কে দুর্গা? (ছোট গল্প) কলমে:- শিখা বিশ্বাস
কে দুর্গা? (ছোট গল্প)
কলমে:- শিখা বিশ্বাস
তখন শরৎ কাল। এক বুক অভিমান সরিয়ে আকাশে ভেসে উঠেছে পেঁজা তুলোর মেঘ। অবারিত অশ্রুধারায় ভেসে যাওয়া প্রকৃতির ম্লান মুখে যেন ফুটে ওঠে চিলতে হাসি! ছোট্ট দরমার ঘরখানিতে কোনমতে মাথা গুঁজে পড়ে থাকে মালতী এবং তার মা। সেখানে ষড়ঋতুর অবাধ বিচরণ। বর্ষায় খড়ের ছাউনি ভেদ করে যেমন অনায়াসে ঢুকে পড়তো ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিধারা, তেমনি শীতবুড়ি হিম কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে, তাদের ঘরে বইয়ে দিত হিমেল হাওয়া। এভাবেই প্রকৃতির ভালো-মন্দের সাথে একাত্ম হতে থাকে তারা। বাবা ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হতে হতে অকালেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। অগত্যা মা শহরে এক বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়েছেন। তাতেই কোন রকমে নুন ভাতে চলে তাদের ছোট্ট অভাবী সংসার।
শরৎ এসেছে! তাই সুরভিত শিউলি আর কাশফুলেরা যেন নবাগত অতিথি। চতুর্দিকে চলছে গড়া আর মেরামতির কাজ। পাশের গাঁয়েই দুর্গা ঠাকুর গড়া হতো। এক বুক আন্তরিকতা আর অফুরন্ত ভালোবাসা সাথে নিয়ে মালতী বন্ধুদের সাথে ঠাকুর গড়া দেখতে যেতো। অবাক হয়ে সে দেখতো কতো একাগ্রতার সাথে কিছু সাধারণ মানুষ ঠাকুর গড়ে চলেছেন। পরনে আধময়লা কাপড়, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, হয়তো আধপেটা খেয়েই বেড়িয়ে পড়েছেন কাজে। তবু ও কি অদম্য অধ্যবসায়! গড়ার নেশা! আসলে, সাধারণরাই বোধহয় সবটুকু উজাড় করে এমন ভাবে গড়তে পারেন। বড়ো হয়ে একদিন সেও দুর্গা ঠাকুর গড়বে, ভাবতে থাকে মালতী।
পাড়ার বড়োবাড়িতে প্রতিবছরই দুর্গোৎসবে মণ্ড মিঠাই তৈরি হতো। নতুন পোশাকের ঝলকানি! উল্লাসের ঘনঘটা রীতিমতো ওদের মনের আনাচে কানাচে!! মায়ের আঁচল ধরে বায়না করতে থাকে মালতী …..মাগো! সবার কত্তো নতুন জামা! আমার কেন নেই? নির্বাক মায়ের দু চোখ বেয়ে কেবলই জল গড়িয়ে পড়ে!
শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে মালতী। এবার সে দুর্গা ঠাকুর গড়বেই……
বাসনারা বাসা বাঁধে অবুঝ মন জুড়ে! সবটুকু নিষ্ঠা আর ভক্তি দিয়ে সে ঠাকুর গড়বে আর ভুবন ভোলানো রূপের সামনে সে প্রার্থনা করবে, এবার যেন তার একটা নতুন জামা এবং মায়ের নতুন শাড়ি হয়!!
বুকভরা বাসনা নিয়ে পথ চলতে থাকে আপনমনে। কিন্তু এ কি!! তার একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে নির্জন পথের বাঁকে একদল অসুর তাকে ঘিরে ধরে! হয়তো এক্ষুনি তার নিষ্পাপ শরীরের ওপর বসিয়ে দেবে ওরা মারন থাবা! বসিয়ে দেবে সবকটি বিষদাঁত! শিকার হাতে পেয়ে মেতে উঠবে পৈশাচিক হুল্লোরে! চিৎকার ভেসে যায় আকাশে বাতাসে!!
মায়ের কানে বোধহয় সন্তানের আর্তনাদ ঠিকই পৌঁছে যায়!মালতী ভয়ার্ত চোখে হঠাৎই দেখতে পায়, তার মা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়েছে তার সামনে প্রতিরোধ হয়ে! মায়ের এমন রূপ সে আগে কখনও দেখেনি। দু চোখে তাঁর ভয়ঙ্কর তেজ রশ্মি! কি আগুন গোটা অবয়বে! কি তেজ! কি শক্তি! সপাটে বসিয়ে দেয় কোপ নরখাদকদের ঘাড়ে, পিঠে! আরও একবার প্রমাণ করে নারী সকল শক্তির আধার!!
সেদিন ঘরে ফিরে ভেবে চলে মালতী …… যতোটা নিষ্ঠা আর ভক্তি দিয়ে সে ঠাকুর গড়ার কথা ভেবেছে, ততটা নিষ্ঠা ভরে মায়ের এতটুকু যত্ন ও সে করেনি কোনদিন। কখনও জানতে চায়নি মায়ের ইচ্ছা- অনিচ্ছা, ভালো- মন্দের কথা। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করা মায়ের ক্লান্তির খবরটুকু ও সে রাখে নি কখনও। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মা তাঁর উপার্জনের কিছু অংশ দিয়ে মেয়ের আবদার মিটিয়েছে। তার জন্য নতুন জামা কিনেছে! মালতী শপথ নেয়, এবার থেকে তার সমস্ত নিষ্ঠা, ভক্তি- প্রীতি সব উজাড় করে মায়ের সেবা করবে! আগামী দিনের অবলম্বন হবে! কারণ তার ‘ মা’ – ই যে তার কাছে আসল দুর্গা!!