রূপকথার বিদায় —– সোনালী চ্যাটার্জি
রূপকথার বিদায়
সোনালী চ্যাটার্জি
আজ ভারী মন খারাপ টুবলুবাবুর।রাতের খাবার খেয়ে তাই তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়ে ছিল ।অন্য দিন টিভিতে কার্টুন টার্টুন দেখে। কিন্তু আজ আর কিছুই ভাল লাগছেনা ।মার জন্য গোটা সন্ধেবেলাটাই নষ্ট হয়ে গেল।
।টুবলু কিছু বলতে গেলেই বলবে বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে নেই টুবলু। তুমি দিনদিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছ । ভাল ছেলেরা কখনও মা বাবার মুখের ওপর কথা বলেনা।
কিন্তু নিজে যে আজ ঠাম্মার মুখে মুখে কথা বললো সে বেলা কিছু হলোনা। ঠাম্মা তো বাবারও মা। তোমারও মা। তার মুখের ওপর কথা বলাটা বুঝি অন্যায় নয়।
আর ঠাম্মা করেছেটাই বা কী? না তার পড়া হয়ে যাবার পর তাকে লালকুমার নীলকুমারের গল্পটা বলছিল। গল্প টা তো শেষও হলোনা চাষি লাল নীল ডিমদুটো পাওয়ার পর কীহল কে জানে । এদিকে মা হাঁ হাঁ করে ছুটে এল ।মা তুমি আবার ওকে রূপকথার গল্প বলছো ?এসব অবাস্তব আজগুবি গল্প বলতে আমি তোমাকে কতবার বারণ করেছি না । তুমি ওকে অ্যাডভেনচারের গল্প বলো ইনভেনশনের গল্প বলো ।
যাতে ওর মনের বিকাশ হয় ও ইনসপিরেশন পায় ।
ঠাম্মা বলেন দেখ যূথী আমরাও ছেলেমেয়ে মানুষ করেছি ।রূপকথার গল্প শুনলে বাচ্চা দের ক্ষতি হয় এমন কখনো শুনিনি।বরং এতে ওদের মনের কল্পনা শক্তির বিকাশ হয় ওরা মানুষ পশুপাখি সব কিছুকে ভালবাসতে। শেখে।
দেখো মা এসব নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। টুবলুদের যুগ তোমাদের যুগ থেকে অনেক আলাদা।এখন আর পাঁচটা বাচ্চা যেভাবে মানুষ হচ্ছে, যে ধ্যান ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে ওকেও সেভাবেই বড় হতে হবে। বলে গটগট করে মা চলে যায় ।একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ঠাম্মা ও আস্তে আস্তে তার ঘরে চলে যয়।
মাঝখান থেকে বেচারা টূবলু একা একা বসে থাকে ।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে ছিল টুবলু ।হঠাত্ দেখে সামনের আয়নায় অ্যালিস। তা অ্যালিসকে দেখে টুবলু খূব একটা অবাক হয়না।কারণ অ্যালিস মাঝে মাঝেই আসে।আজব দেশের অনেক আজব আজব গল্প ওকে বলে। কিন্তু আজ যেন অ্যালিসের মুখটা খুব ভার।
।।টূবলু বলে অ্যালিস তোমার কী হয়েছে?মন খারাপ? অ্যালিস কোনো উত্তর দেয় না ।মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যায় ।
অ্যালিস চলে যেতেই গনেশ ঠাকুরের ইঁদুরটা বেরিয়ে আসে । তাকে দেখে টুবলূতো অবাক।হ্যাট কোট টাই পরে কী সাজই না সেজেছে। পায়ে আবার বুটজূতো ও আছে ।
ইঁদুর মশাই এসে ভারিক্কি চালে টুবলু কে বলে ,
টুবলু বাবু আর আমার তোমার সঙ্গে গল্প করা হবে না।
।কেন ইঁদুরভাই কী এমন হলো?
আমার পদোন্নতি হয়েছে টুবলুবাবু। পদোন্নতি? কথাটার মানে টুবলু ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা
পদোন্নতি বুঝলে না।প্রোমোশন হে প্রোমোশন ।তোমার বাবার যেমন একটা প্রমোশন হলো না অফিসে সেইরকমই আর কি।
টুবলু বলে প্রমোশন তো তাহলে ভাল জিনিস ইঁদুর ভাই,কিন্তু তা বলে গল্প করা হবে না কেন?
সময় নেই রে ভাই সময় নেই।আমি এখন কমপুটারের মাউস।বড় গুরুদায়িত্ব হে কতো কাজ।আমার কি এখন বাচ্চা দের সাথে গল্প করা সাজে।এই কথা বলে ইঁদুরভাই গঠমট করে হেঁটে কমপিউটারের দিকে চলে গেল।
।। টুবলুর মনটা আবার খুব খারাপ হয়ে গেল ।এই ইঁদুরভাই তাকে কত গল্পই না বলেছে।রোজ দুপুরবেলা খাওয়ার পর গণেশ ঠাকুর যখন ভুড়ি বার করে ঘুমোন,তখন ইঁদুরভাই কতোবার তার ভুড়ির ওপর উঠতে গিয়ে ।পিছলে পড়ে গেছে।যতোবারই চেষ্টা করে ততবারই পা পিছলে পরে যায়। একবার তো শুঁড় চাপা পরে একটা পা চেপটেই যাচ্ছিল ।
কথাটা মনে পড়তেই আপন মনে ফিক করে হেসে ফেলে টুবলু ।
তারপর লক্ষ্মীঠাকুরের পেঁচাটা,যেটা কিনা লক্ষ্মীঠাকুর একটু এদিক ওদিক গেলেই নখ বার করে ইঁদুরভাইকে ভয় দেখাতো-তা টুবলু একদিন সেসব কথা লক্ষ্মী ঠাকুরকে বলে দিতেই পেঁচাটাকে এমন বকুনি দিলেন যে সে আর কিছু করতে সাহসই পায় না।
তারপর টুবলু যেদিন মা বাবার সঙ্গে stuart little দেখে এলো সেদিন রাতেও তো ইঁদুরভাই এসেছিল।
।কি হে কেমন দেখলে বল? কেমন করেছি আমি?
আমিই তো stuart little সেজেছিলাম ।
টুবলু তো অবাক । কি ররবলছো তুমি ইঁদুরভাই ।তু মি তো কাল আর ওই ইঁদুরটা তো সাদা ।
আরে আমি খুব পাউডার মেখে সাদা হয়েছিলাম কিনা ।
টুবলু এবার খূব লজ্জিত হয় তার এতোদিনের পুরোনো বন্ধু কে চিনতে না পারার জন্য ।লজ্জা লজ্জা গলায় বলে তুমি কিছু মনে কোরো না ইদুরভাই বড়ো ভুল হয়ে গেছে ।তোমাকে চেনা আমার উচিত ছিল ।
আরে না না আমি কিছুই মনে করিনি।অনেকেই আমায় চিনত পারেনি ।
তারপর তো কত গল্প ।সেই ইদুরভাই ও আর আসবে না সেও কিনা এখন কমপিউটারের মাউস ।
ভাবতে ভাবতে চোখে জল এসে যায় টুবলুর ।মা যে কেন ঠাম্মার সাথে ঝগড়া করল?আর বোধহয় হয় মেঘনাদের কথা হনুমানের কথাও ঠাম্মা বলবেনা মেঘনাদ কেমন করে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতো আর বোধহয় জানা হল না ।তারপর হনুমান কতো বড়ো বীর, একলাফে সাগর পার হয়েছিল ।ল্যাজে আগুন দিয়ে লঙ্কাপুরীকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল ।
পিকলু দাদা তার নিজের জন্য একটা হনুমানের লেজ বানিয়েছে, তাকেও একটা বানিয়ে দেবে বলেছে এতো দুঃখের মধ্যে এইটুকুই যা সান্তনা ।
টুবলু দেখে আবার অ্যালিস আয়নায় এসে দাঁড়িয়েছে ।ওর পেছনে লাইন দিয়ে আসছে কত রাজা রানী রাজপুত্র রাজকন্যা লালপরী নীলপরী , গ্রিমভাইদের সেই বেঁটে বামুনটা,এক চোখো দৈত্য,রাক্ষস খোক্ষস আর রূপকথার সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া টা ।এখন ওরা কেউ কারোর সংগে ঝগড়া করছেনা ।মারামারি করছে না ।শুধু ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে আর হাত নাড়ছে ।
অ্যালিসের চোখ দিয়ে টপটপ্ করে জল পড়ছে,ওবললো বিদায় টুবলুসোনা বিদায় ।টুবলু ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা চলে যেতে শুরু করলো ।
টুবলু চেঁচিয়ে উঠে যেই বলতে গেল তোমরা দাঁড়াও যেওনা, সেই মূহূর্তে মাউসটা দুটো হাত বের করে ওর মুখটা চেপে ধরলো।আর কমপিউটারের মনিটরে ভেসে উঠলো 1 2 3 4 5 6 7.
দৈ কাব্য সেই পজ ঘোড়াটা ।
আসলে এতোদিনের চিনতে না পারার জন্য ।লজ্জা লজ্জা গলায় বলে তুমি কিছু মনে কোরো না ইদুরভাই বড়ো ভুল হয়ে গেছে ।
এসব অবাস্তব আজগুবি গল্পতে আমি তোমাকে কতবার বারণ কর। ওর মনের বিকাশ হয় ও ইনসপিরেশন পায়।
(A+b)^2=a^2+2ab+b^2