ঐতিহ্যময় পানিহাটি —— কোয়েলী ঘোষ
ঐতিহ্যময় পানিহাটি
কোয়েলী ঘোষ
বয়ে যায় কুলকুল সুরধুনী নদী । লঞ্চ চলেছে এপার থেকে ওপার ,কোন্নগর থেকে পানিহাটি । গঙ্গার তীরে ছোট এক জনপদ পানিহাটি ।উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় সোদপুরের স্টেশনের কাছেই ।
লঞ্চ এসে থামে কিনারায় । বাঁধানো গঙ্গার ঘাট সবসময় সরগরম ,আশেপাশে কিছু দোকান পাট । সামনে শিবমন্দির । বাঁদিক ধরে এগিয়ে যাই ছায়া ঘেরা ঐতিহ্যময় সেই প্রাঙ্গণে । ছোট গেট পেরিয়ে বটবৃক্ষের নিচে বসি ।
ফিরে যাই ইতিহাসের পাতায় । প্রায় পাঁচশ চার বছর আগে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশীর দিনে পানিহাটির গঙ্গাতীরে পালিত হয়েছিল চিঁড়া দধি মহোৎসব বা দন্ড মহোৎসবের | এখানেই এসেছিলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ পার্ষদ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু ।তিনি বটবৃক্ষের তলায় বেদীতে ভক্ত বৈষ্ণব জন পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন ।
তখন তাঁর দর্শনে এলেন সপ্তগ্রামের জমিদারপুত্র ভক্ত রঘুনাথ দাস | তিনি অল্প বয়সেই শ্রীচৈতন্যের কাছে তাঁর প্রেম ভক্তিতে অনুরাগী হয়ে সংসার ত্যাগ করে গিয়েছিলেন মহাপ্রভুর কাছে কিন্তু তিনি তাঁকে সংসারে ফিরে যেতে বলেছিলেন ।সংসারে রঘুনাথ মন কিছুতেই বসাতে পারছিলেন না ।
নিত্যানন্দ প্রভু পানিহাটিতে এসেছেন শুনে রঘুনাথ তখন ছুটে আসেন পানিহাটিতে । তিনি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ।
তিনি বললেন যে , আমাকে ফাঁকি দিয়ে তুমি চৈতন্যদেবের কাছে গিয়েছিলে , এর জন্য তোমাকে দণ্ড পেতে হবে ।এখানে উপস্থিত সমস্ত ভক্ত বৈষ্ণবকে পেট ভরে চিঁড়ে দই খাওয়াতে হবে | তখন রঘুনাথ আনন্দিত মনে সেখানে উপস্থিত সকল ভক্ত বৈষ্ণবদের চিঁড়া দধি সন্দেশ খাওয়ানোর আয়োজন করলেন ।
এই মহোৎসবে নিত্যানন্দ প্রভুর আহ্বানে স্বয়ং মহাপ্রভু দিব্য ভাবস্বরূপে উপস্থিত হন ।এখানে মিলন হল ভক্ত আর ভগবানের । হরিধ্বনিতে মুখরিত হল গঙ্গাতীরের এই পানিহাটি । ভক্ত সঙ্গে মহানন্দে প্রভু দই চিঁড়া ভক্ষণ করেন আর প্রেম ভক্তি কৃপা দান করেন ভক্ত রঘুনাথকে l
” যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে তারা ,তারা দু ভাই এসেছে রে …”
অতীতের সাক্ষ্য নিয়ে সেই পুরানো বটবৃক্ষ আজও দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই শ্রী মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের শ্রী মন্দির ।ছোট মন্দিরে দুই হাত তুলে আছেন গৌর নিতাই ,সামনে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ , জগন্নাথ ,বলরাম , সুভদ্রার মূর্তি , আর শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন আঁকা শুভ্র ফলক । এই পবিত্র স্থানে এসেছিলেন শ্ররামকৃষ্ণদেব ।
সেই দণ্ড মহোৎসব আজও পালিত হয় । সমাগত ভক্তদের হরিনামে কীর্তনে মুখরিত হয়ে ওঠে গঙ্গার তীর ।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে ভাগীরথীর বুকে । সূর্যাস্তের ছায়া এসে পড়ে জলে , বর্ণময় হয়ে ওঠে । অতীতের সাক্ষ্য বয়ে ভক্তিরসের ভাবতরঙ্গ ভেসে যায় পবিত্র ভাগীরথী বুকে । এই বট বৃক্ষের নিচে কিছুক্ষণ বসে এক অপার শান্তি অনুভব করি ।
অদূরে ইসকন মন্দিরের শঙ্খ ঘণ্টা ধ্বনি শোনা যায় ।