কথা দিয়েছিলে —- ছবি ব্যানার্জী

ধারাবাহিক উপন্যাস
—কথা দিয়েছিলে
পর্ব তিন
ছবি ব্যানার্জী

তিতলির সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা,অর্ক আর অর্জুনের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ও দেরি নেই। তাই এখন ওদের আড্ডা গল্প খুব কম হয়।সবাই পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্যে ওরা প্রচন্ড পরিশ্রম করছে।কখনো কখনো বিকেলের দিকে আবাসনের মাঠে বসে ওরা গল্প করে।

একদিন সেইরকম এক বিকেলে ওরা বড় ঠোঙাভর্তি চিনেবাদাম খেতে খেতে গল্প করছিল।হঠাৎ অর্ক বলল–অর্জুন আর আমি হায়ারসেকেন্ডারি পরীক্ষার পর কে কোথায় পড়াশোনা করব তার ঠিক নেই।তিতলির অবশ্য আরো দুবছর দেরি আছে।তাই আজ আমরা হাতে হাত রেখে তিনটে প্রমিস করব। কিন্তু প্রমিসের কথা আগে বলব না।তোরা রাজি?তিতলি বলল–তুই যা পাজি,কি না কি প্রমিস করাবি বাবা,আমি প্রমিস না জেনে হাত রাখতে রাজি নই।অর্ক বলল—তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না?যা তাহলে বলব না।তিতলি বলল—বেশ বেশ বাবা রাগ করিস না আমি রাজি।–অর্জুন তুই?–চোখ বন্ধ করে রাজি।

অর্ক বলল–তাহলে তিতলি তুই হাত পাত।এবার অর্জুন তুই তিতলির হাতে হাত রাখ তারপর আমি।এবার বল–আমরা ভবিষ্যতে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি,যতো ঝড় তুফান সাইক্লোন হয়ে যাক,আমরা সুখ দুঃখে,বিপদে সমস্যায় পরস্পর পরস্পরের সংগে মানসিক ও সাধ্যমতো শারীরিক ভাবে পাশে থাকব। দুই– আমরা কেউ কোনো কথা গোপন করব না,আমাদের পরস্পরের মধ্যে কখনো যদি ভবিষ্যতে ভুল বোঝাবুঝি হয়,কেউ যদি অন্যায় করে তাহলে আমরা কেউ কারো সমালোচনা না করে সেটা একসংগে বসে মিটিয়ে ফেলব। তিন–আমরা ভবিষ্যতে যদি আশি বছরের কাছাকাছি বেঁচে থাকি তাহলে বাকি জীবন আমরা মানে ধর শুধু স্বামী স্ত্রী মিলে ছ জন শুধু নিজেদের জন্য একটা বাড়ি বানিয়ে সেখানে একসংগে থাকব।অবশ্যই যার যা সাধ্য টাকা কন্ট্রিবিউট করে বাড়ি হবে।

তিতলি বলল–প্রথম দুটোর জন্য কথা দিলাম।কিন্তু তৃতীয়টা কি করে সম্ভব?ধর আমার বর এভাবে থাকতে,কিংবা তোদের বৌ রা যদি রাজি না হয়?সেক্ষেত্রে তোরা আপন আপন বৌ আর আমি বরকে ছেড়ে শুধু তিনজনে থাকতে রাজি বলে তিতলি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল।অর্ক বলল–তিতলি তুই এখনো ইমম্যাচিওরড আছিস। আর এমন করে হিহি করে হাসার কি আছে?তুইই বা তোর বরকে ছেড়ে আসবি কেন আর আমরাই বা আমাদের দীর্ঘদিনের সঙ্গীনি ছেড়ে থাকব কেন? অর্জুন বলল–বেশ সবাই রাজি হলে তবেই না হয় আমরা থাকব।ছেলে মেয়েরা নিজের নিজের কর্মস্থলে থাকবে।কিন্তু ওটার ঢের দেরি আছে।প্রথম দুটো প্রমিস এখন থেকে আমরা মেনে চলব। তিনটে অপরিণত,আবেগময় তরুন তরুণীর প্রতিজ্ঞা আর কেউ জানল না। শুধু অনাবিল বন্ধুত্ব আর সংসারের জটিলতা ও মলিনতা মুক্ত প্রতিজ্ঞার সাক্ষী থাকল এই মাঠ ,কয়েকটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড় বড় গাছ আর একটা থোকা থোকা লাল ফুলে ভর্তি কৃষ্ণচূড়া গাছ।

তিতলি মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে ইলেভেনে উঠল।সে ভবিষ্যতে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছার জন্য আর্টস নিল।
অর্ক জয়েন্টে চান্স পেয়ে খড়্গপুরে আই আই টিতে ভর্তি হল।অর্জুনের বরাবর ম্যাথস নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল।তাই ম্যাথসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হল।আসলে অর্জুন ইচ্ছে করেই জয়েন্টে বসেনি।ও জানত পরীক্ষায় বসলে খড়গপুরে না হলেও যাদবপুর কিংবা দুর্গাপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পাবেই।

অর্ক অর্জুন আর তিতলির মধ্যে অর্কর অবস্থা অনেক বেশি স্বচ্ছল।তার বাবা অফিসারRankএ চাকরি করে।মা স্কুলে চাকরি করে।তাদের কোয়ার্টারটা ও অনেক বড় এবং ফার্ণিসড।তাদের নিজেদের একটা গাড়ি আছে।তিতলির বাবার অবস্থাও বেশ স্বচ্ছল ।তাদের দেশে অনেক জমি জায়গা আছে।বাবা স্কুল টিচার ছিলেন।পেনশন যা পান তাতে দুজনের চলে যায়।তার ওপর জমি জায়গার আয় আছে।শুধু অর্জুনের বাবাকে দেশে বাবা মা ও এক বৃদ্ধা পিসিমার জন্য নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়।মাইনের একটা অংশ ওতেই বেরিয়ে যায়।শুধু চাকরির ওপর নির্ভর করে এসব চালাতে হয়।তাই অর্জুন টুকটাক কিছু টিউশন করে নিজের ছোটো ছোটো প্রয়োজন গুলো চালায়। বাবার ওপর চাপ পড়বে ভেবেই আগেই সে ঘোষণা করেছিল তার ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি পড়া পছন্দ নয়।

অর্জুন আর তিতলি কাছাকাছি থাকল। অর্ক তিতলি আর অর্জুনকে নিয়মিত ফোন করত। অর্ককে ছেড়ে অর্জুনের যতোটা মন খারাপ তার দ্বিগুণ মন খারাপ তিতলির হল।তিতলির মন ভালো করার জন্য অর্জুন একদিন বলল–এই তিতলি সিনেমা যাবি?সত্যজিত রায়ের “গুপি বাঘা ফিরে এল”সিনেমা চলছে।তিতলি বলল–না আমার ভালো লাগছে না।তাহলে চল দুজনে একটু রেস্টুরেষ্টে চিকেন চাউমিন আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে আসি তোর ফেবারিট চকোলেট আইস ক্রিম ও খাওয়াবো।–বললাম তো আমার ভালো লাগছে না।–কেন ভালো লাগছে না সেটা তো বলবি?তিতলি বলল–আমার মাথা ধরেছে।তোর বকবকানি শুনতে একদম আমার ভালো লাগছে না।

অর্জুন মুখ ভার করে ফিরে এল।সেদিন সবার হাতে হাত রেখে তারা যখন প্রমিস করছিল তখন তিতলির হাতের ওপর হাতটা রাখতেই তার গোটা শরীরে কেমন যেন শিহরণ খেলে গেল।সিরসিরে একটা ভালোলাগা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেল।কেন এমনটা হল?এর আগে তো কতবার তিতলির গাল টিপে বলেছে–তোর গালটা আপেলের মতো টুকটুকে কেন রে?কত সময় হাতে হাত রেখে তন্ময় হয়ে তারা তিনজনে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়েছে।কখনও সামান্য মনোমালিন্যের পর তিতলি তার গলা জড়িয়ে বলেছে–কথা বলবি না? তখন তো এমন অনুভূতি হয় নি?তাহলে কি তিতলির প্রতি তার অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি হচ্ছে?এটা কি অন্যায়?দুর কি সব আবোলতাবোল ভাবছে।লেখাপড়ায় মনঃসংযোগ না করলে রেজাল্ট ভালো হবে না।তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।

অর্জুন মাঝে মাঝে কখনও এক আধদিনের জন্যে এলে তিতলির মুখে একটা অন্যরকম আলো ফুটে ওঠে।তারা তিনজনে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়।তিতলি কলকল করে ঝর্ণার মতো বকবক করে।অর্ক চলে গেলে তার রেশ থেকে যায় তিতলির মনে।তখন নিজে থেকেই বলে–এই অর্জুন আইসক্রিম খাওয়াবি?চল আজ কলেজ ছুটির পর রেস্টুরেন্টে যাই।অর্জুনের যেতে ইচ্ছে না হলেও তিতলির কথা ফেলতে পারে না।

কেটে গেল আরো দুটো বছর।অর্জুন আর অর্কর বয়স এখন কুড়ি।তিতলি সবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে।তার হাতে এখন অঢেল সময়।সে ছোটোবেলায় মায়ের কাছে গান শিখত।তার সুরেলা গানের গলা হলেও নিয়ম করে গানে বসার ঘোর বিরোধী ছিল।ধরে বেঁধে তনু কখনো কখনো তাকে হারমোনিয়াম নিয়ে বসাতো।এখন গানের টিচার রেখে গান শেখার ইচ্ছে তিতলি মাকে বলেছে। সপ্তাহে দুদিন গানের টিচার আসে।তার বাইরে তিতলি এখন প্রতিদিনই গান প্র্যাকটিস করে।অর্জুন কলেজ থেকে ফিরে একটু আড্ডা দেওয়ার জন্য তিতলির কাছে গেলে তিতলি বলে–খুব ভালো সময়ে এসেছিস অর্জুন।বোস আমি দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলেছি শুনে বলল তো ঠিক হচ্ছে কিনা। তার আগে মাকে বলে আসছি তোর ফেবারিট পরোটা আর সাদা আলুর তরকারি করতে।বাবা কাল রসমালাই নিয়ে এসেছে।পেটুকরাম ওটাও তো তোর খুব প্রিয়।

অর্জুন বলল–তোর গানে এত ভক্তি জানতাম না তো?অর্ক ফোন করেছিল?–প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে ফোন করেছে।–তাই নাকি?কি এত কথা বলল রে?তিতলি বলল–আর বলিস না,সে তো ফোনেই আমাকে শাসন করছে।বলেছে বাড়িতে বসে বসে খেয়ে যেন গোল আলুর মতো চেহারা না দেখি আমি।আর এই সময়টা নষ্ট না করে গানটা যেন মন দিয়ে প্র্যাকটিস করি।

অর্জুন বলল–ও তাই তুই প্রতিদিন গান প্র্যাকটিস করছিস?–না তা কেন,আমার নিজেরও ভালো লাগে।–আচ্ছা তিতলি তোর রিসেন্ট জন্মদিনে আমি তোকে ফেলুদা সমগ্র উপহার দিয়েছিলাম।ওটা পড়া হয়ে গেছে?–না রে পড়া হয়ে ওঠেনি।এতদিন তো পড়ার চাপ ছিল।এবার পড়ব।তবে অর্কর দামী টাইটানের ঘড়িটা আমার খুব পছন্দের।দেখতেও খুব সুন্দর।সুন্দর না?–হ্যাঁ অবশ্যই সুন্দর।ওটা তোর হাতেই মানায়।অর্জুন বলল–তিতলি তোর হাতে তো এখন অঢেল সময়।চলনা একদিন সিনেমা দেখে রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি।তিতলি বলল–অর্কর তো কয়েকদিনের মধ্যে আসার কথা।তখন না হয় তিনজনে একসংগে যাব।অর্জুন চুপচাপ তিতলির গান শুনে ফিরে গেল।

কয়েকদিন পর অর্জুন কলেজ থেকে ফিরে তিতলিদের বাড়ি গিয়ে বলল–কাম্মা তিতলিকে দেখছি না?তনু বলল–তোরা কত বড় হয়ে গেলি বল?আর হুটহাট এসে কাম্মা এটা খাব ওটা খাব আর আবদার করিস না।কাম্মার কাছে গল্প শোনার বায়না করিস না।অর্জুন বলল–দুর কি যে বলো।এখন পড়াশোনার বড্ড চাপ গো।

তনু বলল–হ্যাঁ রে অর্ক আজ আসবে জানতিস
না?ও তো তিতলিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেল।–তাই?কই আমি জানতাম না তো?গতরাতেই তো অর্কর সংগে কথা হল।আজ আসবে বলেনি তো?তনু বলল–হয়তো বন্ধুদের সারপ্রাইজ দেবে বলে বলেনি।হ্যাঁ একটা কথা,আজ রাতে তোরা তিন বন্ধু মিলে একসঙ্গে খাবি।আমি মাটন বিরিয়ানি আর চিকেটের দো পেঁয়াজি করব।সংগে ঝুরো আলুভাজা আর চাটনি।অর্জুন বলল–কাম্মা আজ ওরা দুজনে খাক।আমার কদিন থেকে একটু পেটের গন্ডগোল হচ্ছে।আমি তো এখানেই আছি।তুমি অন্যদিন আমাকে খাওয়াবে।

অর্জুন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়ল।তিতলি বলেছিল তারা তিনজনে একসংগে সিনেমা দেখবে।ওকে না নিয়েই চলে গেল?
অর্কর অবস্থার সংগে তার আকাশ পাতাল পার্থক্য।কিন্তু এই বৈষম্য তো তাদের কখনো বন্ধুত্বের প্রতিবন্ধক হয় নি?তিতলি কি অর্কর বিত্ত বৈভবের চাকচিক্য তার ব্রাইট ফিউচার দেখে অর্কর প্রতি দুর্বল হল?নাকি অর্ক তার একনায়কতন্ত্রকতা ও অধিকার বোধ খাটিয়ে আস্তে আস্তে সুক্ষ মাকড়সার জালে তিতলিকে গ্রাস করছে?অর্ক হয়তো তার আগেই নামী কোম্পানিতে জয়েন করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে অনেক লড়াই করতে হবে।তার নীরব ভালোবাসার কোনো দাম নেই?ভালোবাসা মানে কি অধিকার বোধ? অর্ক যতটা তিতলির ওপর অধিকার ফলায় কই সে তো কখনও করে না? তার কাছে ভালোবাসা মানে এক গোধূলির রঙের মতো এক মায়াময় ভালোবাসা।একটা নরম সংবেদনশীল অনুভূতি ভরা মন।

–এই তো কিছুদিন আগের কথা।তিতলি সেদিন ও মাথা ধরেছিল বলে শুয়েছিল।অর্ক এসে বলল–এই তিতলি চল তুই আমি আর অর্জুন একটু লং ড্রাইভে যাব।ফেরার পথে রাস্তার ধাবা থেকে তড়কা রুটি আর ঘন দুধের মালাই চা খাব। গাড়িটা আজ বাবাকে বলে ম্যানেজ করেছি। তিতলি বলল–তোরা যা রে,আমার বড্ড মাথা ধরেছে।অর্ক ধমক দিয়ে বলল–নিজে থেকে উঠবি না ঘাড় ধরে টেনে তুলব?ওসব মাথা ধরা টরা বাইরে বেরোলেই চলে যাবে।তিতলি ওমনি সুরসুর করে চেঞ্জ করতে গেল।আচ্ছা সব মেয়েই কি অধিকার খাটানো পুরুষ, আর তার স্ট্যাটাসকে পছন্দ করে?

অর্ক তার আবল্যের বন্ধু।এই তো সেদিনই তারা হাতে হাত রেখে প্রমিস করেছিল।কেউ কোনো কথা গোপন করবে না।তিতলিকে নিঃশব্দে ভালোবেসে কি সেই প্রথম গোপনীয়তা ভাঙল?অর্জুন মনে করে সে প্রতিজ্ঞা ভাঙেনি।কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারবে না এমন প্রতিজ্ঞা তারা কেউ করেনি।ভালোবাসা জানানোর স্থান ও কাল দরকার।বরং অর্ক আর তিতলি কথা রাখেনি।অর্ক অনেক আগে থেকেই তিতলির সংগে গোপন সম্পর্ক রেখেছে বলেই লুকিয়ে তাকে না জানিয়ে সিনেমা দেখতে গেছে।না অর্কর সংগে সে কোনো প্রতিযোগিতায় যাবে না।সে নীরবে দেখে যাবে তার মায়াময় অব্যক্ত ভালোবাসা আস্তে আস্তে অন্য কোনো সবল পুরুষ ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।
চলবে–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *