পরিণতি —- মীনা দে
পরিণতি
মীনা দে
খুব মনে পড়ে সেই বিকেলটার কথা।
সেই যে পুজো পুজো গন্ধ!
ওটা বোধ হয় নতুন জামা কাপড়ের আর শিউলি ফুলের গন্ধ।
কথা ছিল দেখা করার।
আমার পৌঁছতে যথারীতি দেরী,
বললাম, রাগ হচ্ছে— খুউব?
তুমি বললে, ওটা তো গা সওয়া হয়ে গেছে।
চলো, আজ কোথায় বসবে বলো?
এখন বসব না হাঁটি চলো।
না, না তোমার পা ব্যথা করবে।
ওরে বাবা! আমার জন্যে দরদ উথলে উঠছে!
পরে থাকবে তো?
তুমি তোমার চেনা ভঙ্গিতে হাতটা নাড়লে,
মুখে মৃদু হাসি।
কী যে ভালো লাগতো তখন!
আমি বললাম,চলো ফুচকা খাই।
তুমি বললে,কেন রেস্টুরেন্টে যাবে না?
হ্যাঁ যাব, আগে ফুচকা।
তুমি ঝাল একদম খেতে পারতে না।
কিন্তু তবু হু হা করেও খেলে।
তখন তো আমি যা বলতাম শুনতে।
এখন কত বদলে গিয়েছ—-
এখন একটু ঝাল লাগলে খাওয়া ছেড়ে উঠে যাও।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমার ভেতরের মানুষটা সম্পূ্র্ণ অন্য।
যদিও তোমার কথা মতো আমিও নাকি—-
হবে হয়তো!!
সেই গঙ্গার ধার এখনও আছে,
কিন্তু আমরা আর যাই না।
পার্কের সেই বেঞ্চটা এখনও আছে। আমরা আর গিয়ে বসি না।
রেস্টুরেন্ট আছে, কিন্তু আমরা বাড়ির খাবার খেতেই বেশি ভালোবাসি।
কথারা সব বুকে জমা হয় কিন্তু,
আমরা দরকারী কথা ছাড়া বলি না।
ভালোবাসা কথাটা শুনি কিন্তু ,
আমরা আর বিশ্বাস করি না।
এ কোন পথে চলেছি
মীনা দে
বর্তমান সমাজের যে রূপ আমরা দেখছি এবং যা আমাদের প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তুলছে তাতে বহু দিন আগে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার একটা লাইন বার বার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে। তখনকার সমাজের যে রূপটা দেখে তিনি লিখেছিলেন, “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব”। এখন এতদিন পরেও সেই কথাটা সমান প্রাসঙ্গিক নয় কি? তার কিছু কি পরিবর্তন হয়েছে? পরিবর্তন যদি হয়ে থাকে তবে তা আরও বৃহদাকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলে আমরা তা বেশ বুঝতে পারি।
আজকাল চারিদিকে যা ঘটছে তাকে কি মানব সভ্যতা বলা যায়? যায় না। বরং সেই জায়গা নিয়েছে নিষ্ঠুর অমানবিকতা । মানবিকতা সমাজকে সুন্দর করে , পরিচ্ছন্ন করে , নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার পথ প্রশস্ত করে। কলুষিত করে না। কিন্তু দানবতা ঠিক তার উল্টৌ। আর সেটাই আমরা বর্তমান সমাজে রাষ্ট্রে দেখতে পাচ্ছি। বুদ্ধি, বিবেচনা , চিন্তাশক্তির জন্য মানুষ এই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু এখন গুহামানব যুগে যে হিংস্রতা ছিল তাই আবার মাথাচারা দিচ্ছে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মনুষ্য সমাজ আজ অনেক উন্নত। মানুষ এখন দূরকে এনেছে নিকটে। আকাশের চাঁদ, যা ছিল মানুষের কাছে পরম বিষ্ময় , তা এখন যেন আয়ত্বের মধ্যে। ইন্টারনেট ব্যবস্থা সমস্ত বিশ্বকে আজ যেন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ঘরে বসেই মানুষ বহু দূরের জিনিষও দেখতে পাচ্ছে অনায়াসে। দূরের মানুষের সঙ্গে অনায়াসে ভাব বিনিময়ের সুযোগ পাচ্ছে। এতসব হয়েও মানুষ কিন্তু সেই আদিম যুগের মানসিকতাকে এখনও বহন করে চলেছে। আসলে যত নতুন নতুন জিনিষ আবিষ্কার হচ্ছে, তত সেগুলোকে সৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চাইতেও অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতা ভীষণ ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সুসভ্য মানুষই লোভ লালসা প্রতিহিংসার আগুনে সমাজকে কলুষিত করছে। প্রতিদিন নতুন নতুন পদ্ধতিতে খুন , রাহাজানি,ধর্ষণ, ইত্যাদি আরও কত কুকর্মে লিপ্ত হচ্ছে এই দানবরূপী মানবেরা । মনুষ্য সমাজে হিংসার প্রভাব পড়তে আগেও দেখা গেছে। যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ হতে হয়েছিল। রাজ্য জয়ের জন্য রাজারাও পরস্পর কম হিংসায় উন্মত্ত হন নি। ঘটেছে হিরোসিমা নাগাসাকির মতো অমানবিক জঘন্য ঘটনা। কিন্তু সেসব ঘটার পেছনে কোন কারণ ছিল। সমাজ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেও এসেছে। কিন্তু এখন হিংসা জন্ম দিচ্ছে প্রতিহিংসার যা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। যত নতুন নতুন জিনিষের আবির্ভাব হচ্ছে মানুষের চাহিদাও তত আকাশচুম্বী হচ্ছে। লোভ লালসা হিংসাও তত বাড়ছে। এখন সৎ বুদ্ধির জায়গায় অসৎ বুদ্ধির প্রয়োগ যেন খুব বেশি বেশি হচ্ছে। পুত্রের হাতে পিতা খুন হচ্ছে ভাইএর হাতে ভাই এমন কি ছোট ছোট শিশুদের মেরে ফেলতেও মানুষের হাত এতটুকুও কাঁপছে না। মানুষ তো এমন করতো যখন সভ্যতার আলোকের মুখোমুখি হয়নি তখন। সেই সময় পশুতে আর মানুষে কোন প্রভেদ ছিল না। কিন্তু সামাজিক বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ নিজেই সভ্য সমাজ গঠন করেছে , তাকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালিতও করেছে কিন্তু তাহলে এখন কেন আবার সেই পশু প্রবৃত্তি সেই হিংসা মানুষের মধ্যে মাথাচারা দিচ্ছে!এখন যা সব ঘটনা ঘটছে তাতে মানুষ আতঙ্কিত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। প্রতিপদে ভয় নামক একটা ভীষণ জন্ত মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। মানুষের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। মানবতা আজ দানবতার কাছে পরাজিত। কে বোঝাবে যে হিংসা নয় ভালবাসাই প্রকৃত ধর্ম
মানুষ যেমন দানব হতে পারে মানুষই তেমনই দেবদাতাও হতে পারে। সংখ্যায় কম হলেও এমন দেবতুল্য কিছু মানুষও আছেন কিন্তু নানান কারণে তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান। কবে আসবে সেই দিন যেদিন মানুষের মন থেকে সব হিংসা দূর হয়ে গিয়ে দয়া মায়া মমতা ভালবাসায় অন্তর ভরে উঠবে , আর আমরা দেখতে পাব একটা সুপরিচালিত সমাজ যেখানে নাই রে হিংসা নাই রে ভয় আমরা করব জয়। এই সংকল্প নিয়ে সমগ্র সমাজ এগিয়ে যাবে একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।