**নীহারিকা বৃদ্ধাবাস**
**নীহারিকা বৃদ্ধাবাস**
****************
গতরাতের ঝড়ে ‘নীহারিকা বৃদ্ধাবাসের’ বাগানের উপরে যেনো তান্ডব হয়ে গিয়েছে।বয়স্ক আবাসিকেরা এখন এই ঠান্ডা ঠান্ডা রবিবারের সকালে মহা ব্যস্ত বাগানকে আবার পুরোনো চেহারা ফিরিয়ে দিতে।দোতলায় নিজের ঘরের জানলা দিয়ে সে দৃশ্য দেখতে দেখতে ভারী পরিপূর্ণ লাগছিলো নিজেকে মেধার।সপ্তাহে এই একটা দিন তাকে পূর্ন বিশ্রাম নিতে হয় তার বয়স্ক মেয়েদের শাসনে। অন্যদিনগুলো তো শুধু দৌড় আর দৌড় জীবন আর জীবিকার টানে।
দৌড় অবশ্য তার সমস্ত জীবন জুড়েই।জ্ঞান হয়ে থেকে সে নিজেকে দেখেছে শহরের এক বিত্তবান অবাঙালী পরিবারে।সেই পরিবারের বড়মেয়ে সে।কিন্তু নামেই,আসলে মূল পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন তার জীবনযাত্রা!তার খাওয়া দাওয়া,পোশাক পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে লেখাপড়া কোনো দিকেই যেনো তার মা বাবা কারোই নজর নেই।যেটুকু আদরযত্ন সে পায়,সবই বাড়ীর পুরোনো কাজের লোক শোভাচাচীর কাছে।মা বাবার আদরের ভাগ সবটুকু তার থেকে বছর দুয়েকের ছোটো দুই জমজ ভাইবোন দীপক আর দীপিতা’র জন্যে।এমনকি আত্মীয় স্বজনরাও উপেক্ষা করে তাকে।তবু পরগাছার মতো তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে সে।পড়াশোনায় বরাবর সে খুব ভালো।যদিও পড়ে মাঝারি দরের একটা স্কুলে।তার ভাইবোনের মতো নামজাদা স্কুলে নয়।মাঝেমধ্যে তবু বাবার ভালোবাসার ছিটেফোঁটা জুটে যায় ভাগ্যে,বিশেষ করে প্রতি বছর যখন রেজাল্টে র্যাঙ্কের জায়গায় ফার্স্ট লেখা নিয়ে এসে প্রণাম করে।কিন্তু অসুখ করলেও মাকে সে কোনোদিন পাশে পায়নি।সর্বক্ষণ মাতৃস্নেহের জন্যে একটা হাহাকার দাপিয়ে মরে তার বুকের মধ্যে।
এভাবেই নজরকাড়া ফল করে মাধ্যমিক পাশ করলো সে।বাবা খুব খুশী।কিন্তু মা’র মুখে কোনো হাসির রেখা নেই।বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে ভর্তিও হয়ে গেছে।এখন তার পড়ার খরচ চলবে তার নিজের স্কলারশিপের টাকায়।বাবার খুব গর্ব তাই নিয়ে।তাদের বংশে কোনোদিন কেউ এমন রেজাল্ট করেনি।কিন্তু একদিন হঠাৎ,মা-বাবার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ছিটকে বেরিয়ে আসা কিছু কথা তার পা দুটোকে মাটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দিলো!মা বাবাকে বলছে…..
—আর কতদিন এই বোঝা বইতে হবে আমাদের?
—-ভুলে যেওনা অলকা, ও আমাদের দায়িত্ব।
—-তাই তো বলছি,মোটামুটি একটা ছেলে দেখে এই শহর থেকে অনেক দূরে কোথাও ওর বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করো।
—–তা হয়না।ও যতদূর পড়তে চায়, ওকে সুযোগ দিতে হবে আমাদের।
বুকের মধ্যে ধ্বস নেমেছে!গুঁড়িয়ে যাচ্ছে এতোদিনের ঘরবাড়ি!উত্তাল ঝড় অবিরল কান্না হয়ে আছড়ে পরেছে শোভাচাচীর কাছে এসে।শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছে শোভা চাচী,সব কথা জানাতে।মেধার বাবা মা,অবিনাশ আর অলকা ছিলেন,নিঃসন্তান।বহু তাবিজ-কবচ-মানত- ডাক্তার কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি।শেষে এক বন্ধুর পরামর্শে পাশের শহর কলকাতার এক অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিলেন মাসছয়েকের একটা ছোট্টো মেয়েকে।ঘটা করে নাম রাখলেন মেধা।আদরযত্নের কমতি রইলো না।বাড়ীতে আনন্দের বান ডাকলো।ছ’টা মাসও ঘুরলো না,সে আনন্দ বেড়ে দ্বিগুন হলো!এতোদিন পর যেনো কোন জাদুবলে অলকা সন্তানসম্ভবা হলেন!জমজ ছেলেমেয়ের মা হয়ে গরবিনী অলকা,পুরোপুরি অস্বীকার করতে লাগলেন মেধাকে।আশ্রিতার মতো,একটা আগাছার মতো বাড়ীতে রয়ে গেলো সে।কোন অনাথ আশ্রম থেকে তাকে আনা হয়েছে,সে খবর অবশ্য শোভার অজানা।
চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো মেধা।মনে তার সুকঠিন সিদ্ধান্ত।এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।চুপচাপ মেয়েটা আরও চুপচাপ হয়ে গেলো।সারাদিনের সঙ্গী বইয়ের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো আরও গভীর করে।উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডী পেরোলো বোর্ডে প্রথম স্থান দখল করে।অবিনাশ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন।এই মোক্ষম সময়ে মেধা চেয়ে বসলো একটা উপহার।
——-আমাকে কিছু গিফট দেবেনা পিতাজী?
——-বোল বেটি, কী চাই তোর?তুই তো কোনোদিন কিচ্ছু চাসনি আমার কাছে!
——-আমাকে কোথা থেকে এনেছিলে বাবা?সেই ঠিকানাটুকু বলে দাও শুধু।আমাকে আমার শিকড় খুঁজে নিতে দাও।
অনেকক্ষন চুপ করে থাকার পর মাথা তুলে অবিনাশ বললেন,”এটাই পাওনা ছিলো আমাদের,বেটি।কোনোদিন সন্তানের ভালোবাসা দিইনি তোকে।আজ আটকাবো কোনমুখে?বলবো তোকে ঠিকানা।তবে এখন নয়।আগে ডাক্তার হয়ে ওঠ তুই,তারপর।এখন জানলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যাবে যে!”
তারপরও কেটে গেছে আরও কয়েকটা বছর।দিল্লীতে ডাক্তারী পড়া শেষ করে,কোলকাতায় চাকরী নিয়েছে মেধা।কথামতো অবিনাশ তাকে জানিয়ে দিয়েছেন সেই বিখ্যাত মিশনারী অনাথ আশ্রমের ঠিকানা।সেখানে এসে অনেক চেষ্টায় ডাক্তার মেধা খুঁজে পেয়েছে তার শিকড়ের সন্ধান।জুলাই মাসের এক রাতে এক ভদ্রলোক এসে একটা সদ্যোজাত মেয়েকে এই আশ্রমে দিয়ে যান।ভদ্রলোক নিজেও ডাক্তার ছিলেন।সেই মেয়েকেই পরে দত্তক নেন এক অবাঙালী দম্পতি।সেই ডাক্তারের ঠিকানা হাতে নিয়ে ছুটলো মেঘা উত্তর কোলকাতার এক তস্য গলির ভিতর।দেখা হলোএকটা প্রায় ভেঙে পড়া বাড়ীর ভিতর তার বাসিন্দা,এক জরাজীর্ণ বৃদ্ধ মানুষের সাথে…ডাক্তার অমিত সেন!মেধার পরিচয় জেনে চোখের জল বাঁধ মানলোনা ডাক্তার সেনের।পুরোনো আলমারী খুঁজে বের করে দিলেন একটা ছবি।অপরূপ সুন্দরী এক অল্প বয়সী মেয়ের কোলে ছোট্টো একটা বাচ্চা!আজকের মেধা আর তার মা নীহারিকা!ডাক্তারবাবু’র বাড়ীর পিছনে রয়েছে কোলকাতার এক কুখ্যাত অঞ্চল।দর্জিপাড়া।নীহারিকা ছিলো সেখানকারই এক বাসিন্দা।অন্ধকারেই কাটে তাদের মতো মেয়েদের জীবন।তবু সেখানে বসেই আলোর স্বপ্ন দেখতো সে।তাই তো জন্মের কয়েকদিন পরেই মেধাকে সে ডাক্তারবাবুর হাতে দিয়ে বলেছিলো, তাকে কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে।এমন কোথাও যেখানে পড়াশোনা শেখানো হয়।নীহারিকার পরিচয় নিয়ে বাঁচার চেয়ে অনাথ পরিচয়ও অনেক ভালো।অনাথ আশ্রমে যাতায়াত ছিলো ডাক্তার সেনের।মেধাকে দত্তক নেওয়ার খবর তিনি দিয়েছিলেন নীহারিকাকে।শুনে খুশীর শেষ ছিলোনা তার।নীহার বাঁচেনি বেশীদিন।দিনকয়েকের জ্বরে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সে,বছর ঘোরার আগেই।চোখের জলে ভাসা মেধার হাতে একটা ব্যাগ এনে ধরিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু।এর মধ্যে আছে নীহারিকার শেষ সম্বল,কিছু গয়না।এগুলো দিয়ে ডাক্তারবাবুকে সহায় সম্বলহীন মানুষদের কাজে লাগাতে বলেছিলো সে।ভগ্ন স্বাস্থ্য আর জনবলের অভাবে ডাক্তারবাবু কিছুই করে উঠতে পারেননি।আজ যখন মেধা এসেছে ,এসব তারই প্রাপ্য।যা করার সেই করুক।গয়নাগুলো বুকে চেপে ধরে বারবার মাকে ছুঁতে চাইছিলো মেধা!
সেই গয়নাগুলোর মধ্যে থেকে একটা হার সর্বক্ষণ গলায় পরে থাকে মেধা।যেনো সর্বক্ষণ মাকেই ছুঁয়ে থাকে।বাকী গয়না বিক্রি করে শহরের উপকন্ঠে বেশ খানিকটা জমি কিনে গড়ে তুলেছে এই বৃদ্ধাশ্রম।এই আশ্রম ই এখন তার ধ্যান জ্ঞান।নিষিদ্ধ পল্লীর কাজ হারানো অশক্ত বৃদ্ধারা, যাদের সমাজ রুগ্ন,ঘেয়ো কুকুরেরও অধম জ্ঞান করে,তাদের পরম আদরে ঠাঁই দেয় এই, ‘নীহারিকা বৃদ্ধাবাস…জীবনের শেষ ঠিকানা’।দেয় মাথাউঁচু করে বাঁচার আশ্বাস।আর এদের হাসির মধ্যেই না দেখা মাকে খুঁজে পায় মেধা।