ধারাবাহিক উপন্যাস -কথা দিয়েছিলে পর্ব চার —– ছবি ব্যানার্জী
ধারাবাহিক উপন্যাস
-কথা দিয়েছিলে
পর্ব চার
ছবি ব্যানার্জী
অর্জুন বইপত্র ছড়িয়ে মন খারাপ নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।হঠাৎ অর্কর ধাক্কাতে জেগে উঠল।অর্ক বলল–এই শালা,তোর পেটের গন্ডগোল না মাথার গন্ডগোল? অর্জুন বলল—তোরা তো সিনেমায় গেছিলি।কটা বাজে?এর মধ্যে চলে এলি যে?
অর্ক বলল–শালা তোকে আগাপাশতলা রাম ধোলাই দিতে ইচ্ছে করছে।ফোনটা কি এখনও মিউটে রেখেছিস?কই ফোনটা দে তো দেখি?ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই।তাকিয়ে দ্যাখ তো কটা মিস কল আছে?ক্লাস শেষে ফোনটা খুলবি তো।তোর বাড়ি থেকে কোনো এমারজেন্সি ফোন ও তো আসতে পারত?ওরে গর্দভ আমরা সিনেমা দেখব বলেই বেরিয়েছিলছিলাম। তোর জন্য রেস্টুরেন্টে দুজন দু কাপ কফি নিয়ে তোর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আর কন্টিনিউ ফোন করে গেছি। এমনকি সিনেমা হলের সামনেও অপেক্ষা করেছি,যদি তুই ফোনটা দেখে চলে আসিস বলে।
এই দ্যাখ তিনটে টিকিট শুধু শুধু তোর আহাম্মকির জন্য নষ্ট হল।তুই ভাবলি কি করে তোকে বাদ দিয়ে আমরা সিনেমা দেখব,রেস্টুরেন্টে ভালোমন্দ খাব।তুই যে রাগ করে শুয়ে আছিস সেটা বেশ বুঝতে পারছি। শালা তোর লোহার মতো পেটানো স্বাস্থ্য নিয়ে কাম্মাকে আবার বলেছিস পেটের গন্ডগোল? আমি জন্মে তোর কখনও পেট খারাপ দেখিনি।দুজনের খাবার তুই একাই সাবড়ে দিস। ওঠ তো?পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।
অর্জুন আমতা আমতা করে বলল–সত্যিই রে আমার পেটটা ঠিক নেই।মাকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ আমি কলেজ থেকে ফিরে কিছু খাইনি।– সেটা রাগে খাসনি।যথেষ্ট ন্যাকামি হয়েছে,এবার চল।আর কাল তুই কলেজ কাটবি।আমি কালকের দিনটা আছি।এবারে সকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত আমরা লং ড্রাইভে যাব।ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার সব রাস্তায় খাব।মাঝে মাঝে মাটির ভাঁড়ে চা খাব। ভালো হবে না? অর্ক বলল–সিনেমা যাবি না?–সে পরে যখন আবার আসব দেখা যাবে।
অর্জুন ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ওদের সংগে গেল।তনু জিজ্ঞেস করল–হ্যাঁ রে অর্জুন তোর শরীর কেমন আছে?তিতলি মুচকি হেসে বলল–মা অর্জুনের শরীরটা খারাপ ছিল।কিন্তু ওষুধ খেয়ে আর একটা টানা ঘুম দিয়ে এখন একেবারে ফিট।
তুমি বরং আমাদের খেতে দাও। আর কাল সকালে স্নান সেরে আমরা তিনজন সারাদিনের জন্য লং ড্রাইভে বেরোব।তনু বলল—কি যে তোদের শুধুমুধু লং ড্রাইভে যাওয়া বুঝি না বাপু।যাই হোক সন্ধ্যের আগে ফিরে আসবি কিন্তু।
অর্জুন বলল–ঠিক বলেছো কাম্মা।আমার ও সারাটা দিন এই লং ড্রাইভে যেতে ভালো লাগে না।অর্কটা একটা আস্ত পাগল।শুধুশুধু আমার কলেজটা কামাই করালো।বললাম তিনজনে মিলে সিনেমা যাই। তা নয় সে ধাবায় খাবে,যেতে যেতে কোনো জায়গা ভালো লাগলে সেখানেই বসে যাবে।এর ওর সংগে ডেকে ডেকে গল্প করবে।
তনু খাবার বাড়তে বাড়তে দ্রুত চিন্তা করছিল।ওরা যখন ছোটো ছিল অবাধে মেলামেশা করেছে তখন একরকম ছিল।এখন তিতলি যথেষ্ট বড় হয়েছে।তিতলির বাবা ওদের মুখে কিছু না বললেও প্রচন্ড বিরক্ত হয়।এই একসংগে সিনেমা যাওয়া,হুটহাট লং ড্রাইভে যাওয়া একদম পছন্দ করেনা।আজ একথা শুনলে কি বলবে কে জানে।
তনু ওদের ডাইনিং টেবিলে খেতে দিলে অর্ক বলল–কাম্মা তুমি আর কাকুও বসে পড়লে না কেন?তুমি বরং বিরিয়ানির হাঁড়ি আর যা আছে টেবিলে রাখো।সবার দরকার মতো তুলে নেব। বেশ ছোটোবেলার মতো গল্প করতে করতে খাব।তনু বলল–না রে তোর কাকু তো এই সবে টুকটাক বাজার করে ফিরল।ও একটু পরে খাবে বলেছে।
অর্ক বলল–তোমাদের ভালোর জন্যই বলছিলাম।এরপর তোমাদের বিরিয়ানিতে টান পড়লে আমার দোষ দিওনা।অর্জুন আজ কলেজ থেকে ফিরে কিছু খায় নি।ও আজ তিনজনের না হলেও আড়াই জনের বিরিয়ানি একাই সাবড়ে দেবে।আর এই তিতলি তুই ঐটুক নিলি কেন?ও গোল আলু মার্কা চেহারা হয়ে যাবে বলেছি বলে? পাখির আহার করলে তোর কিন্তু পরীর মতো চেহারা খ্যাংরা কাঠির মতো হয়ে গেলে মোটেই ভালো লাগবে না।একদম শ্যাওড়া গাছের পেত্নির মতো লাগবে,বলে একহাতা বিরিয়ানি তিতলির প্লেটে দিয়ে বলল –পেট ভরে না খেলে গাঁট্টা খাবি। ওদের খুনসুটি দেখে তনুর চিন্তাচ্ছন্ন মুখেও হাসি ফুটল।বলল–পারিস বটে তোরা। আজ কিন্তু রাত পর্যন্ত আড্ডা দিস না।কাল সারাদিনের জন্য বেরোবিই যখন তখন সকাল সকাল বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
তনু আরো কিছুক্ষণ পর খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘরে এল।ড্রেসিংটেবিলে বসে চুল আঁচড়ে মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে একবার আড়চোখে দীপকে দেখে বলল– তোমার মুখটা এমন গম্ভীর লাগছে কেন?অফিসের কাজের চাপ?খেতে বসেও মুখ বুজে খেয়ে নিলে।কেমন রান্না হয়েছে একবারও বললেনা তো?অন্য সময় হলে তো প্রশংসায় বাণ ছুটিয়ে দাও।ছেলে দুটোর সংগেও কেমন দায়সারা গোছের কথা বললে।কি হয়েছে বলবে না?
দ্বৈপায়ন বলল–আমার মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাইছ আমাকে।কি বলবে বলো।তনু বলল–শুনলে তুমি রেগে যাবে না তো?–আমার রাগ বা অভিমানে তোমার কিছু যায় আসে?না হলে আমি তিতলির ব্যাপারে তোমাকে বারবার সাবধান করার পর ও অর্কর সংগে ওকে সিনেমা দেখতে পাঠাতে না।আচ্ছা তনু তুমি তোমার অল্প বয়সের কথা কি ভুলে গেলে?তনু মুখভার করে বলল–তুমি আমাকে ভালোবাসার খোঁটা দিলে?আমি একাই ভালোবেসেছিলাম,তুমিও কি পাগলের মতো আমাকে ভালোবাসোনি?
দ্বৈপায়ন বলল–আমি তো সেটাই তোমাকে বোঝাতে চাইছি। আমরা দুজন দুজনকে অন্তর থেকে ভালোবেসেছি বলেই না বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম। তুমি যদি একতরফা আমাকে ভালোবাসতে সেখানে আমি যদি ভালোবাসার অভিনয় করতাম তাহলে সেটা জানতে পেরে তোমার মনের অবস্থা কেমন হত?কিংবা ধর উল্টোটা যদি হত আমি তোমাকে ভালোবাসলাম আর তুমি একটা ওজনদার ছেলে পেয়ে আমাকে ছেড়ে তার সংগে সুরসুর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলে।তখন আমার অবস্থা তো দেবদাসের মতো হত।
–আসলে অর্জুন অর্ক আর তিতলির এখন বয়ঃসন্ধির বয়স।ওদের অবাধ মেলামেশায় পদক্ষলন হয়তো হবে না।কিন্তু কেউ কাউকে ভালোবাসলে আর সেই ভালোবাসার পরিণতি না পেলে মনে একটা স্থায়ী ক্ষত তৈরি হবে।তাছাড়াও তিনটে তরুণ তরুণীর অবাধ মেলামেশা সমাজ ও বাঁকা চোখে দেখবে।ওদের তিনজনেরই এখন কেরিয়ার তৈরির সময়।বাড়িতে এসে সবার উপস্থিতিতে গল্প গুজব করে সেটা ঠিক আছে।
তনু বলল–কিন্তু কাল সকালে ওরা লং ড্রাইভে যাবে।আমি কথা দিয়ে ফেলেছি।–সত্যি তুমি মা হিসাবে কতোটা যোগ্য সেটা নিয়ে এখন আমার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। বয়ঃসন্ধির সময়ে আবেগ,ভালোবাসা,রাগ খুব তীব্র হয়।ওরা দুজনেই তিতলিকে মনে মনে পছন্দ করে কিনা জানো?ভবিষ্যতে এই ত্রিকোণ প্রেমের পরিণতি কি হতে পারে তোমার ধারণা আছে?ঠিক আছে তুমি কথা যখন দিয়েছো তখন এবারের মতো ওরা যাক।
তনু বলল–তুমি এতটা ভেবে নিয়েছো?ওরা জন্ম থেকে একসংগে বড় হয়েছে।ওদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের বাইরে কিছু নেই।দ্বৈপায়ন বলল–এটা তোমার রসায়ন।তুমি কল্পনার ডানায় ভর করে চলো।কিন্তু আমি বাস্তবটা দেখতে পাই।পরিণত বয়সে মানুষ বোধ বুদ্ধি শিক্ষা সংস্কৃতি দিয়ে সম্পর্কের বৈধতা বিচার করতে পারে।কিন্তু ওদের বয়সটাতো অপরিণত।এই বয়সে ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা থাকেনা।সেইজন্যই বাবা মা সন্তানকে সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করে।তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখে।ভালোবাসার সংগে সংগে শাসন ও করে।মনে রেখো প্রেমের হাতেখড়ি কিন্তু সিনেমা আর পর্দাঘেরা রেস্টুরেন্ট।
তনু বলল–সিনেমা রেস্টুরেন্ট?–তুমি ভুলে গেলে তুমি বিয়ের আগে সিনেমায় গিয়ে সিনেমাটা মন দিয়ে দেখতে?শুধু খুনসুটি আর বকবক করতে।পিছন থেকে অনেক সময় দর্শকরা অনেক সময় বলত–দাদা একটু আস্তে।তোমার বয়সটা অপরিণত হলেও আমি যথেষ্ট পরিণত ছিলাম।তাই ব্যাপারটার মধ্যে ব্যালেন্স ছিল।আমি তখন বছরখানেক হল চাকরিতে ঢুকেছি।তাও আমরা দুই পরিবারেরর মতামত নিয়ে বিয়ে করেছি।
তনু বলল–আমাকে কি করতে বলছ?–ওদের এই বেড়ানো, সিনেমা দেখা আমি পছন্দ করছিনা। অনেকদিন আমাদের দেশের বাড়ি যাওয়া হয় না।বাবা সেদিন ফোনে দুঃখ করছিল।তিতলিও পড়ার চাপে যেতে পারেনি।তুমি তিতলিকে নিয়ে পরীক্ষার রেজাল্ট না বেরোনো পর্যন্ত ওখানে থেকে এসো।–আর তুমি একলা থাকবে?–তুমি মনে হয় ভুলে যাচ্ছ তনু, তুমি টানা ছমাস তিতলিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ছিলে।আমার জন্যে ভেবো না।আমি দুপুরে অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেব।রাতে খাবার কিনে খাব।তাছাড়া আমিও মাঝে মাঝে যাব তো।
তনু বলল–এটা করে কি ওদের বন্ধুত্ব বা মেলামেশা বন্ধ করতে পারবে?–বন্ধুত্ব থাকবে না সেটা তো আমি বলিনি।দ্যাখো বন্ধুত্ব মানে এক পবিত্র নির্মল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। ওরা একসংগে বাড়িতে কিংবা আবাসনের মাঠে বসে গল্প করুক না।এরপর ওদের লেখাপড়ার চাপ বাড়বে।তখন গল্প করার ও সময় পাবে না।শুধু সিনেমা দেখতে যাওয়া বা এইভাবে বেড়াতে যাওয়াটা তুমিই একটু বুদ্ধি খাটিয়ে এভয়েড করবে।তিতলি ইংরাজি অনার্স নিয়ে পড়তে চায়।
–আমি তো ভাবছি তিতলিকে তোমার বাবা মার কাছে রেখে কলকাতার কলেজে পড়াবো।ওখান থেকে একবারে ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার স কমপ্লিট করুক।আমি চাই তিতলি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের কথা ভাবুক।তখন ওর ভালোবাসা ও পছন্দকে আমরা অবশ্যই সমর্থন করব।
অর্জুন বাড়ি ফিরল এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে।সে অর্ক আর তিতলির সম্পর্কে যা ভাবছিল সেটা কি ভুল ছিল?নিশ্চয়ই ভুল ছিল।অর্ক বড়লোকের ছেলে।ও হয়তো তিতলিকে দামী গিফ্ট দিতে পারে কিন্তু তার দেওয়া উপহারের মন থেকে উচ্চ্ছসিত প্রশংসাও করে।ও একটু বোহেমিয়ান টাইপের ছেলে হলেও ওর মধ্যে কোনো ভান নেই।স্পষ্ট কথা বলতে ভালোবাসে।নেতৃত্ব করার সহজাত ক্ষমতা থেকেই হয়তো তিতলি ও তার প্রতি জোর খাটায়।না তার মনে আর দ্বিধা নেই।তার এখন লেখাপড়ায় মনঃসংযোগ করা দরকার।তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ই হবে।তারপরে তার ভালোবাসার কথা তিতলিকে বলবে।