আমাদের Barefoot Ecologist ,শ্রীমতী তুলসী গৌড়া-কে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। @ গৌরী মৃণাল
আজ বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন – আমাদের Barefoot Ecologist ,শ্রীমতী তুলসী গৌড়া-কে ।
@ গৌরী মৃণাল
হোন্নালি কর্ণাটকের ছোট্ট একটা গ্রাম। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী হালাক্কাই উপজাতির। দারিদ্র্য সীমার নীচে থাকা এই উপজাতির মানুষগুলোর দুবেলা পেট ভরে খাবারই জোটে না, তায় আবার পড়াশোনা! সে তো উচ্চবর্ণের মানুষদের জন্য, ওরা তো পাকা বাড়িতে থাকে, দুবেলা ক্ষীর, পায়সম্ খেতে পায়। তুলসী তো একে নীচু জাত, তারপর বাবা গেছে মরে কোন্ ছোটবেলায়। মায়ের সাথে তুলসী দিনমজুরের কাজে যায় । মা ইঁট বইতে থাকে, তুলসী আগাছা পরিষ্কার করতে থাকে। মোটা শক্ত ঘাস তুলে চারাগুলোর চারপাশের মাটি আলতো করে নেড়ে দেয়। অল্প জল ঢেলে নরম কিশলয়ে হাত বুলিয়ে দেয় । চারা মাথা দুলিয়ে হেসে উঠে বলে – কাল আবার এসো কিন্তু!
বিয়ে হয়ে গেল তুলসীর। ছেলে পাশের গঞ্জেই থাকে। এক বড়লোকের জমিতে সে মুনিষ খাটে। কিশোরী তুলসী দুপুরবেলায় স্বামীকে ভাত দিতে গিয়ে সেই জমির প্রান্তের আল ধরে নতুন করে আগাছা সরায়, বীজ বোনে । মমতার স্পর্শে রুক্ষ ঊষর মাটি গর্ভবতী হয়ে ওঠে। লকলকিয়ে ওঠে নতুন প্রাণ, সতেজ উদ্ভিদ। নীরব ভাষায় ওরা কথা বলে । সার , জল , আলো – কার কতটুকু কখন প্রয়োজন, এক প্রায় অতীন্দ্রিয় অনুভূতি দিয়ে তুলসী জানতে পেরে যায়। গাছপালারা যে ওর জন্মান্তরের সন্তান, নতুন করে মাকে ফিরে পেয়ে কী খুশি ওদের !
সেই বড়োলোকটির জহুরী চোখ চিনেছিল তুলসীর অনন্য এই বৈশিষ্ট্য । তাঁর নাম ইয়েল্লাপ্পা রেড্ডি । বন বিভাগের আধিকারিক ছিলেন কাজপাগল এই মানুষটি। নতুন বনসৃজনের প্রকল্প থাকলে তুলসী কে তার কাজের সাথে যুক্ত করে নিতেন আর পাকাপাকিভাবে বনবিভাগের কর্মী করে নিলেন তারপর । গাছপালার সঙ্গে আশৈশব সখ্য এবার পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত হল বনসৃজনে। কয়েক বছরের মধ্যে তুলসীর ছোঁয়ায় বন্ধ্যা প্রান্তরও শ্যামলিম হয়ে উঠল। বীজ আর বৃক্ষ সম্পর্কিত গভীর ব্যবহারিক জ্ঞান তুলসীকে বনবিভাগের কাজে অপরিহার্য কর্মী করে তুলল। অবসর গ্রহনের পরে আজও অন্তত তিনশো রকমের ভেষজ উদ্ভিদ বিষয়ে এই তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষটির প্রজ্ঞা সকলের বিস্ময় আর শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। এ পর্যন্ত নিজের হাতে কত গাছ লাগিয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে লাজুক হাসেন সত্তরোর্দ্ধ মানুষটি – তা কয়েক হাজারের ওপর হয়ে যাবে হয়তো । কি জানি লাখও হতে পারে,আমি তো অত জানি না !
হালাক্কাই উপজাতি আদর করে তাঁকে বলে- তুলসী আজ্জি (ঠাকুমা), সম্মান করে বলে – বৃক্ষ দেবিতা। আর বনসৃজনের সাথে যুক্ত পরিবেশবিদ যাঁরা তাঁর কাজকে জানেন , তাঁরা বলেন – Barefoot encyclopaedia of forest , অরণ্যের বিশ্বকোষ বা নগ্নপদ পরিবেশবিদ। তাঁর কাজের স্বীকৃতি এসেছে প্রচুর সরকারি বেসরকারি পুরস্কারের মধ্য দিয়ে । পদ্মশ্রী, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র- আরো অনেক ।
তবু আজও তিনি আটপৌরে বাড়ির নিকোনো উঠোনের মঞ্চে বিনীত তুলসী হয়েই থাকেন। বয়সের সাথে ধূসর হয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে জড়িয়ে ধরেন আশেপাশের বৃক্ষলতাকে। অপার ভালোবাসায় বলেন – অরণ্য আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস, অরণ্য আমাদের জীবন । গাছপালা না থাকলে এই পৃথিবী বাঁচবে কি করে? বলেন কি মনে মনে,- ” আমি তোমারি মাটির কন্যা জননী বসুন্ধরা”!
আর একবার Barefoot Ecologist আমাদের তুলসী আজ্জিকে আভূমি প্রণতি ।
@ গৌরী মৃণাল
তথ্য : আন্তর্জাল ও কিছু পরিবেশ-নিবন্ধ।