উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জন লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী

উপন্যাসের নাম- চৌধুরী বাড়ির ঘট বিসর্জন
লেখিকার নাম- বাবিয়া নন্দী
ধারাবাহিক
সপ্তম পর্ব (৭)

সত্য সেদিন সন্ধ্যের প্রহর গোনার সাথে সাথেই তাঁর মাথায় একটি কৌশল উপস্থিত হল।আগেই বলেছিলাম সত্য ছোটো বেলা থেকেই ভীষণ স্বাধীনচেতা ও রোমাঞ্চকর প্রকৃতির মানুষ।সে একদমই প্রাচীনপন্থায় বিশ্বাসী নয়।ভীষণ পরিমাণে আধুনিক।তবে সে নারীজাতীকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করে।সে নারীদের শিক্ষাদীক্ষা ও আধুনিকতা এবং তাদেরও যে সমাজে একজন পুরুষের ন্যায় সমান অধিকার আছে সে এমন পন্থাতেই বিশ্বাসী।সত্য পারে না কোনো অযথা কোনো নারীর প্রতি অত্যাচার সহ্য করতে।তাই সে সেই মুহুর্তে স্থির করলো বাবার কর্তব্য ও পরিবারের পূজোর দায়িত্ব পালনও সে করবে,উপরন্তু মেয়েটি কে কেন কারা জোর করে এই নরকের পথে তাঁর অনিচ্ছাকৃত ঠেলে দিচ্ছে সেটাও তাকে জানতেই হবে।আর জানবার একমাত্র উপায় হল,সেই মহল্যায় আরও পাঁচজন বিপথগামী পুরুষের ন্যায় ওই পল্লীর খরিদ্দার রূপে যাওয়া।এছাড়াও হয়তো বিশেষ কোনো কারণ ছিলো,পতঙ্গ যেমন ক্রমশ আগুনের দিকে ধাবিত হয়,হয়তো সেই জন্যই ওই স্থানটি বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করছিলো সত্যব্রত কে।কিন্তু কিছু আগুন মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়,আবার কিছু আগুনে তো যজ্ঞেরও আহুতি দেওয়া হয়।আগুন জিনিষ টা একদিকে যেমন প্রাণসংশয় ঘটায়,অপরদিকে তেমনিই ভীষণ পবিত্রতার প্রতীক।আর আগের দিন রাত্রিকালে সেই অচেনা মেয়েটি অচেনা পুরুষটির কাছে যেভাবে লাঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছিলো এরপর তাঁকে তো আজ আর ছেড়ে দিলে চলবে না।নইলে তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে তাঁর সাথে।তাই সত্যকেই এখন তার রক্ষাকবচ হোতে হবে।সত্য পরক্ষণেই ভাবতে লাগলো,আচ্ছা ওই মেয়েটির বদলে যদি অন্য কোনো মেয়ে হোতো,তাহলেও কি সত্য তাঁকে বাঁচানোর জন্য এতোটা ব্যাকুল হয়ে উঠতো।সে এবার নিজের বিবেক কে প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দিলো।

উত্তর এলো না,শুধু বারবার সত্যর মনে হোতে লাগলো,ওই দুটো নিষ্পাপ টানাটানা সারল্যে পরিপূর্ণ চোখ,যাকে সে সূদুর কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করা অবধি নিজের হৃদয়পটে তিলতিল করে দেবী প্রতিমার মতোন রং তুলি দিয়ে গড়েছে তাঁর গঠন,চাহনি,মুখায়বয়ব,সর্বোপরী তাঁর স্নিগ্ধতা ও পবিত্রতায় গড়া একটি নারীমূর্তি,যাকে পেলে প্রতিটি পুরুষই ধন্য হয়ে যায়।যাকে একবার মাত্র দেখলে এক লহমায় ভুলে থাকা যায় সারা বিশ্ব প্রকৃতি সব কিছু।এতোটা সাদৃশ্য কি করে হয় সত্যের হৃদয়ে কল্পনায় গড়ে তোলা মানবীর সাথে এই তনয়ার?সত্যর কেন জানি না আগের দিন রাত্রিতেই মনে হয়েছিলো,না ওই দুটো চোখ কোনো পাপ করতেই পারে না।সে সম্পূর্ণ ভূল স্থানে এসে পড়েছে।কেন জানি না তার আরও মনে হয়েছিলো এই নারীর সাথে যেন তার শুধু এ জন্মেই না জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। যে সত্য কখনও জন্মাতরে বিশ্বাস করে না,সেই মুহুর্তে তার এমন টাই মনে হয়েছিলো।যেন কোনো অদৃশ্য বন্ধন তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিলো।তাই সে ওই মহল্যায় যখন ঢুকলো,তখন প্রায় সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।সেখানকার সমস্ত মেয়েরা নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার দরদাম করতে ব্যস্ত।সকলেরই পরণে রঙ্গীন বসন,মুখে ঠোঁটে রক্তিম রঙ্গে রাঙ্গানো কৃত্রিমতার আবেশ।সকলে ই নিজেদের খরিদ্দার খোঁজায় ব্যস্ত।এদিকে সত্যের দু চোখ অনুসন্ধান করছে আগের দিনের সেই রমনী কে।কই,সে তো এখানে নেই।আসবেই বা কেন?সে যে সবার থেকে আলাদা।আর সকলের সাথে তার যেন কোনো তুলনাই চলে না।অবশেষে সে পুরোপুরি ঢুকে পড়লো সেই মহল্যার কোঠা তে।সেখানে সত্য দেখতে পেল একটি মধ্যম বয়সী মহিলা রঙচঙে সাজে নিজেকে সজ্জিত করে একটি কেদারায় প্রায় অর্ধশায়িত হয়ে পাশের আরও পাঁচজন নারীদের হিন্দী ও কিসব ভাষায় যেন উপদেশ দিচ্ছেন।আর মধ্যে মধ্যে পাশের পিকদানীতে পানের পিক ফেলছেন।সত্য কে দেখে সে বললো,”কয়া সাব,আজ তো ম্যাহেফিল সাব খাতাম হয়ে গেছে।তো আর কি হবেক?হিহি:।”সত্য অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাঁকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে কিছু বলতে উদ্যত হবে এমনি সময়ে সেই মহিলা টি নিজেই আবার বলে উঠলো”ওহ হো রুপাইয়া লে আয়া কা হে?লড়কি চাহিয়ে তো বোল দিজিয়ে।কাভী হামপে ভী তো মহেরবান কিজিয়ে।খুদা নে বহুত খুবী সে হি মর্দ জাত কো বানায়া হ্যায়।তো ক্যা হ্যায় শরম।আপ লোগ সারাব অওর অওরাথ জিসম কী লালচী হো,অওর হাম লোগ নোটো কি।”বলে নিজেই একদফা অতি কুৎসিত হাসি হেসে নিলো আশেপাশের মেয়েদের গায়ে ঢলে।”ক্যা আব মুঝে কিউ ঘুর রহে হো সাব,হম তো বুঢ্ঢি হো চুকে হ্যা।ওহ এক তর থা জাব পিয়ারী বাঈ কে লিয়ে হাজারো লোগ মারতে থে।আজ দেখো হাম ইয়া পে শেঠনী কে তর মেঁ ব্যায়েঠ গয়ে।”সত্য বুঝতে পারলো এই মহিলার নাম আসলে পিয়ারী বাঈ। আর ইনি শুধু টাকার লোভী।টাকা পেলে মোটামুটি সব কাজই করে দেবে।তাই সত্য আধা বাংলা ও হিন্দীর মিশ্রণে পিয়ারী বাঈ কে আদা জানিয়ে বললো “হামে সাব লড়কি দিখায়ো। জারা হাম ভি দেখে ক্যায়া লড়কি আপ কি হেফাজাত পে হ্যা।” পিয়ারী বাঈ বললো “লরকি একদাম সে খাস আয়ি হ্যায় বঙ্গাল সে,তো চার মাহিনা ভি হো চুকে,লেকিন উসকি হিচখিচানে নাহি জাতে সাব।বহুত জিদ্দি হ্যায়।পার মাল একদম জব্বর হ্যায়।” সত্য মনে মনে ভাবলো সত্যি পিয়ারী বাঈ কি সুন্দর অকপটে একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ে কে অম্লান বদনে মাল বলে সম্বোধন করছে।পিয়ারী বাঈ তখন সমস্ত কোঠার মেয়েদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো।আর বললো” দেখো নাজরানা সাব।সাব লরকি হি খাস হ্যায়।”মেয়ে গুলোকে দেখেই বোঝা গেলো এরা নিজেদের নিলামে চড়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।সত্যিই!ঈশ্বরের কি বিচার!কি তার লীলা!এ কি নিষ্ঠুর পরিহাস।কিন্তু সব মেয়েকে ছেড়ে সত্যর চোখে খুঁজতে লাগলো তাঁকে যার জন্য সে কালনাগিনীর লেজে পা দিয়েছে,যেখানে তার প্রাণসংশয় হলেও হোতে পারে।কই সে রমনী?সে কি এদের মাঝে নিজেকে কোনোক্রমে লুকিয়ে রেখেছে।সত্য ব্যাকুল নয়নে চারিপাশ অনুসন্ধান করে চললো।

ক্রমশ (চলবে)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *