বিভ্রম —— তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

বিভ্রম
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

রাতে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকালেই বুক ঢিপঢিপ করে আর গলা শুকিয়ে আসে নীলি’র। একলা থাকা শহরে, গ্রাম থেকে এসে তায় বাড়ি নয় ফ্ল্যাটে, একটা কেমন দম বন্ধ করা লাগে সবসময়। দিনে যাহোক তাহোক কেটে যায় সময় পাশের অন্যান্য ফ্ল্যাটের আন্টিদের সাথে গল্প করে। সন্ধের পর টিভি আর বই পড়া। খেয়ে শুলেও ঘুম আসেনা। সারাদিন ঘরে থেকে এটা হয়েছে। পরিশ্রম হয়না ত্যামন। একাই থাকা বেশির ভাগ। হাসব্যান্ড অফিস ট্যুরে বাইরে থাকেন বেশি। একা একা অলস সময় কাটানো যে কি মুশকিল না ভুগলে বোঝা যায় না। কি আর করা!! মানিয়ে নেবার চেষ্টা।

রাতে আলো নিভিয়ে শুলেই চোখ চলে যেত ফ্যানের দিকে। সামনের রাস্তার আলো পর্দা ভেদ করে আবছা ভাবে চলে আসতো ঘরে। কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হতো। আর ঐ হালকা আলোয় ফ্যানের ব্লেডে কি অদ্ভুত একটা আলোর ঘুর্ণন হতো যা এর আগে কখনও দ্যাখে নি নীলি।

 

বিয়ের আগে তো তার জীবন গ্রামেই কেটেছে। গাছপালা ঘেরা বিশাল জায়গার একপাশে বাড়ি। আলো নিভে গেলে শুধু অন্ধকার। এরম অদ্ভুত জিনিস দ্যাখে নি কখনও।

বিয়ের পর গ্রাম থেকে সটান শহরে, শহর মানে রাজধানী তিলোত্তমা। এখানে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেও বড় রাস্তার আলো চলে আসে ঘরে। ভয় পায় নি সে কোনোকালে তবে বিয়ের পর কলকাতা আসার সময় বাড়ির আদিবাসী কাজের বৌটা বলেছিল যে জানলার ধারে একদম যাবি না। কলকাতায় ভুত ঘোরে দিনেও। তোকে টেনে নিয়ে চলে যাবে আর ফিরতে পারবি না। তখন হাসলেও এখন আর হাসি নেই বরং রাতের অন্ধকারে আলো আর পাখার একটা কারিকুরি দেখে বেশ ভয়ই করে। পাখার সুইচ অফ করলেই আর হয় না ঐ ভৌতিক ব্যপার টা। দরদরিয়ে ঘামলেও ফ্যান আর অন করে না নীলি।

পরদিন ভোরে বাড়ি আসে ওর হাসব্যান্ড। পেশায় ইলেকট্রনিকস্ ইঞ্জিনিয়ার। নীলি’র ঐ ঘামে ভেজা ভয়ার্ত দশা দেখে জিজ্ঞেস করে কারণ, তখন নীলি ভয়ের কথা আর ফ্যান অফ করে থাকার কথা বলে। সব শুনে হো হো করে হেসে ফ্যালে ওর হাসব্যান্ড। পাশে টেনে বসিয়ে নতুন বৌ কে বলে,’ আজ আমি দেখব কেমন ভুত, তারপর কি করা যায় দেখি’

আশ্বস্ত হয়ে নীলি ঘরের কাজে মন দেয়। খুব ভালো লাগে সারাদিন। আজ আর একা নয় তাই অলস সময় নেই। সন্ধ্যার পর রাত হয়। রাতের খাবার খেয়ে শোবার পালা। ঘর অন্ধকার করে শোয় দুজনে। এবার ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে নীলি আবার ঐ ঘটনা। রাস্তার আলো আর ফ্যানের সেই ভৌতিক খেলা। বরকে আস্তে আস্তে ঠেলে ফিসফিস করে বলে, ‘ঐ দ্যাখো আবার হচ্ছে’। ঘুম চোখে ফ্যানের দিকে তাকায় নীলি’র হাসব্যান্ড। তারপর নীলি কে জড়িয়ে ধরে বলে,’ এটা ভৌতিক নয়, বিজ্ঞান। stroboscopic effect of light, বাইরের আলো এসে ফ্যানের উপর পড়েছে আর ওর ব্লেডগুলো ঘুরছে বলে এরম হচ্ছে, it’s very normal, ঘুমাও’

সব জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে নীলি হাসব্যান্ড এর বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *