ভাতিন্ডা — কোয়েলী ঘোষ

মন দে উড়ান — পর্ব ২

ভাতিন্ডা
কোয়েলী ঘোষ

পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। হোটেলের সামনেই রামকৃষ্ণ মিশন । তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে মন্দির গিয়ে ঠাকুর ,মা আর স্বামীজিকে প্রণাম জানিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা গাড়িতে ভাতিন্ডা ফলস্-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ।
ধানবাদ থেকে ১৪ কিলোমিটার পথ । শহরের ঘর বাড়ি ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে । দুদিকে গাছ পালা , গ্রামের মেঠো পথ পেরিয়ে একসময় টেটঙ্গাবাদের “বিনোদ বিহারী নহতো” পার্কের বড় গেটের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি নির্জন এক স্থান গাছপালার মধ্যে দিয়ে এক পথ গিয়েছে । একটু হাঁটার পর জলপ্রপাতের শব্দ কানে এলো ।
সামনে এগিয়ে এসে স্তম্ভিত আর মুগ্ধ এক অপরুপ দৃশ্যের সামনে ।

পাথুরে পথ দিয়ে নেমে আমরা সবাই কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম । তিনটি ধাপে জলপ্রপাতটি উচ্ছ্বসিত ধারায় নেমে আসছে । এই বরষায় স্রোত বেশ গভীর আর ঘূর্ণির মত গোল হয়ে সমতলে নামছে । এক একটি ধাপে নেমে একটা পুকুর তৈরি হয়েছে ।
মেয়েরা অতি উৎসাহে ছবি তুলতে শুরু করেছে । কেউ বা জলের দিকে পা ডুবিয়ে বসেছে । তখন স্থানীয় একজন মানুষ এসে বারণ করলেন – ” কেউ জলে নামবেন না ।এই ঘূর্ণি স্রোতে অনেক বিপদ ঘটে । একবার তলিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না । ”
জলে স্নান করার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু এই সাবধানতার পর স্রোতে নামার আর কোন উপায় নেই । নানা ভাবে এই সুন্দরী ঝর্ণা কে ক্যামেরাবন্দী করে আমরা ফিরে এলাম । মাথার ওপর তখন সূর্যের প্রখর তেজ । চারিদিকে সবুজ গাছ , অজানা ফুল , পাখিদের কূজন ভরা শহরের এত কাছাকাছি এত সুন্দর এক জলপ্রপাত আছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । একটি মাত্র দোকান থেকে জল আর লজেন্স কিনে গাড়িতে এসে বসলাম । গাড়ি আবার হোটেলের দিকে রওনা দিল ।

উশ্রী_জলপ্রপাত
ভাতিন্ডা থেকে হোটেলে ফিরে স্নান, খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। আজকেই ফেরার দিন আর যাবার পথে দেখব উশ্রী নদীর ঝর্ণা । সেই কোন ছোটবেলায় পড়া সহজ পাঠের উস্রী নদীর ঝর্ণা দেখতে যাব পড়েছিলাম ।
ধানবাদ থেকে দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার । কয়লা , অভ্র , আর তামায় সমৃদ্ধ এই গিরিডি । অদূরে খান্দলি পাহাড় ।আরও দূরে দেখা যায় পরেশনাথের মন্দির ।
সোনালী রোদ ভরা রাস্তার দু’ দিকে ঘন নীল পাহাড়, সবুজ অরণ্যের ক্যানভাস , কাশের সারি দেখতে দেখতে প্রবেশ করলাম গিরিডি জেলায়।

৩৯ ফুট উচ্চতার বিস্তীর্ণ পাথরের চাতাল থেকে সশব্দে আছড়ে পড়ছে অবিশ্রান্ত জলরাশি তিন ধারায় । বরষায় স্রোত বেশ তীব্র । খণ্ড খণ্ড পাথরে সাবধানে পা ফেলে ফেলে আমরা ঝর্ণার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি । একটি সমান পাথরে বসে দেখছি এই উশ্রী নদীর ঝর্ণা ।
” ঝরো – ঝরো – ঝরো – ঝরো ঝরে রঙের ঝরনা
আয় – আয় -আয় -আয় সে রসের সুধায় হৃদয়
ভর -না ” ..

বেশ কিছুটা সময় আনন্দে কাটিয়ে , ছবি তুলে আবার ফেরা , সেই চেনা পথ ধরে বাড়ির দিকে কিন্তু মন মাঝে মাঝে উড়ান দেয় সেই ঝর্ণা ,নদী পাহাড়ের নির্জনতায় । যেন একলা বসে আছি স্তব্ধ আর হাজার কলস্রোতে ঝর্ণা নামছে … অনর্গল সে কথা বলে যায় …..সুরে সুরে ছন্দে ছন্দে আনন্দগান গেয়ে যায় ….

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *