বিশু কাকু…… কোজাগরী
বিশু কাকু……
কোজাগরী
দু একটা জিনিস কেনাকাটার জন্য বেরিয়ে ছিলাম।৷ টোটো থেকে নেমেছি। রেড সিগন্যাল।দাঁড়িয়ে আছি। এখন তো নেংড়ে নংড়ে চলতে হয়।তবুও হার মানবো না বলে নেংড়ে নেংড়ে যতটা হাঁটতে পারি, হাঁটি ।৷ পাশ থেকে ভেসে এলো এক কন্ঠস্বর ” বড় চেনা চেনা লাগছে যে” মুখ ঘুরিয়ে দেখি তোবড়ানো গাল,শিরা ওঠা বৃদ্ধ দুটি হাতে রিক্সার হ্যান্ডেল,পাকা পাকা চুল,উজ্জ্বল চোখ.. শৈশবের মুখের সাথে আজও মিল থাকায় আমায় চিনে ফেলা যায়। চেহারার বদল হলেও মুখ আর চোখের বদল আজও হয় নি। আমারও চিনতে কোন অসুবিধে হলো না বিশু কাকুকে। বুকের ভেতর আঁচড় দিয়ে উঠলো। ডেকে উঠলাম কাকু! কাকু! বললাম তুমি কেমন আছো?বিশু কাকুর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।৷ কাকুর গায়ে ক্রমাগত হাত বুলাচ্ছি আর এক কথাই বারবার আওড়াচ্ছি। বিশু কাকু বলতে লাগলো ভালো আছি।তার চোখ দুটিও যেন অশ্রুসিক্ত।
আমাদের শহর এক।আমাদের রাস্তাও প্রায়ই এক। অথচ বহু বছর দেখা নেই।দেখা হয়নি। ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত এই বিশু কাকু আমাকে আর গোপালকে স্কুল পৌঁছে দিতেন তাঁর রিক্সায়।জীবনের কতগুলো দিন তাঁর রিক্সা করে আলোর পথে যেতাম। তারপর মাধ্যমিক হয়ে যাবার পর কার্তিক কাকু নিয়ে যেতেন। কারণ যে স্কুলে পড়তাম সেই স্কুলের নদীর ধারে ছিলো বিশু কাকুর ঘর। বাবার সাথে খুব ভালো পরিচয় ছিলো বলে দূরে থাকা সত্ত্বেও কাকু আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতেন। কাকুকে দেখছি আর জলছবির মতো জ্বলজ্বল করে উঠছে প্রতিটি দিন। আসলে মানুষ তো কিছুই ভোলে না।সময়ের আস্তরণ পড়ে মাত্র।তাই কাকুকে দেখা মাত্রই সব কিছু ঝকঝকে। জীবনের ২৫ বছরে দুটো রিক্সারই ছিলো। একের পর এক বদল হয়নি আজকের মতো।
এঁনারাই সেই বিশু কাকু যাঁদের কাছে সহজে বায়না করা যায় বাবা মায়ের মতো। অকৃত্রিম স্নেহ, ভালোবাসা পাওয়া যায়। জীবনের শেষ দিন অব্দি সে গন্ধ লেগে থাকে।
গোপাল তো ছোট থেকেই খুব দুষ্টু ছিলো। বাবা ঘুরতে নিয়ে বেরোলেই রাস্তা কিনে দাও, গাড়ি কিনে দাও, এরোপ্লেন কিনে দাও, হারমোনিয়াম কিনে দাও, তবলা কিনে দাও, পুলিশের জিপ কিনে দাও, রকেট কিনে দাও, এমন কি বৌ কিনে দাও— এসব বলে তুমুল কান্নাকাটি জুড়ে রাস্তার মধ্যে শুয়ে পড়তো। একবার হয়েছে কি! বাবা অফিস থেকে ফিরে আমাদের পার্কে নিয়ে যাবে বলে বেরিয়েছে। রাস্তা দিয়ে আম্বাস্যাডার করে বৌ যাচ্ছে। সে বায়না ধরলো সে তখুনি বর হবে।আর তখুনি তাকে বৌ এনে দিতেই হবে।রাস্তায় সে কি কান্ড! লোকে দেখছে।তারপর ঘটনা শুনে সে কি হাসাহাসি। তখন গোপালের বয়স তিন বছর। আমার সব আজও স্পষ্ট মনে আছে।আমার তখন চার বছর বয়স।আমি খুব ছোট বেলা থেকেই সব স্পষ্ট মনে রাখতে পারতাম।কিন্তু কথা বলেছি অনেক দেরিতে।তারপর বাড়ি নিয়ে এসে বাবা এক প্রকার প্রতীজ্ঞা করে বসলেন যতদিন আর কিছুটা বড় না হচ্ছি,ততদিন অব্দি বাইরে নিয়ে বেরোবেন না ।
বড় হয়ে বুঝলাম বাবার প্রতীজ্ঞা যেন ভীষ্মের মতোই ছিলো। তারপর আর বাবার সাথে বেরোনো হয় নি। সেই যে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া বন্ধ হলো তারপর সেই কলেজে আর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময় বাবা নিয়ে গেছিলো।বাকি সব জায়গায় নিতে যেতো মা।গোপালের বায়নার জন্য ভীষ্মের ন্যায় প্রতীজ্ঞা করা বাবার সাথে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেছিলো এক প্রকার।
যাক সে সব কথা।৷ তবে বায়না করাটা গোপালের রক্তে মিশে গেছিলো।আমরা তো জমজ বলে দুজনে এক সাথে এক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। এক বছরের ছোট হলেও সব কিছু জমজ সন্তানের মতোই ছিলো। এক জামা,এক প্যান্ট, এক বই, এক ব্যাগ, ,এক খেলার জিনিস, সব, সব।৷ এমন কি এক জনের জ্বর, সর্দি,কাশি হলে অপর জনেরও হবেই। শৈশবে এক স্কুল হলেও ফাইভে উঠার পর দুজনেরই স্কুল আলাদা হয়ে গেছিলো। স্কুল আলাদা হলে কি হবে। রিক্সা এক।৷ একটাই বিশু কাকু।
ভাত খেয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে সামনে দিয়ে যাচ্ছে আইস্ক্রিমের গাড়ি।ওমনি গোপালের বায়না শুরু।কাকু আইস্ক্রিম খাবো।এখুনি কিনে দাও। বিশু কাকু ওমনি ট্যাকের ২৫ পয়সা বা ৫০ পয়সা ঝরিয়ে আমাদের দুজনকে আইস্ক্রিম কিনে দিতেন।বাড়ি ফেরার সময় তো কিনে দিতেনই।আইস্ক্রিম খেতে খেতে দুজনে বাড়ি ফিরতাম।কখনো কখনো চকলেটও। কখনো কখনো গোপালকে রিক্সায় উঠিয়ে বিশু কাকু আমায় নিতে আসতেন।গোপাল খিদে সহ্য করতে পারতো না ছোট থেকেই। আজও পারে না।আমি স্কুলের গেট থেকে বেরিয়েছি।রিক্সায় উঠে বসতেই গোপাল বলে উঠলো খুব খিদে পেয়েছে ভাত খাবো।৷ বিশু কাকু ওমনি দুজনকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে ভাত খাইয়ে বাড়ি নিয়ে যেতেন।
বাড়ি ফিরলে মা খেতে দেবে বললেই আমরা বলে উঠতাম কিছু খাবো না।পেট ভরা। মা বলতো পেট ভরা হবে কি করে।সেই কখন খেয়ে স্কুলে গেছি।তখন সব বলা হলে মা বকতো।তারপর বিশু কাকুকে বলতেন যেন এভাবে নিজের টাকা পয়সা নষ্ট না করে। যেন কিচ্ছু কিনে না দেয়। তা না হলে আমাদের বায়না করা থামবে না। বিশু কাকু চায়ের সাথে রুটি খেতে খেতে বলতেন আমি গরীব বলে এমন বলছেন বৌদি! আমারও দু বছরের একটি কন্যা সন্তান আছে।আমিও তাকে চকলেট কিনে দিই।আইস্ক্রিম কিনে দিই। মায়ের বলার আর কিছু থাকতো না। এমন সরল পবিত্র কথা শোনার পর কারোরই হয়তো কিছু বলার থাকে না।৷ কারণ এসব মানুষদের পয়সা না থাকলেও বিত্তশালী মানুষের চেয়েও হৃদয় অনেক অনেক বড়।তাতে সম্পদই সম্পদ। বিশু কাকু আমাদের এমনই এক মানুষ ছিলেন।
বড় হয়ে অনার্সের ক্লাসে যখন রবীন্দ্রনাথ “এর রক্তকরবী ” পড়ছি বিশু পাগলার মতো করে ভেসে উঠতো আমাদের সেই বিশু কাকু।আমি ছোট থেকেই ভীষণ আবেগ প্রবণ।আবেগ সংবরণ করতে আজও শিখি নি। অল্পতেই চোখে জল আসে।
ব্যস্ত সড়কে, ব্যস্ত রাস্তায়, ব্যস্ত কোলাহলে সেদিন বিশু কাকুর শিরা ওঠা হাতে হাত বুলাতে বুলাতে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।৷ সময়ের শিক্ষায় কঠিন হতে শিখে গেলেও,এখনও আবেগকে কিছুতেই রাশ পরাতে শিখি নি। তারপর কাকুকে বললাম বোন কেমন আছে? কাকু বললো বোন! কাকুর একটি মেয়ে ছিলো।তার চার বছরের জন্মদিনে আমাদের নিয়ে গেছিলো। আজও তা স্পষ্ট মনে আছে ।
হঠাৎ দু তিনদিন কাকু আসছে না দেখে বাবা বিশু কাকুর বাড়ি যায়। জানতে পারেন মহানন্দার জলে খেলতে খেলতে বাচ্চা মেয়েটি তলিয়ে গেছে। পরে আমাদের নিতে এসে কাকু মায়ের সামিনেঅঝোরে কেঁদেছিলো।কাকুকে কাঁদতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো বোনটিকে যদি খুঁজে এনে দিতে পারতাম!
