দুর্গা দুর্গতিনাশিনী (প্রবন্ধ) মীনা দে

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

দুর্গা দুর্গতিনাশিনী (প্রবন্ধ)
মীনা দে

শরতের সোনাঝরা রোদ শিউলি ফুলের রং বাহার আর কাশ ফুলের মৃদু মন্দ হিল্লোল বয়ে নিয়ে আসে আনন্দময়ী মায়ের আগমন বার্তা। মা আসছেন।
দুর্গা দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ যিনি বিপদ নাশ করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান মতে দুর্গা শব্দের মধ্যে দুর্গ এবং আ এই দুটো শব্দ আছে। দুর্গ শব্দের অর্থ বিপদ এবং আ শব্দের অর্থ নাশ করা। অর্থাৎ তিনি বিপদ নাশিনী। আবার স্কন্দ পুরান মতে দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেন বলে তাঁর নাম দুর্গা । দুর্গা মুর্তির মধ্যে এই ভাবটিই প্রচ্ছন্ন রয়েছে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির সংগ্রাম এবং শুভ শক্তির জয়।
শাস্ত্রের ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন বাংলার প্রতিটি নরনারীর জন্য মা দুর্গা বহন করে আনেন খুশির সম্ভার। আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায় মনোনদীর দুকুল বেয়ে। মায়ের পুজাকে কেন্দ্র করে আবালবৃদ্ধবনিতা গতানুগতিক জীবন ধারা থেকে কিছুটা হলেও সরে এসে নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। বাঙ্গালীর এই দুর্গোৎসব শুধু মাত্র আনন্দানুষ্ঠানই নয়, তা গভীর তাৎপর্যপূর্ণও বটে। দুর্গাপুজার প্রাক্কালে চন্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবী মাহাত্মের আলোচনা হয়। দেবীদুর্গার অসুর বধের তাৎপর্য যেমন শুভ আর অশুভ শক্তির সংগ্রাম। মানবের অন্তঃরাজ্যেও চলছে তেমনি এক সংগ্রাম । রিপুগুলির মধ্যে সংগ্রাম। কাম ক্রোধ লোভ মোহ ইত্যাদি রিপুগুলি প্রতিনিয়ত আমাদের জীবন অতিষ্ট করে তুলছে। অসুর রূপি এইসকল রিপুগুলি জয় করতে হলে দরকার সমস্ত দেবতা সম্মিলিত শক্তি সেই মহশক্তি বা মহামায়ার আরাধনা। আসলে যার অর্থ—সহ‍্য, ধৃতি, দয়া মায়া, ক্ষমা , এই গুণ গুলি হৃদয়ে লালন পালন করা।
আশ্বিনের শুক্ল পক্ষের ষষ্টি তিথিতে হয় দেবীর বোধন। পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করে দেবীকে প্রতিবোধিত করেন অর্থাৎ জাগরিত করেন। কারণ এই সময়টা দেবতাদের শয়ন কাল। কিন্তু রামচন্দ্র দেবীকে অকালে জাগরিত করে তবেই তার পুজা করে ছিলেন রাবণ বধের উদ্দশ্যে। তার পর থেকেই এই পুজা চলে আসছে। সপ্তমী তে ঘট স্থাপন করে দেবীর পুজো শুরু হয়।

শারদীয়া দুর্গা পুজা সার্বজনীন পুজা সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সহযোগীতা আদান প্রদান এবং যোগাযোগেই এই উৎসব সাফল্য মন্ডিত হয়। কুমোর কামার চাষী বস্ত্র ব্যাবসায়ী বাঁশের কারবারী খড়ের আড়তদার রঙ দড়ি ইত্যাদির ব্যাপারী বাজনদার মুদীখানার মালিক ফুল ফলের ব্যাবসায়ী ইত্যাদি আরও কত কি এমন কি পতিতাপল্লীর মাটিও লাগে দেবীর মহাস্ননের জন্য। মা যে সকলের মঙ্গল কারিনী করুণাদায়িনী জগৎজননী।

খই, থেকে শুরু করে নারকেল ইত‍্যাদি এমন কোনো কিছু নাই যা পুজোয় লাগে না। এই সময় সবাই যে যা কিছু কর্মের সাথে যুক্ত থাকুক না কেন বাড়তি কিছু টাকা বোনাস হিসেবে পেয়েই যায় যেন মা স্বয়ং সব ব‍্যবস্থা করে রাখেন। নতুন জামা কাপড় নতুন জুতো । জুতো পরে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়েনি এমন বোধ হয় দু একজনকে খুঁজলে পাওয়া যাবে। পুজোয় অঞ্জলি দেওয়া আর ভোগ খাওয়ার যে মজা তা আর কিছু তে নেই। মা বাবা কাকা জ‍্যাঠা পিসি মাসী সকালের সাথে দেখা হওয়ার যে আনন্দ সেটা অবশ‍্য ধীরে ধীরে কমে আসছে।তবে গ্ৰামে গঞ্জে যাত্রাপালার রেওয়াজ এখনও আছে।

দুর্গা প্রতীমার মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। প্রতীমা যত সুন্দর হয় যত মনোহারী হয় ততই যেন বেশি করে প্রতীমার সান্নিধ্য লাভ হয় বলে মনে হয়। পূজকের পুজার গুণে পুজার বিধিবদ্ধ আয়োজনে প্রতিমার সুন্দর গড়নেই পুজার সার্থকতা। দেবী দশ হাতের দশটি অস্ত্র দ্বারা দশদিকের কোটি কোটি সন্তানের জীবন রক্ষার্থে শত্রুবিনাশ করে চলেছেন। অসুর নিধন যেমন অশুভ শক্তির বিনাশ তেমনি দেবীর দুই পাশে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক এবং গনেশের অবস্থান যেন দেবী দুর্গার আধারাস্থিত বিত্ত বিদ্যা সন্তান এবং সিদ্ধির বহিঃপ্রকাশ।
হিন্দু ধর্মে দেবতার থেকেও একজন দেবীকে বেশী করে মহিমামন্ডিত করা হয়েছে। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর পৃথক পৃথক ভাবে সৃষ্টি স্থিতি এবং বিনাশের দেবতা কিন্তু দেবী দুর্গা এই ত্রিশক্তির সমষ্টিগত রূপ। মন্ত্রে আমরা পাই সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানাং শক্তি ভূতে সনাতনি অর্থাৎ ত্রিশক্তির আধারভূতা দেবী দুর্গা ।
দিন যত বদলাচ্ছে তত বদলাচ্ছে মানুষের মন মানুষের স্বভাব এবং আচার আচরণ । আনন্দময়ী মা সকলকে আনন্দে রাখবেন এটাই তো আমরা চাই। কিন্তু যখন পুজো প‍্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে দেখি একজন শতছিন্ন শাড়ি পরনে কোন ভিখারিনীকে উলঙ্গ শিশু কোলে অথবা খালি গায়ে বেশ কয়কটি শিশুকে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে ,তখন মনটা বড়ই বিষন্ন হয়ে যায়। সত‍্যিই তো এদের কাছে এই বিশেষ দিনের কি মূল‍্য, মা তো সকলের মা। তাহলে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *