জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া —- © সায়ন্তন ধর
জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া
©✍ সায়ন্তন ধর
(চতুর্থ পর্ব)
…ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর না হলেও ফ্রেঞ্চ ইতালিয়ান বা মায়ান রিভিয়েরার মত জার্মানির উপকূলকে জার্মান রিভিয়েরা বলা হয়। জার্মানির উপকূল প্রায় ২৩৯৮ কিলোমিটার বিস্তৃত। রুগেন দ্বীপ বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত। আনুমানিক ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বছর আগে হিমবাহ সৃষ্ট বাল্টিক সাগর পৃথিবীর গভীরতম সাগর, এটি পৃথিবীর বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ ব্র্যাকিশ সী। বাল্টিক ভীষণ শান্ত সাগর। এর জলতল ও তরঙ্গ শীর্ষের ব্যবধান কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র। এর লবনতা ভীষণ কম (০.৮-১.৭%)। সমুদ্র তলদেশে লবণাক্ত ভারী জল এবং উপরিভাগে সাদু জল থাকায় দুই ধরনের জলের বিভেদ স্তর সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। লবনতা কম হওয়ায় বাল্টিক সাগর প্রচণ্ড শীতে জমে যায়। এখনো পর্যন্ত বাল্টিক সাগর অঞ্চলে পৃথিবীর বৃহত্তম অ্যাম্বার ডিপোজিশন দেখা যায়। অ্যাম্বার হলো ফসিল হয়ে যাওয়া পাইন গাছের রজন। রেডিও কার্বন ডেটিং করে জানা গেছে চুয়াল্লিশ মিলিয়ন বছর আগে এখানে পাইন বন ছিল। বাল্টিক সাগরের প্রবেশ পথে রয়েছে খুব সরু নর্থ জার্মান বাল্টা প্রণালী। এই প্রণালীর নাম অনুসারেই এই সাগরের নাম বাল্টিক সাগর। এই সমুদ্র উপকূলের খাড়া পাড় চুনাপাথর সমৃদ্ধ হওয়ায় দুগ্ধশুভ্র। বাল্টিক সাগরে জার্মানির বারোটি দ্বীপ রয়েছে যার মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপটি হলো রুগেন। কিছুক্ষণ হলো এখানে এসে পৌঁছেছি। দ্বীপের অপরূপ শোভা উপভোগ করছি। হাঁটতে হাঁটতে পূর্ব প্রান্তে এসে সূর্যের রশ্মি উপেক্ষা করে তাকিয়ে দেখি দূরে আরও দূরে একটি দ্বীপ ওটা Usedom দ্বীপ। দ্বীপটির পশ্চিমাংশ জার্মানির, পূর্বাংশ পোল্যান্ডের। কিছুদিন আগেই ঘুরে এলাম পোল্যান্ড থেকে কিন্তু এদিকটায় আসা হয়নি আজও ওই দ্বীপে যাব না। নীল জলরাশি সাদা বালিয়াড়ির যেখানে ভেঙে সাদা ফেনায় পরিণত হচ্ছে ঠিক সেই বরাবর হাঁটতে লাগলাম উত্তর-পশ্চিমে। বালিয়াড়িতে দেখতে পেলাম স্পঞ্জ, ঝিনুক, সমুদ্রশশা, সমুদ্র সজারুর দেহাবশেষ পড়ে রয়েছে। এর কিছু পরেই আরম্ভ হলো জার্মানির ক্ষুদ্রতম জাতীয় উদ্যান জাসমুন্ড ন্যাশনাল পার্ক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬১ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন দুধসাদা খাড়া পাড়গুলির ঠিক পিছনেই রয়েছে বীচ গাছের অরণ্য। চুনাপাথরের পাড়গুলো ভঙ্গুর, সমুদ্রের ঢেউ এর ধাক্কায় বা প্রবল হাওয়ায় ভেঙে ভেঙে পড়ছে সাগরের জলেই। চুনাপাথর নির্মিত হওয়ায় প্রাকৃতিক ভাস্কর্যে পরিপূর্ণ এই বেলাভূমি। Wissower Klinken এমনই একটি অসাধারণ সুন্দর প্রস্তরময় ভাস্কর্য যা ২০০৫ সালে ভেঙে যায়। বর্তমানে ১১৮ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট বিশালাকার কিংস চেয়ার ভাস্কর্যটি ঠিক যেন একটি সাদা সিংহাসন, জাতীয় উদ্যানের বনদেবতা যেন এখানেই অধিষ্ঠিত। বীচ অরন্যের বনপথ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছিল কিছু , , , . সুউচ্চ গাছের অনুভূমিক শাখাগুলি সেজে রয়েছে অর্কিডের মালায়। মেয়েদের সুদৃশ্য চটি-জুতোর মত ফুল বিশিষ্ট অর্কিডের সংখ্যাই বেশি। এরপর আরো হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে এক সময় পেরিয়ে এলাম এ বনপথ। বাল্টিক সি বাইক পথ দিয়ে স্থানীয় বাইক নিয়ে পাড়ি দিলাম দীর্ঘ পথ। বাইক মানে মোটরসাইকেল নয়, সাইকেল। তবে গিয়ার দেওয়া এই উন্নত সাইকেল গুলি কোন অংশে বাইকের চেয়ে কম নয়। বাইকে গতি তুলতেই সমুদ্রের নোনা বাতাস এসে ঝাঁপটা মারছে মুখে চোখে, চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এক অভূতপূর্ব অনুভূতি যা প্রকাশ করা অসম্ভব। ছোট ছোট গ্রাম, বেলাভূমির অস্থায়ী ঠিকানা পেরিয়ে চলেছি। কখনো রাস্তায় এসে পড়ছে সমুদ্রের জল এভাবে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম ক্যালিফোর্নিয়েন ও ব্রাজিলিয়েন গ্রামগুলিতে। লাঞ্চ সারলাম নুডলস্ ও সার্ডিনের স্যুপ দিয়ে। এরপর পৌঁছলাম কিয়েল। সেখানে পর্যটক ও স্থানীয়দের নিয়ে কিয়েলরেগাট্টা অর্থাৎ নৌ প্রতিযোগিতা হবে। ‘হারি জিতি নাহি লাজ’ তাই একটি অভিযাত্রী দলের সাথে আমিও অংশ নিলাম বিশ্বের বৃহত্তম নৌ প্রতিযোগিতায়। সাদা পালে দিলাম টান। নীল সাগরজলে যেন ভেসে চলেছে কয়েকশো রাজহংসী। এরপর ফেরার পালা, ফেরার আগে জেনে নিলাম এই কিয়েল থেকেই কিয়েল ক্যানেল এর সাহায্যে বাল্টিক থেকে উত্তর সাগরে প্রবেশ করা যায়। তবে আজ থাক, আজ ফিরতে হবে রস্টক শহরে। রস্টকে যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাজার তারার আলোয় জ্বলে উঠেছে পথবাতিগুলি। অপূর্ব মায়াবী লাগছে শহরটাকে। পরদিন খুব ভোরে উঠে বিদায় জানালাম রস্টককে। লক্ষ্য স্থির করলাম রাজধানী বার্লিন।
স্থাপত্যের শহর তুমি বার্লিন
গুনগুন করি লিলি মার্লিন।
হেক্টর জুড়ে হাইটেক ফার্ম
আর সার্ভিস সেক্টর লাভলি চার্ম।
শিল্প বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে
বার্লিন শহরটি যাচ্ছে এগিয়ে।
বেতার টেলিভিশন মিডিয়া জোরদার
হামবোল্ড্ট বার্লিন ভার্সিটি ক্ষুরধার।
শুধু কি স্থাপত্য! এখানেও আছে বন
আছে নদী খাল হ্রদ শোভিত উদ্যান।
স্প্রী নদী বইছে এঁকে বেঁকে অবিরাম
নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু মনোরম।
সারাটি বছর ধরে অল্প স্বল্প বৃষ্টি
বার্লিন শহরটি মানুষেরই সৃষ্টি।
বার্লিন পৌঁছেই চলে এলাম স্প্রী নদীর পাড়ে। এখানেই বার্লিন প্রাচীরের একটি দীর্ঘতম অংশ (১৩১৬ মিটার) সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এই দেওয়ালের পূর্ব বার্লিনের অংশে চিত্রায়িত হয়েছে বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং সেই সময়কার পটপরিবর্তন। ১৯৮৯-১৯৯০ সালে ২১ টি দেশের ১১৮ জন শিল্পী ১০৫ টি চিত্রের সমন্বয়ে এই সৃষ্টি করেছিলেন। তবে নগর বিকাশের পদক্ষেপের কারণে সংরক্ষণ ঠিকমত হয়নি শুধু প্রতিলিপি গুলিই বিদ্যমান। বার্লিন ওয়াল মেমোরিয়ালে ৬০ মিটারের একটি অংশ এখনও সংরক্ষিত আছে। মনটা খারাপ হয়ে যায় এগুলো দেখলে। পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পৌছে গেলাম হ্যাভেল নদীর কাছে। এই নদীটি আবার এলব্ নদীর উপনদী। স্প্রী নদী তার মধ্যগতিতে অনেক বাঁকের সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীতে সেই বাঁকগুলি পরিহার করে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে। আবার কিছু কিছু হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে তুষার যুগের হিমবাহের ক্ষয় কার্যের ফলে। এমনই একটি হ্রদের তীরে এসে দাঁড়ালাম। নাম তার মুগেলসি। হ্রদের একপাশে ঘনবসতি, আকাশচুম্বী ঘরবাড়ি, অপরদিকে সবুজ ঘন অরণ্য। টলটলে জলে ছোট ছোট মাছ খেলে বেড়াচ্ছে, কিছু কচুরিপানায় ঘর বেঁধেছে পরিযায়ী পাখির দল। ঘাটে অনেকগুলি নৌকো বাঁধা রয়েছে, স্নানের ঘাট, সেখানেই ড্রাইভ দিয়ে সাঁতার কাটছে কেউ কেউ। এটি শহরের দক্ষিণ পশ্চিম অংশ এবার মূল শহর দেখার পালা এখানেও অনেক কিছু দেখার আছে। ইতিহাস এখানে কথা বলে। উত্তর-পূর্ব জার্মানির বেশিরভাগ শহর, নগর, গ্রামের নাম এসেছে জার্মানিয়া স্লাভিকা অর্থাৎ স্লাভ ভাষা থেকে উদ্ভূত জার্মান থেকে। তাই এই নামগুলির সাথে -ow, -itz, -in ইত্যাদি Suffix ব্যবহার করা হয়। আবার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পোলাবিয়ান ভাষায় Berl/birl এর অর্থ হলো swamp বা জলা জায়গা। নদী-খাল-বিল-হ্রদ মিলিয়ে জায়গাটি সত্যিই নিম্ন সমভূমি ও জলাভূমি প্রকৃতির। তাই মনে করা হয় এই Berl শব্দটির সাথে -in suffix জুড়েই বার্লিন নামকরণ হয়েছে। অপর একটি মত হলো জার্মান শব্দ Bär অর্থাৎ bear/ভালুক থেকে বার্লিন নামকরণ হয়েছে। এই যুক্তিকে মর্যাদা দিয়ে বার্লিনের কোট অব আর্মস একটি ভালুক। এই তথ্যগুলো লেখা ছিল বার্লিন চিড়িয়াখানায় ঢোকার ঠিক আগেই। চিড়িয়াখানায় ঢুকেই প্রথমে নজরে পড়ল ব্ল্যাক বিয়ার, ব্রাউন বিয়ার, পোলার বিয়ার, শ্লথ বিয়ার, ও জায়ান্ট পান্ডা। এরপর একে একে আরো অনেক প্রাণীদের দেখে অনেকটা সময় কেটে গেল বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় চিড়িয়াখানায়।
(ক্রমশঃ)
©✍ সায়ন্তন ধর
২৬/০৮/২০২১
অনবদ্য তোমার প্রকাশের ভাষা।
অনন্য তথ্য সমৃদ্ধ উপস্থাপনা। মুগ্ধতা রেখে গেলাম।