কাকুকে বললাম সরি কাকু।এক মুহূর্তে সব ভুলে গেছিলাম। বুদ্ধিমানের মতো ভ্যান করে প্রসঙ্গ পালটে কাকুকে বললাম আর সবাই কেমন আছে? কাকিমা! কাকু বললো ভালো আছে।এদিকে সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো।কাকুকে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে আসতে বললাম।সমস্ত টোটো অটো চলতে শুরু করেছে।একটি রিক্সাই শুধু ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও জোড়ে জোড়ে হাঁটার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। খুব ইচ্ছে করছে কাকুকে এক কাপ চা খাওয়াতে।পেট ভরে ভাত খাওয়াতে।৩৪ নং জাতীয় সড়ক।দাঁড়ানো বা দৌড়োনোর অবস্থা নেই।নেংড়া চলা মানুষ ধরতে পারছে না বিশু কাকুর রিক্সার গতিকে।বিশু কাকু ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি শিরা ওঠা হাতে,তোবড়ানো গালে,পাকা চুল নিয়ে এক বৃদ্ধ ছুটে চলেছে।তার ক্লান্তি নেই।যুবক বিশু কাকু এক নিমিষে বুড়ো হয়ে গেছে।কত কম সময়ে মানুষের দেহ বুড়ো হয়ে যায়! এই তো সেদিনের যুবক বিশু কাকু!
বাড়ি ফিরে আসলাম বিশু কাকুর সমস্ত স্মৃতি সাজিয়ে।কাঁদতে কাঁদতে গোঁসাইকে বিশু কাকুর সত্য গল্প শোনালাম। গোঁসাই বললো জীবনের এই সত্য গল্পগুলো নিয়ে একটি সিরিজ লিখে ফেলতে।
সারা রাত ধরে স্বপ্নে বিশু কাকুর বিচরণ ভূমিতে জল পড়তে থাকলো। ভেতরে এক অপূর্ণ সাধ নিয়ে বসে আছি, বিশু কাকুকে এক কাপ চা খাওয়ানোর জন্য।৷ নিজের হাতে রান্না করে ভাত খাওয়ার জন্য। নিজের কাছে এনে রাখার জন্য।যে হাত এই বয়সে আর রিক্সার হ্যান্ডেল ধরবে না। কিন্তু জানি এও স্বপ্নের ন্যায়।
জানিনা বিশু কাকুর সাথে আর দেখা হবে কিনা! জানিনা বিশু কাকু বা বেলি মাসির মতো মাসিরা আজ আছে কিনা! জানিনা আজ তাঁরা নিজের ট্যাকের পয়সা দিয়ে বাচ্চাদের বায়না মিটিয়ে আনন্দ পান না।স্নেহ, ভালোবাসা বিলোনো বিশু কাকুরা আজও নিশ্চয় কোথাও না কোথাও আছে তাই না! জানি না আজ সেইসব মায়েরা বিশু কাকুদের সাথে সন্তানদের পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন কিনা!
এসব বিশু কাকুরা, বেলি মাসিরা কত কিছু দিয়ে যায় জীবনে । সামান্য অথচ মূল্যহীন। তারপর একদিন ভিড়ের মধ্যে হারিয়েও যায়।
বিশু কাকুর সাথে ব্যস্ত সড়কে একটা সেল্ফি তোলা হয় নি।আজ তো সব কিছু বদলেছে।আমরা মুহুর্তকে সেল্ফিতে বন্দী করতে শিখে ফেলেছি।বিশু কাকুর সাথে সেল্ফি তুলতে পারি নি।কিন্তু মনের ভেতর সাজিয়ে রেখেছি নৈবেদ্য।
বিশু কাকুর ঠিকানা আজ মনে নেই।শুধু মনে আছে স্কুলের নদীর ধারে বিশু কাকুর ঘর ছিলো।ঠিক করেছি এবার পুজোতে এক দিন মহানন্দার ধারে গিয়ে বিশু কাকুকে খুঁজবো।৷ পাবো নিশ্চয়!
বিশু কাকুকে খুঁজতে খুঁজতে হয়তো অনেক গুলো বিশু কাকুদের দেখা পাবো! পুজো সার্থক হবে!