তীর্থের পথে পথে — কোয়েলী ঘোষ
তীর্থের পথে পথে —
কোয়েলী ঘোষ
অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম যাব । সেদিন দুর্গাপুজোর অষ্টমী । প্রেমমন্দির আশ্রম থেকে ফেরার পথে প্রদীপবাবু বললেন – চলুন দাদা , আজ মায়ের মন্দিরটা ঘুরে আসি ।পথে যেতে যেতে দেখবেন আর এক মন্দির – গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি ।আমি তৎক্ষণাৎ রাজি । মহানন্দে কোন্নগর ফেরিঘাট থেকে আমরা চেপেছি লঞ্চে ।
গঙ্গার ওপর দিয়ে এই যাত্রা পথ অতি মনোরম । চারিদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাই এপার – ওপার । শরতের সোনা রোদে ঝিকমিক করছে গঙ্গার জল , নৌকোর মত মন ভেসে যায় —
লঞ্চ এসে থামে পানিহাটি ঘাটে । এখান থেকে অটো , টোটো সবই পাওয়া যায় কিন্তু পায়ে হাঁটলে যা দেখা যায় , অটো চাপলে তা দেখা যায় না ।সুতরাং ডানদিকের হাঁটা পথ ধরি ।
একদিকে গঙ্গার ঘাট , গাছ পালা ,ঘর বাড়ি দেখতে দেখতে পথ চলি । এই পথের ধুলো খুব পবিত্র ।শ্রী চৈতন্যদেব , নিত্যানন্দ মহাপ্রভু , শ্রীরামকৃষ্ণ – কত না পদধূলি মিশে আছে এই পথে । যেতে যেতে পথে দূর থেকে দেখা গেল এক সুন্দর মন্দিরের চূড়া , গিরিবালা ঠাকুর বাড়ির চূড়া । সামনের দিকে গেট পেরিয়ে জরাজীর্ণ এক প্রাসাদ । ক্ষয়ে ক্ষয়ে কঙ্কালসার চেহারা । ভেতরে গজিয়েছে কত গাছ । একদিন এটাই নাকি ছিল নীলকর সাহেবদের নীল কুঠি ।
একদিকে বয়ে চলেছে গঙ্গা । সোজা এগিয়ে প্রবেশ পথ । ফলকে লেখা ১৩১৮ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৯১২ খ্রীস্টাব্দে) ১৮ইজ্যৈষ্ঠ । তাহলে ঠিক কত পুরনো মন্দির – ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি । ডানদিকে ভোলানন্দ গিরি মহারাজ আর তাঁর শিষ্য শিবানন্দ গিরি মহারাজের প্রতিকৃতি , দেওয়ালের ওপরে শ্রীরামকৃষ্ণ আর শ্রীম মহেন্দ্র চন্দ্র গুপ্তর ছবি । হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে প্রবেশ করি মন্দির প্রাঙ্গণে ।
এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাণী রাসমণির নাম । বাবু রাজচন্দ্র দাস এবং রাণী রাসমণির চারটি কন্যা , পদ্মমণি,কুমারী, করুণাময়ী এবং জগদম্বা। পদ্মমণির বিয়ে হয় শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র দাসের সাথে । তাঁদের সন্তান গণেশচন্দ্রের পুত্র গোপালচন্দ্র , আর পুত্রবধূ ছিলেন গিরিবালা দাসী।গিরিবালা দাসী , রাণী রাসমণির নাতবউ।তিনিই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ।
আগরপাড়ায় প্রায় এক বিঘা মত জমি কিনে প্রায় ৩.৪ লক্ষ টাকা খরচ করে শ্রী রাধাগোবিন্দ জিউ-র পঞ্চরত্ন মন্দির , ছয়টি আটচালা শিব মন্দির,নাটমন্দির,গঙ্গার ঘাট এবং চাঁদনি নির্মাণ করেন।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি এই মন্দিরের মাথায় রয়েছে পাঁচটি চূড়া। মন্দিরের চূড়া ও গাত্রে স্ট্যাকোর কারুকার্য। মন্দিরের সামনে রয়েছে নাটমন্দির। মন্দিরে ওঠার সিঁড়ির দুপাশে দুই স্তম্ভের ওপর দুটি পাথরের নারী মূর্তির বাতিস্তম্ভ । নাটমন্দিরের বাঁহাতে রয়েছে দ্বিতল নহবতখানা, এটি স্বামী শিবানন্দগিরি মহারাজের বিশ্রামস্থল।
সামনে নাটমন্দিরে তখন দেবী দুর্গার অষ্টমীর পুজো সমাপ্ত । সামনে চেয়ার পেতে বসি । মায়ের অপরূপ মূর্তি , সুন্দর ডাকের সাজ । প্রাচীন থামের ওপর কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই । সাজানো পরিচ্ছন্ন ফুলের গাছে নানা রকম ফুল ফুটে আছে ।তারপর সামনের মন্দিরের দরজা খোলে ।সিঁড়ি পেরিয়ে গিয়ে দর্শন করি প্রিয় দেবতার ।
গর্ভগৃহে সিংহাসনের ওপর শ্রীকৃষ্ণেরকষ্টিপাথরের বিগ্রহ এবং অষ্টধাতুর শ্রীরাধিকা উপবিষ্ট ।কি মধুর রুপ ।
নিচে আছে আনন্দময়ী মায়ের ছবি , শালগ্রাম ও গোপাল ।
কিছুক্ষণ বসে থাকি নির্জন শান্ত এই পরিবেশে ।এই রুপ দেখে যেন আঁখি না ফেরে —
“জনম অবধি হাম রুপ নেহারলুঁ –
নয়ন না তিরপিত ভেল।
সোই মধুর বোল শ্রবনহি শুনলু
শ্রুতিপথে পরশ না গেল।
কত মধু যামিনী – রভসে গোঁয়াইলু
না বুঝলু কৈছন কেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখঁলু
তবু হিয়া জুড়ন না গেল ।।”
আমার আরাধ্য দেবতাকে বারবার প্রণাম জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি । দেখি ছয়টি শিবমন্দির পাশাপাশি আছে । নাম গোপেশ্বর,গিরিশ্বর,তারকেশ্বর,রামেশ্বর,ভুবনেশ্বর ,গিরিশ্বর।প্রতিটি শিবমন্দিরের গায়ে রাধাকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলার ছবি আঁকা । কামেশ্বর মন্দিরে যুগল মিলন, রামেশ্বর মন্দিরে মথুরানাথ, গোপেশ্বর মন্দিরে গোষ্টলীলা, তারকেশ্বর মন্দিরে অনন্তশয়ান, ভুবনেশ্বর মন্দিরে রাইমিলন ও গিরিশ্বর মন্দিরে কালিয়াদমনের চিত্র আঁকা।চাঁদনির ওপর গণেশজননীর এক অপূর্ব মূর্তি ।মন ভরে গেল এই মন্দির দর্শনে ।
মন্দিরে নিত্য পুজা আর নিত্য ভোগ হয় আর জন্মাষ্টমী,রাধাষ্টমী,ঝুলন,চাঁচর এবং দোল উৎসব সমারোহে পালিত হয় । প্রণাম জানিয়ে গেট পেরিয়ে আবার আমাদের হাঁটা শুরু ।
আর পাঁচ মিনিট হাঁটলেই আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমের দর্শন পাওয়া যাবে ।
এই মন্দিরে আসতে হলে শিয়ালদা লাইনে আগরপাড়া স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো করে আসা সুবিধেজনক হবে ।
চলবে ..