীন ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। ইতিহাস প্রেমীদের কাছে অতি উৎসাহের স্থল এটি। এরপর ফেরার পালা কিন্তু ফেরার পথে অনেক কিছু দেখার আছে একটু অন্য পথে ফিরছি। পাহাড় থেকে নেমে হাঁটা পথে এলব্ নদী পেরিয়ে দক্ষিণাংশে অরণ্যের মাঝে একটি খোলা জায়গায় এলাম, নাম ল্যাবিরিন্থ। ল্যাবিরিন্থ পাজল এর মত করে লাগানো ছোট গাছে ঘেরা জায়গা। কিন্তু এটা রক ল্যাবিরিন্থ, অর্থাৎ এখানে রককলামগুলি ভুলভুলাইয়া রচনা করেছে। প্রাগ অর্থাৎ প্রতিবেশী চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানীর বোহেমিয়ান সুইজারল্যান্ডেই কিন্তু The Chronicles of Narnia সিনেমাটির কিছু শ্যুটিং হয়েছিল। আর এই জায়গাটাও অনেকটাই তেমন, নাতিদীর্ঘ রককলাম ও প্রাকৃতিক গুহা সমৃদ্ধ। এখানে এলে যেন মন হারিয়ে যেতে চায় শৈশবের ক্রীড়া ভূমিতে। দেখলাম কচিকাঁচা নিয়ে বেশকিছু জার্মান পরিবার এখানে সপ্তাহান্তে সময় কাটাতে আসেন। বৃদ্ধরা খোলা জায়গায় সতরঞ্চি পেতে অল্প আওয়াজে গান শুনছেন হোক না সে জার্মান ভাষা তার মায়াবী সুরে মন হালকা হয়ে যায়। যুবকেরা রক কলামগুলোতে ওঠার চেষ্টা করছে। মেয়েরা কেউ কেউ রান্নায় হাত লাগিয়েছে আবার কেউ লন টেনিস খেলছে। শিশুরা গুহা গুলিতে লুকোচুরি খেলছে আপন মনে। আমাকে সেখানে দাঁড়াতে দেখে একজন কাছে ডাকলেন। ভাঙা ইংরেজিতে বললেন আমি যেন তাদের সঙ্গে সময় কাটাই। এভাবে আতিথেয়তা পেয়ে আমিতো আপ্লুত। কিছুটা সময় বাচ্চাদের সাথে লুকোচুরি খেললাম, কিছুটা সময় লন টেনিস, আবার রান্না করাও দেখলাম কিছুক্ষণ। অপূর্ব দক্ষতায় নিজেরাই তৈরি করছেন বার্গার, নুডুলস, সসেজ ইত্যাদি। খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ কয়েকজন আমাকে বললেন কাছেই লিচেনহাইন জলপ্রপাত রয়েছে। সেটা দেখিয়ে আনবে, ওরা নিজেরাও দেখবে। অগত্যা ওদের সঙ্গে চললাম। বৃদ্ধদের থেকে বিদায় নিলাম কারণ আমি আর এই পথে ফিরবো না। একজনের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওর নাম শাভি মেকিঞ্জ। ছেলেটি আমার বয়সীই হবে। বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছে। বিষয়ে মিল বলে আমাদেরও বেশ মিল হয়ে গেল। একসাথে গাছ চিনতে চিনতে হাঁটছি। এখানকার ফ্লোরাগুলি সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের ফ্লোরার সাথে মিলে যায়। যদিও ভূখণ্ড আলাদা হওয়ায় তাদের প্রজাতিও আলাদা। , দের চিনতে পারলেও আমার বন্ধু আমাকে তাদের প্রজাতি চিনিয়ে দেয়। যা আসলে একটি বিশেষ প্রজাতির চিরতা, তার বেগুনি ফ্রেমে নীল বেগুনি সুতো দিয়ে কেউ যেন সেলাইয়ের নকশা তুলেছে। সবুজ ঘন অরণ্যের পথে চলতে গিয়ে দেখি ম্যাজেন্টা রঙে ছেয়ে আছে র ফুলগুলি। , এর মত বিপন্ন ফার্ণগুলিও তাদের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বড় বড় ওক গাছগুলিকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। দেখা না গেলেও শোনা গেল রেড ডিয়ারের ডাক। হয়তো কোন গাছের আড়াল থেকে সে আমাদের দেখতে পাচ্ছে। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর শোনা গেল জলপ্রপাতের গর্জন। ঝিঁঝিঁ ডাকা নিস্তব্ধতাকে খান খান করে কুশটাল রকের ওপর নিজেকে মেলে ধরেছে পাহাড়ি কন্যা ঝর্ণা। সাময়িক বিরতিতে সে ঝর্নার রুপোলী জলধারা দেখে মনে পড়ে গেল ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ঝর্না কবিতাটি। আমার জার্মান বন্ধুদের বোঝার সুবিধার্থে চেষ্টা করলাম তাকে ইংরাজী ভাবানুবাদ করতে –
Fountain fountain beautiful fountain
Silvery stream flows from the mountain
White sandstones turn into saffron
Blue Gentians bloom at the bottom
To see the youthful beauty of Lichtenhain
I can hike through this hilly terrain.
সবাই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে। ওদের ভালো লাগার অনুভুতি কে হাসির বিনিময়ে সম্মান জানালাম। এরপর ওরাই আমাকে ট্রামে উঠিয়ে দিল। বিদায় জানালাম ওদের। এই ট্রামওয়ে বিস্তৃত হয়েছে অরণ্যের মধ্য দিয়ে কির্নিচ নদী উপত্যকায়। অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে খুব শীঘ্রই পৌঁছে গেলাম বাডশ্যানডৌ গ্রামে। যাত্রাপথটা আরও দীর্ঘ হলে যেন বেশী ভালো হত। আজ এই গ্রামেই রাত্রিযাপন হবে।
(ক্রমশঃ)
©✍ সায়ন্তন ধর
২৯/০৮/২০২১