তীর্থের পথে পথে — কামাখ্যা কোয়েলী ঘোষ
তীর্থের পথে পথে — কামাখ্যা
কোয়েলী ঘোষ
শিলং পাহাড়কে বিদায় জানিয়ে আমরা এসেছি গৌহাটি । আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মায়ের সিদ্ধপীঠ , একান্ন পীঠের এক সতী পীঠ , তন্ত্র সাধনার এক পীঠস্থান কামাখ্যা মায়ের মন্দির ।
” আমি মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানি নে মা ,
শুধু যা জেনেছি সে টুকু লয়ে
তোরে ডাকার মত ডাকতে যদি পারি
তবে আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই ”
যেটুকু জেনেছি তাই দিয়েই এই কাহিনীর শুরু ।
মায়ের এক অসাধারণ শক্তি এখানে বিরাজমান । সেই টানে মানুষ ছুটে আসেন বার বার । জাগতিক দুঃখ কষ্ট মানুষ ভুলে যায় । মা শূন্য করেন ,আবার পূর্ণ করে দেন ।
আমরা চলেছি সেই মায়ের ডাকে ।
এই পথের সৌন্দর্য অপরূপ । জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল রঙের ঢেউ খেলানো পাহাড় , নীল আকাশ যেন মিশেছে অনন্তে । পর্বতের নাম নীলাচল ।
গৌহাটি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে , ৫২৫ ফুট ওপরে নীলাচলের শিব পাহাড়ে কামাখ্যা মায়ের মন্দির ।
কিছুটা সমতল পথ পেরিয়ে গাড়ি পাহাড়ে উঠতে শুরু করল । এক সময় পৌঁছে গেলাম প্রবেশপথে ।তারপর পায়ে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে জুতো খুলে মন্দিরে প্রবেশ করলাম।
কামাখ্যা পাহাড়ের ওপরে ব্রহ্মাপাহাড়,মাঝখানে শিব পাহাড় আর নীচে বিষ্ণু পাহাড় । মাঝে শিব পাহাড়ে মা কামাখ্যা বিরাজমান।
মন্দিরে আছে মায়ের দশ মহাবিদ্যার রুপ , ভুবনেশ্বরী , বগলামুখী , ছিন্নমস্তা , ত্রিপুরা সুন্দরী , মাতঙ্গী , ও কমলা ।
দেবী কামাখ্যা হলেন মায়ের তৃতীয় রুপ , ত্রিপুরা সুন্দরী , ষোড়শী ।
দক্ষরাজের গৃহে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করলেন । সেই সতীর দেহ কাঁধে তুলে নিয়ে শুরু হল শিবের প্রলয়নৃত্য । এই মহাপ্রলয় থামাতেই হবে , তাই বিষ্ণু ছুঁড়লেন চক্র । সতীদেহ খণ্ডিত হয়ে এক একটি অঙ্গ পড়তে লাগল নানা স্থানে ।
সতীর যোনি পতিত হল এই নীলাচল পাহাড়ে। মায়ের এই অঙ্গের ভার সহ্য করতে করতে না পেরে পাহাড় নিচের দিকে নামতে শুরু করল । তখন ভগবান বিষ্ণু কুর্ম রূপ ধারণ করে পাহাড়টিকে নিজের পিঠের উপর ধারণ করলেন ।আজও তাই কচ্ছপ পুকুরে প্রচুর কচ্ছপ দেখতে পাওয়া যায়।
“ওঁ কামাক্ষে বরদে দেবী নীলপর্ব্বতবাসিনী।
ত্বং দেবী জগতাং মাত যোনিমুদ্রে নমোহস্তুতে।।
নমস্ত্রিশূলহন্তায় উমানন্দায় বৈ নমঃ
প্রসীদ পার্বতীনাথ উমানন্দ নমোহস্তুতে।।”
মন্দিরের বাইরে সারি সারি দোকান । সেখান থেকে পুজোর সামগ্রী কিনে ভেতরে চত্বরে প্রবেশ করলাম ।
ভেতরে ছড়িয়ে আছে অনেক মন্দির । মন্দিরের গাত্রে নানা দেবী মূর্তি খোদাই করা আছে ।
গর্ভগৃহটি ছোট আর অন্ধকার । সাবধানে সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছলাম ।
ভিতরে যোনির আকৃতিবিশিষ্ট মায়ের শিলা । এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি ফাটল দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই ফাটলটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই স্থানটি ফুল , সিঁদুর ,কুমকুম দিয়ে চর্চিত । একটি স্বর্ণ মুকুট দিয়ে ঢাকা । এই স্থানটি দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ। পাশেই আছেন দেবী মাতঙ্গী আর দেবী কমলার শিলাপীঠ ।
মায়ের কাছে পুজো দিয়ে , আভূমি প্রণাম জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম ।
বাইরে যে মন্দিরগুলো আছে সেগুলো দশমহাবিদ্যার এক একটি রুপের মন্দির ।
ব্রহ্মাপাহাড়ের ওপরে আছেন মা ভুবনেশ্বরী ।এখানেই স্বামী বিবেকানন্দ এক পাথরে নির্জনে ধ্যানে বসেছিলেন ।
এই মন্দিরে ১৯০১ সালে এখানে তিনি কুমারী পুজো করেছিলেন ।
আষাঢ় মাসে অম্বুবাচীর সময় মা কামাখ্যা ঋতুমতী হন । এই সময় দেবীর পীঠস্থানের প্রস্রবণের জল রক্তবর্ণ ধারণ করে । এই সময় বিরাট মেলা বসে আর প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে । মার মন্দির তিনদিন বন্ধ থাকে । চতুর্থ দিন দরজা খোলা হয় বিশেষ পুজোর পর ।
এই মন্দির ঘিরে মানুষের মধ্যে নানা জনশ্রুতি ছড়িয়ে আছে । যাদু টোনা , কালা যাদু , যোগিনীরা পুরুষদের ছাগল বানিয়ে রাখে ইত্যাদি নেহাত গল্প , এসমস্ত কিছুই নেই । এমন কি কোন পাণ্ডাদের উপদ্রব নেই ।
পুজোর জন্য বিশাল লাইন দিতে হয় নি । খুব সুন্দর পুজো দিয়ে , ভোগ খেয়ে আমরা উমানন্দ ভৈরব দর্শন করতে গেলাম ।
বিস্তীর্ণ ব্রম্ভপুত্র নদের জলরাশি বর্ষায় জলস্রোত বাড়ে । আমরা চারজনে মিলে একটি বোটে করে ময়ূর দ্বীপে গিয়েছিলাম । এখানে লঞ্চও চলে । খুব সুন্দর এই দ্বীপে এসে উমানন্দ শিবকে দর্শন ,প্রণাম জানিয়ে আবার ফিরে চললাম ।
এরপরে আমরা বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম দেখতে গিয়েছিলাম । খুব শান্ত ,নির্জন এই অরণ্য ঘেরা আশ্রম । কয়েক হাজার বছরের পুরনো এই মন্দির আর শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন আহোম রাজা রাজ্যেশ্বর সিংহ । কুলকুল বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী । সন্ধ্যা , ললিতা , কান্তা একসাথে মিশে বশিষ্ঠ নদী নামে প্রবাহিত । এখানেই মহর্ষি বশিষ্ঠ দেহ রাখেন । তাঁর সমাধি আছে । অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজ করছে এখানে । গাছে অজস্র পাখির কলকাকলি , পাহাড়ি ঝোরা মনকে মুগ্ধ করবেই ।
আসামে আরো কিছু দেখার আছে । কিন্তু
এবার ফিরতে হবে ঘরে । মনের কোণে অক্ষত স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল এই ভ্রমণ , এই শক্তিপীঠ মা কামাখ্যা । বারংবার মাকে প্রণাম জানালাম ।
ছবি ঋণ — পিয়ালী মুখার্জি