জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া🇩🇪 সায়ন্তন ধর (প্রথম পর্ব)
জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া🇩🇪
সায়ন্তন ধর
(প্রথম পর্ব)
🇩🇪”Nicht alles, was Gold ist, funkelt,
Nicht jeder, der wandert, verlorn,
Das Alte wird nicht verdunkelt,
Noch Wurzeln der Tiefe erfroren.
Aus Asche wird Feuer geschlagen,
Aus Schatten geht Licht hervor;
Heil wird geborstenes Schwert,
Und König, der die Krone verlor.
[All that is gold does not glitter
Not all those who wander are lost
The old that is strong does not wither
Deep roots are not reached by the frost.
From the ashes a fire shall be woken
A light from the shadows shall spring
Renewed be the blade that was broken
The crownless again shall be king.]”🇩🇪
সময়টা ২০০২ সাল, জাপানের ইয়াকোহামা স্টেডিয়ামে চলছে ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনাল। মুখোমুখি ব্রাজিল ও জার্মানি। সেই প্রথম টিভিতে ফুটবল খেলা দেখা। জার্মান গোল পোস্টের নিচে দীর্ঘদেহী, সোনালী চুল, নীল চোখের অলিভার কানকে দেখে জার্মানির সাপোর্টার হয়ে যাওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই ম্যাচে হেরে যায় জার্মানি। কিন্তু আমার সাপোর্ট বদলায় না। আসলে তখনও খেলা সম্পর্কে অতটা ধারণা আমার হয়নি। এরপর ২০০৬ এর বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল জার্মানিতেই। সেবারও সেমিফাইনালে ইটালির কাছে হেরে তৃতীয় স্থান অর্জন হল। চার বছর পর আবারো সেই সেমিফাইনালে স্পেনের কাছে আটকে যাওয়া। তবে মানতেই হবে যে কয়েকটি দলের কাছে তারা ফাইনালে বা সেমিফাইনালে হেরেছে তারাই সেবারের মত বিশ্বকাপ নিয়েছে। জার্মানির বিশ্বকাপের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখলাম বিশ্বকাপের অন্যতম সফল দল তারাই। ১৯৫৪, ১৯৭৪ ও ১৯৯০ এই তিনবার তারা বিশ্বকাপ জয় করে, তাছাড়া আরও চার বার তারা রানার্স হয়েছে, চারবার তৃতীয় স্থান ও একবার চতুর্থ স্থান লাভ করেছে। ২০১৪ সালে প্রথম থেকেই ভীষণভাবে চেয়েছিলাম সেবার যাতে জার্মানি বিশ্বকাপ জেতে, জিতেওছিল। সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে ৭ গোলের মালা পরিয়ে, ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তোলে আমার প্রিয় জার্মানি। আমার যে কত বড় আক্ষেপ সেমিফাইনালের পরের দিন প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা দিতে ২০০ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে রায়গঞ্জ যেতে হবে আর ভোরে উঠতে হবে দেখে গভীর রাতে হওয়া সেমিফাইনালের রোমাঞ্চকর ম্যাচ লাইভ দেখতে পারিনি। ভোরে উঠে নেট খুলে স্কোর দেখতে গিয়ে ঘুম চোখে বিভ্রম জাগে, বুঝি জার্মানী জিতেছে কিন্তু কত গোলে ? খেলাটা কি টাইব্রেকারে গিয়েছিল এসব প্রশ্ন ভীড় করে। তারপর যখন কনফার্ম হলাম ওটা ৯০ মিনিটের রেজাল্ট তখন আনন্দ দেখে কে। দুপুর নাগাদ রায়গঞ্জ পৌঁছে পড়ার বই ছেড়ে হোটেলের টিভি খুলে বসলাম। বাবারও প্রশ্রয় ছিল ষোলো আনা। হাইলাইটস দেখলাম ২ বার। রিপ্লে ১ বার। পরের দিন পরীক্ষা শেষে আরও একবার রিপ্লে। বাড়ি ফিরেও রিপ্লে দেখেছি। তারপর প্রতি বছরেই এই দিনটায় বা অন্য যেকোন দিন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছি এই ম্যাচের ছোট্ট ভিডিও গুলি। আজ যা ৭ বছর পরেও অমলিন। ২০০২ তে শিশুমন ২ গোলের আঘাতে যতটা আঘাত পেয়েছিল এ যেন তারই প্রত্যাঘাত। এই সাত বছরে আরো একটি বিশ্বকাপ এবং দুটি ইউরো কাপ হয়ে গেছে। আমার জার্মানি ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু জার্মানরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স হয়ে উড়তে জানে।
কোন জাতি বা দেশের উত্থান-পতনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে গেলে প্রথম যে দেশটি বা জাতির কথা মনে পড়ে তা হল জার্মানি ও জার্মান। ইতিহাস স্তব্ধ অতীন নয়। ইতিহাস চির-মুখর। যুগ-যুগান্তর ধরে মানব-সভ্যতার চলমান জীবনধারাই ইতিহাস। সেই চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে আছে কত শত ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের অর্ধলুপ্ত অবশেষ। কত রক্ত-রঞ্জিত দৃশ্যপটের পরিবর্তন। কত নিশীথকালে দুঃস্বপ্ন-কাহিনী। কত উত্থান-পতন, কত চেষ্টার তরঙ্গ, কত সামাজিক বিবর্তন। আজ যা বর্তমান, কালই তা অতীত। ইতিহাস ত্রি-কাল-সূত্রে গ্রথিত। ইতিহাস তো অতীতেরই সত্য-স্বরূপ উদ্ঘাটন, এক অনন্ত মানব-জীবন প্রবাহের অনির্বাণ দীপ-শিখা। ইতিহাস অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের সাধনা, ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। জার্মানিকে জানতে হলে জানতে হবে তার ইতিহাস। পৃথিবীর আদি মানব নিয়ান্ডার্থল বা হেইডেলবার্গ মানুষের বসবাস ছিল ২৫০০০০-৪০০০০০ বছর আগে। জার্মানিক জাতির অনেকগুলি শাখার একটি হলো জার্মান জাতি। খ্রিস্টান যুগের আগে স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে জার্মানিক জাতির মানুষ বাল্টিক সাগর তীরবর্তী ভিস্চুলা নদীর মোহনায় বসবাস স্থাপন করে। এর সাথে সাথে পশ্চিম ইউরোপে বসবাসকারী জার্মানরা রাইন নদীর পূর্ব তীরে কেল্টসদের পর্যদুস্ত করে বসতি স্থাপন করে। ১৫০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ইউরোপে বসবাসকারী জার্মানরা কার্পেথিয়ান পর্বত পেরিয়ে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলে বসতি স্থাপন করে। এই সময় রোমান ও হান আক্রমণের ফলে অস্ট্রগথ ও ভিসিগথরা একত্রিত হয় এবং দানিয়ুব নদীর তীরে বর্তমান বুলগেরিয়ায় স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলে। জার্মানিক জাতির অপর শাখাগুলি হল বার্গেন্ডিয়ান (স্পেন), ভ্যান্ডাল ও অ্যালান (স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা), ফ্রাঙ্ক ও আলেমান (ফ্রান্স ও জার্মানি), অ্যাঙ্গেল ও স্যাক্সন (বৃটেন), লম্বার্ড (হাঙ্গেরী)। ৪৮২-৮১৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান জার্মানি ফ্রাঙ্কিশ রাজত্বে ছিল। পশ্চিম ফ্রাঙ্কিশ হলো বর্তমান ফ্রান্স ও পূর্ব ফ্রাঙ্কিশ হল বর্তমান জার্মানি। ৯১৯ সাল থেকে স্যাক্সনরা দখল করে নেয় পূর্ব ফ্রাঙ্কিশ। এরপর ক্ষমতা বদল হয় স্যাক্সন থেকে স্যালিয়ান ও তাদের থেকে হহেনস্টফেনের হাতে। ত্রয়োদশ শতকেও জার্মানির কোন রাজধানী শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। জার্মান দার্শনিকেরা শিক্ষা গ্রহণ করতেন তৎকালীন ইউরোপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্যারিসে। এরপর আবার চতুর্দশ শতকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়- লুক্সেমবার্গ, উইটেল্সব্যাচ, হাব্সবার্গের মত আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং সাইলেসিয়া, বাভারিয়া, বোহেমিয়া, বার্গেন্ডি অঞ্চলগুলি পরিচিতি পায়। এই সময়কার জার্মানিকে দেখলে অনেকটা অসংখ্য ছোট ছোট দেশীয়রাজ্যে বিভক্ত প্রাচীন ভারতের সাথে মিল পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ (পর্তুগাল, স্পেন, হল্যান্ড, ব্রিটেন, ফ্রান্স) নতুন দেশ আবিষ্কার ও উপনিবেশ স্থাপনে পাড়ি জমালো দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। শুধু ঘুমিয়ে রইল জার্মানি। এমনকি ১৬৪৮-১৮০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানির ঐক্য ব্যাহত হয়, সার্বভৌমত্ব হারিয়ে কমবেশি ৩০০ টি ছোট-বড় অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায় তারা। নেপোলিয়নের আক্রমণের পর রাইনের পশ্চিম অংশ ফ্রান্সের করায়ত্ত হয় এবং জার্মানিতে প্রাশিয়া সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এরপর ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপে রেনেসাঁ দেখা দিল। জার্মানিতে রূঢ় নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে W.T. Mulvany গড়ে তুললেন রূঢ় শিল্পাঞ্চল। জার্মান কনফেডারেশনের রাজধানী হল বার্লিন। ফ্রাঙ্কফুর্ট, মিউনিখ, লিপজিগ, ডুসেলডর্ফ, ডর্টমুন্ড, গেলসেনকার্সেন, কোলগনে শিল্পোন্নত শহরে পরিণত হল। হামবুর্গ, ব্রেমেনের মত বৃহৎ বন্দর গড়ে উঠলো। ব্র্যান্ডেনবার্গ জলপথে বাষ্পচালিত জাহাজ চলল। হ্যানোভার, বার্ন্সউইক, ব্যাডেনে বসল রেলপথ। রাইন, এলব, ওডার, ভিস্চুলা, দানিয়ুব প্রভৃতি নদীগুলি আন্তর্জাতিক জলপথে পরিণত হল। এরপর ১৮৭১-১৯১৪ সালের মধ্যে বিশ্বের শিল্পক্ষেত্রে আমেরিকা ও বৃটেনের সমকক্ষ হয়ে উঠল জার্মানি। এতদিন শুধু কয়লা, লৌহ ও বস্ত্র বয়ন শিল্পে উন্নতি করলেও এই সময়কালে তারা রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক শিল্পে উন্নতি করে এবং রপ্তানি বাণিজ্যও বৃদ্ধি পায়। জার্মানিতে সেসময় ইন্টারনাল কম্বাস্চন ইঞ্জিন, ডিজেল ইঞ্জিন, অটোমোবাইল, ছাপাখানা, ইলেকট্রিক ডায়নামো ও ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন আবিষ্কার হয়। ১৮৪৮ সালের মে মাসে ফ্রাঙ্কফুর্টে একটি অ্যাসেম্বলিতে প্রস্তাবনা গ্রহণের ডাক দেওয়া হয়। অনেক মতবিরোধের মধ্য দিয়ে ১৮৬২ সালে বিসমার্ক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং ইতালি-জার্মানি-অস্ট্রিয়া অ্যালায়েন্স গঠন করে। ১৮৮০ সাল থেকে জার্মানি সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে। আফ্রিকা মহাদেশের টোগোল্যান্ড, ক্যামেরুণ, নামিবিয়া, তাঞ্জানিয়া দখল করে নেয়। উপনিবেশ স্থাপন করে ওশিয়ানিয়ার পাপুয়া নিউগিনির উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিসমার্ক দ্বীপপুঞ্জ ও কিছু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে। ১৯১৪ সাল নাগাদ জার্মানিতে বৃটেনের সমতুল্য কয়লা উত্তোলন হত ও বৃটেনের দ্বিগুণ পরিমাণ স্টিল উৎপাদন হতো। এই সময় জার্মান শিপইয়ার্ড ৪০০০০০ টন বাণিজ্য তরীর পাশাপাশি যুদ্ধজাহাজও তৈরি করেছিল। কিন্তু এই সময়েই বিশ্বের তাবড় দেশগুলি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। চার বছর ব্যাপী এই মহাযুদ্ধে জার্মানি ও তার অ্যালায়েন্স মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে পরাজয় বরণ করে। কাইজার যুগের অবসান হয়। যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করে ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভার্সাই চুক্তি শুধু অপমানজনক ছিল তাই নয়, এর ফলে জার্মানির সমৃদ্ধ রূঢ় শিল্পাঞ্চল ফ্রান্সের করায়ত্ত হয়। এর মধ্যেই বপন করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ।
(ক্রমশঃ)
©✍🏼 সায়ন্তন ধর
২৩/০৮/২০২১🇩🇪
খুব সুন্দর লেখনী, অপূর্ব সূচনা … পরের পর্বগুলির অপেক্ষায় রইলাম।
অনবদ্য তথ্য সমৃদ্ধ পর্যালোচনা। অবশ্যই আমার অন্যতম প্রিয় দল জার্মানি। যদিও ব্রাজিল ই আমার সবচেয়ে প্রিয় দল। জার্মানি চিরদিন ই এক লড়াকু জাতি। বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত হওয়ার পরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ঈর্ষান্বিত ভাবে। স্যালুট জানাই। আর তোমাকে রইল অন্তহীন শুভ কামনা।