## ভৌতিক গল্প : ## গল্পের নাম : বৃষ্টি
## ভৌতিক গল্প :
গল্পের নাম : বৃষ্টি
মালা মুখোপাধ্যায়
–কিরে কিছু বলবি?
একটি চেয়ার এগিয়ে আসে। আমার রান্না ঘরে, আমার পা টা খুব ধরেছিল।
বয়স আমার ষাট্। হাঁটু ব্যাথা । একটানা রান্না করতে খুব কষ্ট হয়। আমি একাই থাকি একটি ছোট ফ্লাটে। আমার একমাত্র মেয়ে বিদেশে রিসার্চ করছে। আমার উনি বেশ কয়েকবছর আমাকে একা রেখে আকাশের তারা হয়ে গেছেন।
আমার ফ্লাটটি বড় সখের,গঙ্গার ধারেই,বালিতে।
আমি বুঝতে পারছি,একটি বাচ্চা বছর নয় দশ বয়সের মেয়ে আমার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছ ভাজা দেখছে। সেই আমার জন্য চেয়ারটা আমার কাছে এনে দেয়।
–মাছ ভাজা খাবি?
একমুখ হেসে একটি সাদা প্লেট আমার গ্যাস টেবিলে রান্নার কড়াইয়ের পাশে এগিয়ে আসে। আমি ওকে মাঝে মাঝে দেখি। সবসময় না। আমি বুঝতে পারি, জানি তো ওর মাছ ভাজা খুব প্রিয়। বিশেষ করে ইলিশ মাছের পেটি ভাজা ওর খুব ভালো লাগে। খুব ভালো মেয়ে। মাছটি খেয়ে, কাঁটা গুলো সরিয়ে নিয়ে বেসিনে রেখে দেয়।
একদিন বলেই ফেললাম,তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?
—আমার মেয়ের একটা পুরোনো খাতা ধীরে ধীরে আমার টেবিলে এসে পড়ে,তাতে আমার পেন দিয়েই লিখছে, এই ফ্লাটের জায়গায় একদিন বস্তি ছিল, একদিন আগুন লেগে পুড়ে যায় গভীর রাতে। আমাদের সবাই মারা যায়। আমি কাউকে খুঁজে পাইনি,তাই আমি এখান থেকে যাইনি। আমার নাম বৃষ্টি।
আমার তো খুব কষ্ট হলো, আবার ভয় করছিল, কি জানি,যতই হোক,
তবুও মনে মনে বললাম,না না তা করবে না,গলা টিপে মারবে না,মারলে এতোদিন মেরেই ফেলতো। বড় মায়া মেয়েটির। সেদিন বিছানায় শুয়ে হাঁটু নিয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করছি, দেখছি দুটি হাঁটু নরম নরম হাত দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে টিপে দিচ্ছে। আমি তো চোখ বুঁজেই বলছি ,কী আরাম হলো রে! আবার দেখি হাত , মাথা খুব সুন্দর ভাবে মেসেজ করে দেয়। কখনও আবার শীত শীত করলে গায়ে চাদর টেনে দেয়। আমি ঘুম থেকে উঠে ভাবি, কে ও , শুধুই কি এই ফ্লাটের আগে এই বস্তিতে বাস করত? না ওটা আমাকে বানিয়ে বলছে। আমার তো ওকে খুব কাছের কেউ, খুব চেনা হাতের স্পর্শ পাই কেন? কিছুতেই মনে করতে পারি না।
–কি গো বৌদি,ফ্লাটের দরজা খোলা কেন?
–আমি তো বন্ধ করেই রেখেছিলাম।
–ঘোড়ার ডিম, আমি দরজায় হাত দিতেই খুলে গেল। বাসন মাজতে মাজতে কাজের মেয়েটা বলে।
–না রে , আমি বন্ধ করেই এসেছি।
আমি আর তর্ক করলাম না, বুঝতে পারলাম এই কাজ বৃষ্টির।
এই জগতে অনেক কিছুর তো ব্যাখ্যা থাকে না। আমি মেয়েকে বলেছিলাম,হেসে বলে,বয়স হচ্ছে তোমার, একটু পাতলা খাবার খাও।পেট গরম হলেও উল্টো পাল্টা স্বপ্ন দেখে ।
আমি জোর দিয়ে বলিনি, আমি তার নিঃশ্বাস বুঝতে পারি। সে আমাকে খুব ভালবাসে। কেন বলবো? এতো প্রমাণ দিতে পারব না। আর আমার বিজ্ঞান চেতনায় থাকা মেয়েটি আরও দুশ্চিন্তা করবে,ভাববে মায়ের মাথা খারাপ হয়েছে কিনা।
তবে বৃষ্টিকে কতবার বলেছি, একবার দেখা দে।
শুধু খাতায় লিখে বলে, একদিন দেখা দেবো।
এই ভাবে চলতে চলতে বেশ কয়েকদিন পর আমার মাসতুতো বোন রমা এসে বলে ,তার দেওরের মেয়েটা, সেই যে,মা মরা মেয়েটা, সেই যে বৃষ্টি গো, কয়েকমাস আগে জ্বরে মারা যায়। খুব গুনের মেয়ে ছিল। আমি রান্না করলেই একটি চেয়ার এনে আমার রান্না ঘরে এনে দিতো,বলতো জেঠিমা পায়ে তোমার ব্যাথা,এই চেয়ারে বসো। তোকে কি বলবো দিদি, এতো সুন্দর গা হাত পা টিপে দিতো মেয়েটি, আহারে চোখের জল বাঁধ মানে না। বলতাম আমার
দিদিরও হাঁটু ব্যাথারে। কী দারুণ হাতের লেখা ছিল তার।
হ্যাঁ হ্যাঁ আমার মনে পড়েছে,তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম ,সেবার,মা মরা মেয়ে তো,একটু ভালোবেসে কোলে তুলেছি তো,আর কাছ ছাড়া হচ্ছিল না। কত আগডুম বাগডুম গল্প বলে শোনাত, আমরা কী হাসি হাসতাম ওর কথা শুনে ! আহারে! আমাদের মতো বুড়িদের রেখে ওরদিকেই যমরাজকে তাকাতে হবে রে? তাই হাতের স্পর্শ ,গায়ের উপরে নিঃশ্বাস, খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। মুখ ফসকে আমার বেরিয়ে পড়ে।
রমা অবাক হয়ে তাকায়। আমি থতমত খেয়ে যায়,হাতের ঢিল,মুখের কথা , দুটোকেই ফেরৎ পাওয়া যায় না, খুব বুঝেই ছুঁড়তে হয়। নিজেকেই বকে দি,কবে জ্ঞান হবে?
হঠাৎ রমার চোখে পড়ে, আমার ঘরের একটি খাতার পাতায়। খাতাটা পাখার হাওয়ায় খুলে যায়। রমা ছুটে গিয়ে বলে, এতো বৃষ্টির হাতের লেখা দিদি, এখানে কি করে এলো?
অবাক হয়ে বলি, তোদের বৃষ্টির হাতের লেখা এটা? এতো এখন আমার কাছে থাকে।
–বলো কি দিদি? বৃষ্টি তো মারা গেছে গো। এও কি সম্ভব?
–আমি কি করে অস্বীকার করি বল?
হঠাৎ করে দেখি, চোখের নিমেষেই, তিনটি সু্স্বাদু সরবতের গ্লাস আমাদের চোখের সামনে টেবিলে সাজানো হয়ে গেল।
তারমধ্যে একটি গ্লাসের সরবৎ একটু একটু করে কমতে থাকে।
মালা মুখোপাধ্যায়