আমার চিত্রগ্রীব এবং অন্যান্য @ গৌরী মৃণাল
আমার চিত্রগ্রীব এবং অন্যান্য
@ গৌরী মৃণাল
এই লকডাউনের কালে বেশ অনেক কিছু দেখার সময় পেলাম আর দেখতে পেলামও। বাইপাসের অনর্গল গাড়িস্রোত এখন স্তিমিত। অষ্টপ্রহর শব্দের ছাপ্পান্ন ভোগ আর বিকট হর্ণের দুর্ভোগ থেকে কয়েকটা মাস যেন অব্যাহতি পেয়েছি। কোলাহল তো বারণ হল,এবার কথা কানে কানে,- তাই এতদিনের দুয়োরানি প্রকৃতি যেন কাছে এসে ভুরু নাচিয়ে বলছে , – এতদিন কোথায় ছিলে ! আবাসনের গাছগুলো ঝলমল করে উঠছে অভিসারী আলোয় , কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আকাশে তাকিয়ে বলছে,’দেখো দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায় ‘! … কত যে পাখি সেজেগুজে সেই উৎসবে যোগ দিতে চলে আসছে! প্রিয় লেখক Ruskin Bond সাহেব কোথায় যেন বলেছিলেন, – “Live close to nature and you’ll never feel lonely. Don’t drive those sparrows out of your veranda; they won’t hack into your computer.” আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সেকথা।
যখন যেখানে থাকি, আমার বাসগৃহের একটা বারান্দা বা ব্যালকনির এক পাশে একটা জায়গা তৈরি করে পাখিদের জন্য দানাপানির থালা আর জলের বাটি ফিট্ করে দিই। আমণ্ত্রিত অতিথিরা সবাই মোটামুটি পরিচিত আর মুখচেনা – চড়াই, শালিখ,কাক – এঁরাই। কেউই খুব সৌজন্যের ধার ধারেন না, ভোর হতে না হতেই খাদ্য আন্দোলনকারীদের মত উচ্চ মধুর স্বরে দাবিদাওয়া জানাতে থাকেন। আর খাওয়া দাওয়ার সাথে সাথে গলার দাপটে রীতিমতো ষাট্ ডেসিবেল অতিক্রম করে যান। মাঝে মাঝে অবশ্য অতিথি শিল্পী হিসেবে বুলবুলিরাও প্রবেশ করেন। নিভৃত কোণ টুকু তখন একটা ছোটখাটো পাড়ার জলসা হয়ে যায় ।
কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে দেখছি আরো নতুন সব শিল্পীর ক্রমবর্ধমান অভিবাসন ঘটছে ঐ এক টুকরো কোণের এক চিলতে থালায়। এসেছে কিছু ফিঙে, দোয়েল, একজোড়া ঘুঘু, বসন্তবৌরি,আর কি আনন্দ ! মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কারা নাচে ….. এক দঙ্গল পায়রাও।
পায়রা আমার বরাবর খুব প্রিয়। কারো ডানায় খরোষ্ঠী ভাষালিপি আঁকা, কারো গলায় রশ্মিকাতর ভিবজিওর – কী সুন্দর কথাকলি নাচের ভঙ্গিতে চলে, আর এসি আউটলেটের ওপর বসে একটানা বকবকম্ করে রেওয়াজ করে যায় – একেবারে ভার্সেটাইল আর্টিস্ট। আর যখন ওড়ে, একেবারে নাদিয়া কোমানেচি ! তো ওরা আসে একটু পরের দিকে। ভোর থেকে কাক, শালিখ, চড়াইরা দুতিন ব্যাচ্ খেয়েদেয়ে ডিউটিতে বেরিয়ে গেলে একটু দেরিতে কপোত- কপোতীদের প্রবেশ। এটা ওঁদের ব্রাঞ্চ! আসলে ঘুঘু আর পায়রা ভিড়ভাট্টা মোটে পছন্দ করে না, আর লোভী মানুষের মত কনুই বাড়িয়ে দিয়ে ঝগড়াও করে না। আকাশের অনন্ত নীলিমা রয়েছে তার দুটি ডানার জন্য, অফুরান উদার সূর্যালোক তুচ্ছ দৈনন্দিনতার ঊর্দ্ধে তাকে ডেকে নেয় সারা দিনমান।
এককালে কত রকম যে পায়রা ছিল কলকাতায়! গোলা, লক্কা,গেরোবাজ, সিরাজু, জ্যাকবিন, পারপন- এই মহানগরীর ওপর দিয়ে বৃত্তাকার ছন্দে অবিরাম পাখসাট দিতে দিতে সৌখিন বাবুদের খেলায় সামিল হত তাদের অনেকে – সুখের পায়রারা।
কোন্ ছোটবেলায় রাপিড্ রীডিং এ পড়েছিলাম এক অসামান্য গল্প ‘চিত্রগ্রীবের ওড়ার শিক্ষা ‘। অক্ষরে অক্ষরে মনে নেই আর, তবু সেই পাঠের মায়াময় স্মৃতি আজও সবটা আবছা হয়ে যায়নি । একটু মনে করার চেষ্টা করি তাই।
উজ্জ্বল, নির্মল আকাশবারিধিতে রোদ্দুর সেদিন অবাধে সাঁতার দিচ্ছিল। চিত্রগ্রীব ছাদের পাঁচিলের ওপর বসে রোদ পোহাচ্ছিল। তার বাপ উড়ছিল একটু ওপরে। কি ভেবে নেমে এসে ছেলের পাশে বসে বকবকম্ আওয়াজ তুলে যাচ্ছেতাই করে বকতে শুরু করল,- আলসের ডিম,ভীতুরাম একটা, তিন মাসের জোয়ান মদ্দ, এখনো উড়তে শিখলি না, লজ্জা করে না? আর কবে ডানা মেলবি, শুনি ? ….. বলতে বলতে আর ঠেলতে ঠেলতে ছেলেকে বাপ নিয়ে গেল পাঁচিলের একদম ধারে, তারপর বলা কওয়া নেই, নিজের শরীর দিয়ে বেদম এক ঠেলা দিল। চিত্রগ্রীবের পা ফসকে গেল, নীচের দিকে পড়তে পড়তে তার ডানা খুলে গেল, এক পাক ঘুরে উড়তে শুরু করল সে। ছেলের ওড়া দেখে মা পায়রা তো খুশিতে তাজ্জব । বৈকালিক প্রসাধন না সেরেই ছেলের সাথে যোগ দিল সেও । উড়তে উড়তে উড়তে …… একসময় নেমে এল মা ছেলে – তখনো নতুন অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় চিত্রগ্রীব যেন কাঁপছে। … নিজের উদ্দেশ্য আর ছেলের ওড়ার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে দেখে পায়রা বাবা নিশ্চিন্ত হয়ে স্নান করতে চলে গেল।
এই আশ্চর্য যাদুকরী গল্পটা কলমে এঁকেছিলেন ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করতে করতে সদ্য তরুণটি চিত্রগ্রীবের মতনই ডানা মেলে উড়ে যান অজানার সন্ধানে – প্রথমে জাপান, তারপর আমেরিকা। আমেরিকায় লেখালেখির সূত্রে অর্জন করেন প্রভূত অর্থ, খ্যাতি আর 1928 সালে পুরস্কার পান Gayneck বইটির জন্য । এই বইটিই বাংলায় অনূদিত হয় “চিত্রগ্রীব” নামে।
বইএর পাতায় রাপিড্ রীডিংএ নাই বা থাকল, এখন আমার বারান্দার কোণে দানাপানির থালায় চিত্রগ্রীবদের নিত্য আসা যাওয়া –
তুমি নেই আমি নেই কেউ নেই-
এক ফালি নাগরিক আকাশে
কম্পিত শত শত উড়ন্ত পাপড়ি
শুধু শ্বেত পিঙ্গল কৃষ্ণ উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা।
@ গৌরী মৃণাল