শরণ্যা —- সর্বাণী রিঙ্কু গোস্বামী
শরণ্যা
সর্বাণী রিঙ্কু গোস্বামী
এবারের কুমারী পুজোর জন্য মেয়ে খুঁজতে কালঘাম ছুটে গেছে উদ্যোক্তাদের , আট বছরের ওপর হলে চলবে না কোনো খুঁত থাকলে মুশকিল । দেখতে শুনতে ভালো হলে তবেই লোকের মনে হয় হ্যাঁ একে মানিয়েছে বেশ । লাল চেলির ঘোমটা দিয়ে লাল বেনারসী পরে হাতে পদ্ম নিয়ে যখন মিটিমিটি হাসে তখন ঢিপঢাপ প্রণাম করে উপস্থিত সকলে । চন্দন টন্দন দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব পাড়ার বৌদিদের , শাড়িও তারাই পরায় । পাল্কি করে মেয়েটাকে মন্ডপে এনে বসানোর দায়িত্ব কর্মকর্তাদের , তখন তো আর পাড়ার মেয়ে নয় মা স্বয়ং , কৌমারী জননী ।অন্যবার সকলে মুখিয়ে থাকে বাড়িতে ঐ বয়সী একটা মেয়ে থাকলে , এবারে কর্মকর্তারা সন্ধান পেয়ে গেলেই শুনছে …না !
গতবছর যাকে কুমারী সাজানো হয়েছিল অতসীর মেয়ে পিঙ্কি , সে সদ্য পাঁচে পড়েছে । টুকটুকে দেখতে হাসিমুখ আর তেমনি চোখ নাক , চমৎকার মানিয়েছিল সেজেগুজে । কুমারী পুজোর পর প্রণামীতে পাওয়া সব টাকা ওর বিধবা মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সেইসঙ্গে নতুন জামা আর কিছু সাজগোজের জিনিস । পাড়ার কাউন্সিলর নিজে ওর মাকে বলেছিলেন , “ওকে পড়াও দিদি আমি সব দায়িত্ব নিলাম । ইস্কুল টিস্কুলগুলো খুলুক , আমাকে একবার মনে করিয়ে দিও তখন । ”
কাউন্সিলরের সঙ্গে আরো ক জন গাল টিপে আদর করেছিল পিঙ্কির , চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদেছিল ওর মা অতসী । তখনো বিধবা হওয়ার শোকটা ও ভুলতে পারেনি , সমরের ছুরি খাওয়া রক্তমাখা শরীরটা মাঝেমধ্যেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে । পাশের একটা নার্সিংহোমে আয়াগিরি করে চলে যাচ্ছে মা মেয়ের সংসার , বাপের বাড়ি কেন প্রতিবেশীরাও খবর নিতে সাহস পায়না যবে থেকে থানাপুলিশ হয়েছে । সমর যে পার্টি করত কোনদিন জানতোই না অতসী , অটো চালাতো সেটুকুনিই জানা ছিল ওর ।
কুমারী সাজার পর থেকে পিঙ্কির পাড়ায় খাতির বেড়েছিল , সঙ্গে অতসীর ও । এদিক ওদিক দেখলে লোকে হেসে তাকাতো কথা বলতো , ভয় কাটিয়ে একটু সহজ হচ্ছিল যেন পাড়ার লোক । পিঙ্কিও হাসিমুখ দেখলে সাহস পেত , কুমারী সাজার পর লোকের প্রণাম করা দেখে ওর ধারণা হয়েছিল সবাই ভালো । আসলে কুমারীর পায়ের কাছে তো আর অসুর সাজিয়ে কাউকে রাখা হয় না । কিন্তু উচিৎ , ভীষণ ভাবে উচিৎ … কুমারী পুজো থেকেই মনে করিয়ে দেওয়া পৃথিবীতে অনেক অসুর । সব চকলেট আদর করে ভালোবেসে দেয় না লোকে , কিছু অসুরও মনভোলানোর জন্য মিষ্টি কথা বলে , চকলেট দেয় ।
পিঙ্কি কিন্তু ছাড়েনি অসুরকে , কোথা থেকে এত জোর সাহস পেয়েছিল কে জানে । কুমারী পুজোর মন্ত্র গুলো ওর মনের ভেতর বসে গিয়েছিল হয়তো , সেই মন্ত্রবলেই মরতে মরতেও একটা ভাঙা লোহার রড সর্বশক্তি দিয়ে গেঁথে দিয়েছিল অসুরের পেটে । তৈরি হতে থাকা বাড়িটার ভেতরে ওকে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়াই কাল হয়েছিল লোকটার , ভাবতে পারেনি একটা আহত রক্তাক্ত বাচ্চা মেয়েও দুর্গা হতে পারে ।
এবারের পুজোয় কুমারী পাওয়া যাচ্ছে না আর , কিছুদিন আগে দেখা দৃশ্যটা সকলের মনে গেঁথে গেছে এমন । শেষমেশ উপায় না পেয়ে পিঙ্কির কুমারী সাজে ছবিটার পুজো করাই ঠিক হয়েছে পাড়ার সকলে মিলে । শরণ্যার অনুপ্রেরণায় যদি ঘরে ঘরে মেয়েগুলো দুর্গা হয়ে এমন অসুর বধ করতে শেখে । শরণ্যা নামটা কাউন্সিলর স্বয়ং দিয়েছিলেন , ইস্কুলে ভর্তি করার সময় তখন তো কেউ জানত না এমন করে সত্যি হবে নামকরণ । এবার থেকে এই পাড়ায় শরণ্যার ছবিতেই কুমারী পুজো হবে প্রতিবার ।
সর্বাণী রিঙ্কু গোস্বামী