~ ঘটি – বাঙালের দ্বৈরথের (ডার্বি) শতবর্ষ ~ — বিতান গুপ্ত।
~ ঘটি – বাঙালের দ্বৈরথের (ডার্বি) শতবর্ষ ~
— বিতান গুপ্ত।
‘বাঙালীর সব খেলার সেরা খেলা ফুটবল’ — জনপ্রিয় গানের কথাগুলো সত্যি হয়ে ওঠার আগের ইতিহাসটা জানা দরকার। জানা দরকার বাঙালী কবে ফুটবল খেলতে শিখলো। কার একান্ত আগ্রহ এবং প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে বাঙলায় ফুটবল খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং সত্তরের দশকে বাঙলার ফুটবলের স্বর্ণময় যুগ এসেছিল। ভারতীয় ফুটবলে আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া লেগেছিল।
তিনি নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী – বাঙলার খেলাধুলার জগতে ফুটবল খেলা প্রচলনের অদ্বিতীয় প্রাণপুরুষ। ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসকদের নীচু মনোভাবের জবাব দিতে তিনি তৈরী করেন বিখ্যাত শোভাবাজার ক্লাব এবং সমস্ত শ্রেণীর, ধর্মের মানুষের জন্য ক্লাবের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়ে সংকীর্ণ বর্ণবৈষম্যবাদী ব্রিটিশদের সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন। সেই বছরই একমাত্র দেশীয় ফুটবল দল শোভাবাজার ক্লাব ট্রেডস কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। সেই তখন থেকেই বাঙালীর ফুটবল খেলা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো শহর থেকে মফস্বল হয়ে গ্রামে গঞ্জে। শোভাবাজার ক্লাবের পরে গড়ে ওঠে মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব, ইস্টবেঙ্গল এবং মহামেডান স্পোর্টিং।
নগেন্দ্রপ্রসাদের সাথে স্বামী বিবেকানন্দের সুসম্পর্ক ছিলো। নগেন্দ্রপ্রসাদের দলের খেলা দেখতে স্বামীজী মাঠেও যেতেন। শোনা যায় সেই সময়ের প্রাণবন্ত যুবদলের ফুটবল খেলা দেখে তিনি বলেন, “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌছানো সম্ভব।”
খেলার মাঠ থেকেই নগেন্দ্রপ্রসাদ তাঁর নিজস্বতায় জাতিয়তাবোধের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। নানা বাধা বিঘ্নকে দূরে ঠেলে নিজের পরিশ্রমে ফুটবল খেলাকে জনপ্রিয় করে গেছেন। তারই ফলশ্রুতি বলা যায় আজকের ভারতবর্ষের আধুনিক ফুটবল বা তারও আগের সত্তরের দশকে বাঙলার ফুটবলের স্বর্ণময় যুগ।
ইংল্যান্ডের সারে কাউন্টির (অঞ্চল/এলাকা) অন্তর্গত এপসম শহরটি অবস্থিত। এই এপসম শহরে “ডার্বি” শুরু হয় – ঘোড়দৌড়।
এপসম শহরের প্রচলিত লোককথায় একজন “আর্ল”(Earl = সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি) হঠাৎই কোনো একদিন এই শহরে শুরু করেছিলেন তিন বছর বয়সী ঘোড়াদের দৌড়। তিনি সেদিন তাঁর বন্ধুদেরকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ডিনার পার্টিতে। সেই সম্ভ্রান্ত EARL সাহেব সেই ঘোড়দৌড় সহ সেদিনের ডিনার পার্টির নাম দেন “The Derby”.
পরবর্তীকালে ডার্বি শব্দটি অন্যান্য খেলার সাথেও যুক্ত হয়। আবার একই শহরের জনপ্রিয় দুটি দলের খেলা অনুষ্ঠিত হলে তাকেও “ডার্বি” বলা হয়। যেমন ম্যানচেস্টার সিটি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ; আটলাটিকো মাদ্রিদ ও রিয়াল মাদ্রিদ।
ঠিক সেইভাবেই ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের দ্বৈরথকে বলা হয়ে থাকে “ডার্বি ম্যাচ”। তবে ফুটবলকে ঘিরে কলকাতার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবের এই দ্বৈরথ বা মহারনের ঘনঘটার একশো বছরের ইতিহাসের পিছনে রয়েছে আরেকটি বিষয় – ‘ঘটি-বাঙাল’এর রেষারেষি।রাজনীতির করাল ছায়া হয়তো দেশভাগ করেছে – বিভাজনের সীমান্তরেখা গড়ে উঠেছে। কিন্তু ভাগ হয়ে যায়নি বাঙাল-ঘটির জীবন-জীবিকা, মেলামেশা, সংস্কৃতি বা পরিধেয় পোশাক। মিল এতটাই যে অমিলগুলো আণুবীক্ষনিক।
ভিন্ন মতে ঘটি-বাঙালের বিভেদটা নদীর বিভাজনে।গঙ্গাপাড়ের ঘটি ও পদ্মাপাড়ের বাঙাল।
ঘটিরা হলো গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের মানুষ। আর বাঙালরা গঙ্গার পূর্ব পাড়ের এবং তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিও আছে। কলকাতার ফুটবলে ‘মোহনবাগান’ ঘটিদের পছন্দের টিম। আর ‘ইস্টবেঙ্গল’ হলো বাঙালদের আবেগে গড়ে ওঠা ক্লাব।
১৯৯৭ সালে ফেডারেশন কাপ ফাইনালে এই দুই ক্লাবের খেলা ম্যাচগুলো প্রথমবার আখ্যায়িত হয় “ডার্বি” নামে। শুধু ভারতবর্ষে নয়। এই দুই শতাব্দী প্রাচীন ক্লাবের মহারন এশিয়া মহাদেশেও প্রাচীনতম।
সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবলের মক্কা সল্টলেক স্টেডিয়াম বা যুবভারতী ক্রিড়াঙ্গন থেকে ব্যারিটোন গলায় ধারাবিবরনী দিতেন অজয় বসু, “নমস্কার, যুবভারতী ক্রিড়াঙ্গন থেকে অজয় বসু বলছি। সাথে আছে পুষ্পেন সরকার, কমল ভট্টাচার্য্য।”
১৯৭২ সালে প্রথমবার ধারাবিবরনী দিতে অজয় বসুর সাথে যোগ দিয়েছিলেন আরেক কিংবদন্তী ধারাভাষ্যকার সুকুমার সমাজপতি মহাশয়। সেই ধারভাষ্যে ভেসে উঠতো মাঠসহ গোটা স্টেডিয়াম। রেডিওয় কান পেতে উত্তেজনাপূর্ণ ডার্বি ম্যাচের ধারাবিবরনী দেওয়া অজয় বসু, সুকুমার সমাজপতিদের ধারাভাষ্য শুনে নিজেকে মাঠের ভিতরেরই একজন দর্শক বলে মনে করতেন আপামর বাঙালী।
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন বা সল্টলেক স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামই বছরের পর বছর দেখেছে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আবেগের সেই লড়াইয়ে কখনও রক্তাক্ত হয়েছে মাঠ। কখনও বা গ্যালারি। ২০১১-র আগে এই স্টেডিয়ামে ১ লাখ ২০ হাজার দর্শকের বসার জায়গা ছিল। পরে সেটা কমিয়ে করা হয় ৮৫ হাজার। এই স্টেডিয়ামে ১৯৯৭ সালের একটি ডার্বি ম্যাচে সবচেয়ে বেশি দর্শক হয়েছিল। প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার। ১৯৮৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ফুটবলের নানা ওঠাপড়া দেখেছে এই স্টেডিয়াম।
প্রাসঙ্গিক হবে বলে রাখা – ১৮৮৮ সালে ভারতের তৎকালীন বিদেশ সচিব মর্টিমার ডুরান্ড কর্তৃক শিমলায় ডুরান্ড কাপ চালু হয় – ভারতবর্ষের প্রাচীনতম টুর্নামেন্ট। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় চালু হয় আই.এফ.এ শিল্ড। সেই সময় থেকেই কলকাতা হয়ে ওঠে ভারতীয় ফুটবলের পীঠস্থান।
এইবছর ২০২১ সাল পূর্ণ করলো ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের ডার্বি ম্যাচ খেলার শতবর্ষ ।
শতবর্ষ আগে ১৯২১ সালে প্রথমবার লড়েছিল ভারতবর্ষের সর্বাধিক জনপ্রিয় এই দুটো ক্লাব।
দিনটা ছিল ৮ই আগস্ট,১৯২১। কোচবিহার কাপের খেলা। সেই খেলা গোলশূন্য হলেও রিপ্লে ম্যাচে মোহনবাগান জেতে ৩-০ গোলে।
বিগত ১০০ বছরের ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে ৩৭৩ বার। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব জিতেছে ১২৯ বার। মোহনবাগান ক্লাব জিতেছে ১২২ বার। আর খেলা অমীমাংসিত থেকেছে ১২২ বার। দেশে-বিদেশে ইস্টবেঙ্গলের প্রাপ্তির ঝুলি ১২৯ টি ট্রফি। আর মোহনবাগানের প্রাপ্তি ১০১টি খেতাব।
পরিসংখ্যানই বলছে ডার্বির শতবর্ষের পদার্পনে সবুজ মেরুনের থেকে লাল হলুদ ব্রিগেড বেশ কিছুটা এগিয়ে।
মোহনবাগানের গৌরবময় অধ্যায় : ১৮৮৯ সালের ১৫ আগষ্ট কলকাতার শ্যামপুকুরের বসু পরিবার, ফড়িয়াপুকুরের মিত্র পরিবার ও বাগবাজারের সেন পরিবার – উত্তর কলকাতার এই তিন অভিজাত পরিবারের উদ্যোগে মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব নামে ক্লাবটির প্রতিষ্ঠা হয়।
১৮৯৩ সালে মোহনবাগান কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণ করে। এটিই ছিল ক্লাবের প্রথম টুর্ণামেন্ট । ১৯১৫ সালের ১৫ মে মোহনবাগান প্রথম কলকাতা ফুটবল লিগের ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে ক্যালকাটা ক্লাবের বিরুদ্ধে। এই লিগ ছিল ভারতের প্রথম ফুটবল লিগ। ১৯৩৭ সালে মোহনবাগান ইংল্যান্ডের ইংলিশটন করিন্থিয়ানসের বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। ১৯৩৯ সালে মোহনবাগান দীর্ঘ ২৫ বছর অপেক্ষার পর প্রথম ভারতীয় কলকাতা ফুটবল লিগের চ্যাম্পিয়ন হয়।
১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ডে মোহনবাগান ব্রিটিশদের ক্লাব ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। শিবদাস ভাদুড়ির নেতৃত্বে সবুজ মেরুণ জার্সি পড়াদের সেই সাফল্য প্রভাবিত করেছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইকে। তখন থেকেই এই দিনটিকে ‘মোহনবাগান দিবস’ হিসাবে উদযাপন করা হয়। ১৯৮৯ সালে ক্লাবের প্রতিষ্ঠা শতবর্ষ উদযাপিত হয়। সেই শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারত সরকার ১৯১১ সালের ২৯ জুলাই সেই গৌরবময় জয়কে স্মরণ করে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ভারতবর্ষের ফুটবল খেলার ইতিহাসে সম্পূর্ণ দেশীয় একটি ক্লাব এবং তার ফুটবলাররা খালি পায়ে খেলে বুট পড়ে খেলা প্রশিক্ষিত ইউরোপিয় কোনো ক্লাবের বিরুদ্ধে জেতে। সেই এগারোজন বীর খেলোয়ার সমগ্র ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সেদিন যাঁরা খেলেছিলেন মোহনবাগান ফুটবল টিমে – শিবদাস ভাদুড়ি(ক্যাপ্টেন), বিজয়দাস ভাদুড়ি(লেফ্ট ইন), অভিলাস ঘোষ (স্টপার) – ওনার গোলেই জয় আসে, হিরালাল মুখোপাধ্যায়(গোলকিপার), এ. সুকুল(রাইট ব্যাক), সুধীর চ্যাটার্জী(ডিফেন্ডার), মনমোহন মুখার্জি(রাইট হাফ), রাজেন সেনগুপ্ত(সবচেয়ে কম বয়সী প্লেয়ার, সেন্টার হাফ), শ্রীশচন্দ্র সরকার(রাইট ইন), নীলমাধব ভট্টাচার্য্য(লেফ্ট হাফ), যতীন্দ্রনাথ(কানু) রায়(রাইট উইঙ্গার)।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের গৌরবময় পথ চলা : বাংলার বিখ্যাত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম ১৯২০তে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব জন্ম নেওয়ার নেপথ্যে কিন্তু রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন মোহনবাগান ক্লাবের ভূমিকা ৷ সেবার কোচবিহার কাপের ফাইনাল ২৮ জুলাই, ১৯২০। মুখোমুখি মোহনবাগান ও জোড়াবাগান। চ্যাম্পিয়ন হল মোহনবাগান৷ সেই ম্যাচ জোড়াবাগান জিতলে হয়তো ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের উৎপত্তিই হত না ৷ বাঙালদের প্রতি বিদ্বেষের কারণে ম্যাচটা হারার যাবতীয় দায় শৈলেশ বসু ও নসা সেন নামক দুই বাঙালের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জোড়াবাগান ক্লাব কর্মকর্তারা এই দোষারোপের কাজটি করেই চলেছিলেন। রাগে অভিমানে সকলে মিলে ক্লাব ছেড়ে দেন তাঁরা। সেই জোড়াবাগান ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন সুরেশচন্দ্র চৌধুরি মহাশয়। ময়মনসিং জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার নাগপুর গ্রামের জমিদার ছিলেন তিনি। ফুটবল নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তাঁর ছিল দরাজ হৃদয়। ফুটবল খেলার জন্যে খরচ করতেন দুহাতে। সেদিন জোড়াবাগান ক্লাব হারার পরে বাঙালদের প্রতি বিদ্বেষের প্রতিবাদে ক্লাব ছাড়া সিদ্ধান্ত নেন তিনিও। এপারের ঘটিদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায়ে তাঁর হাত ধরেই ১ আগষ্ট, ১৯২০তে জন্ম নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। বস্তুত ঘটি-বাঙাল রেষারেষির কারণটাই ছিলো ইস্টবেঙ্গল ক্লাব গড়ে ওঠার পিছনে।
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আই.এফ.এ শিল্ডের ফাইনালে মোহনবাগানকে চূর্ণ করেছিল ৫-০ ব্যবধানে। এখন পর্যন্ত এই দুই দলের সকল ডার্বি ম্যাচে এটিই সর্বাধিক স্কোর।
এই অপ্রত্যাশিত হারের পরে মোহনবাগানের কোনো প্লেয়ার সেদিন বাসায় ফিরতে পারেনি। এমনকি ক্লাব তাঁবুতেও। অনেককে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল মাঝ গঙ্গায় নৌকায়। মোহনবাগানের এক অন্ধ সমর্থক সুইসাইড করে লিখে রেখেছিল সে পরের জন্মে ফুটবলার হয়ে মোহনবাগানের হয়ে খেলে এর প্রতিশোধ নেবে।
সেদিন যাঁরা ৫ টি গোল মোহনবাগানের জালে জড়িয়েছিলেন : সুরজিত সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা-২গোল, রণজিৎ মুখার্জী, শুভঙ্কর স্যান্যাল।
এছাড়াও খেলেছিলেন তাঁরা হলেন সুভাষ ভৌমিক, সুধীর কর্মকার, গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরী, প্রশান্ত মিত্র প্রমুখ।
১৯৭৫ সালের কলকাতা লিগে একটিও ম্যাচ না হেরে কলকাতা লিগ জয় লাভ করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। সত্তরের দশক ইষ্ট বেঙ্গল ফুটবল ক্লাবের ইতিহাসে ‘সোনালী দশক’ নামে পরিচিত। এই সময়কালে ইস্টবেঙ্গল সর্বমোট কুড়িটি ট্রফি ক্লাব তাঁবুতে তোলে।
এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর খেলার সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটে ১৯৮০ সালে। দিনটা ছিলো ১৬ আগস্ট।
খেলা দেখতে এসে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল ১৬ টি তরুণ প্রাণ। খেলার মাঠে উত্তেজনা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন রেফারি সুধীন চ্যাটার্জি। দুই দলের খেলোয়ারদের মধ্যে একের পর এক অন্যায় ফাউল করে যাওয়ায় মাঠেই উত্তেজনা চরমে উঠে এবং তা গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ইডেন গার্ডেনের ডি ব্লকে সেদিন বিনা টিকিটের অতিরিক্ত দর্শক হঠাৎ ঢুকে পড়ার কারনেও ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আই.এফ.এ’র তরফে এই দিনটিকে “ফুটবল লাভার্স ডে” ঘোষনা করা হয়।
সেইদিনের সেই শোকের ঘটনা এখনও তাড়া করে বেড়ায় ময়দানের অনেককেই। ইডেনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে এসে আর বাড়ি ফেরেননি ১৬টি প্রাণ – সেই অমর ফুটবলপ্রেমীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মান্না দে গেয়েছিলেন – ‘’খেলা ফুটবল খেলা/খোকা খেলতে গেল/সেই সকালবেলা../ আর ফিরল না৷” এমন মর্মস্পর্শী ঘটনার আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয় !
‘ঘটি-বাঙাল’ হলো মাঠের বাইরের চায়ের আসরের মজলিসি আড্ডা। সেই আড্ডাতেই এখনও জমে উঠে আমাদের বাঙালিদের কাছে সব খেলার চাইতে প্রিয় খেলা ফুটবল। যেখানে জমজমাট আলোচনায়, তর্ক বিতর্কে থাকে আমাদের দুই প্রিয় ক্লাব মোহনবাগান – ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগান জিতলে বাজারে চিংড়ির দর বাড়ে, ইস্টবেঙ্গল জিতলে ইলিশের।
চিংড়ির প্রতি ঘটিদের লোভের কারনে, বাঙালরা একটা সময় ঘটিদের ক্ষেপাত এই বলে, “পোকা খাওস তরা – জলের পোকা।” আবার বাঙালরা যদি শুটকি মাছ রান্না করতো তার একটা গন্ধ ছড়ালে, যা ঘটিদের অপছন্দ ছিলো – চিৎকার চেচামেচি করে পাড়া মাথায় করতে দেখা যেত। আবার ইলিশ ভাঁপার যে দুর্দান্ত রেসিপি তা কিন্তু বাঙালদের সৃষ্টি।
তবে সেই হুজুগ এখন আর নেই। সেই বাঙালিয়ানাও এখন আর নেই। এখনকার সময়ে মিশ্র হুজুগে সংস্কৃতির জোয়ার। আবেগটা শুধু জেগে ওঠে ডার্বি ম্যাচ হলে। এখনও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের ডার্বি ম্যাচে সেই হুজুগে বাঙালীদের একটা অংশ লাইন দিয়ে মাঠে ঢোকার অগ্রিম টিকিট কেনে ও নিজ নিজ দলের সমর্থনে মাঠ ভরিয়ে তোলে। লাল-হলুদ আবির বা সবুজ-মেরুন আবির মেখে প্রিয় দলের জয়ে আবেগে গা ভাসায়।
আমি কিন্ত ইস্টবেঙ্গল ! আপনি ?
~~ বি.গু।।
(তথ্য সংগৃহিত)