ভ্রমণ কাহিনী *নিপ্পনের দেশে (৭) কলমে ©শ্বেতা ব্যানার্জী
ভ্রমণ কাহিনী *নিপ্পনের দেশে (৭)
কলমে ©শ্বেতা ব্যানার্জী
অনেক মুহূর্ত থাকে জীবনে যেগুলো না পাওয়ার দলে ছিল,আর সেই কারণেই মনে থেকে যায় কিছু প্রাপ্তির আশকারা । না, গোটা জীবনটাই পাল্টে যাইনি গেছিল কিছু মুহুর্ত। জীবনের পিচ্ছিল পথে ব্যালান্স করে দৌড়ানোর সমীকরণ মেনে, মানিয়ে নাও মেনে নাও এর হাত-ধরাধরি ভালোই চলছিল —
জাগতিক কাজকর্ম আলোচনা সেরকম বিশাল ওজনদার না হলেও একটুখানি শুদ্ধ নিঃশ্বাসের
ইচ্ছা মনের কোণে কখনো ঘুরতে এসেছিল।
আমার জীবনে ওরকম এক মুহূর্ত টোকিও ভ্রমণ…।
জীবনের ব্ল্যাকবোর্ডে চকের গুড়োর সাদা দাগ আজও লেগে আছে… যে বৃত্তের পরিধির মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে । কিন্তু আমি বিন্দুতে বিন্দুমাত্র বিনিয়োগ না করে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের দেয়াল ধরে এগিয়ে চলেছি মনের উৎসবের অন্দরমহলে— স্ট্রবেরির গন্ধে মাতাল শীতের আমেজ একমুখ হাসি নিয়ে আমার দরবারে –দিলওয়ালে।
আমি চোখ কুঁচকে বলি ও তুই!! সে বলে তোমার মাথায় কী কিছুই নেই!? আজ আমরা যাবো #সেঞ্জ জি মন্দির। দেখো গিয়ে তোমার কর্তার সাজগোজ…।
আমি যেন আনন্দের চাবি কাঠিটা পেয়েই গেলাম।
ধর্ম ব্যাপারটা জাপানিদের কাছে তেমন গুরুত্ব নয়।
তারা সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করে,কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ধর্মের লাল ফিতে তে বাঁধা পড়েনা। মুক্ত পাপড়ি মেলে মুক্তমনা জাপান, হিসাব মতন নাস্তিক। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সিন্টো ধর্মের( জাপান রাষ্ট্র এবং জাপানি জাতির জাতীয় আধ্যাত্মিকতা এবং প্রচলিত ধর্ম) কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান
কেউ আবার সব ধর্মেই বিশ্বাসী। জাপানে একটা নিয়ম আছে, লোকগণনার সময় পাশে কোন ধর্মীয়
সেই কথাও লিখতে হয়,সেখান থেকেই এই তথ্য পাওয়া যায়
তবে রাজভক্তি! সব ধর্মের উর্দ্ধে..
এদের রক্তে মিশে রাজধর্ম, যা পালন করার জন্য রাজার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রাণ কাঁপেনা। আর ঐতিহ্যের প্রতিও অন্ধভাবে অনুগত এরা।
জাপানে ভারতীয় অনেক দেবদেবীর মন্দির আছে।
এখানে লক্ষ্মী ঠাকুর কে বলে #কিচিজোজি।
আছেন সরস্বতী, জাপানিদের সবচেয়ে প্রিয় দেবী।
এখানে সরস্বতীর নাম#বেঞ্জাইতেন, বাহন ড্রাগন।
তাছাড়া পূজিত হন গণেশ, ইন্দ্র,ব্রহ্মা—-
দাঁড়ান, দাঁড়ান, বলবো সব,
এইবার গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেবার তাড়া দিচ্ছেন
উনি, যেহেতু নিজের সাজগোছ হয়ে গেছে।
না-ও তৈরি হও, এসেছো বেড়াতে এত সাজের কী
দরকার!! হাসিমুখে আমি বলি তৈরি চলো…
যথারীতি #গিয়াতুকু স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে #আসাকুসা স্টেশন, সেখান থেকে একটু হেঁটেই
টোকিওর জনপ্রিয় মন্দির #সেঞ্জ জি (senso- ji)
সপ্তম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত ভারি সুন্দর এক #বৌদ্ধ মন্দির, সুদৃশ্য লাল রঙের ঝাড় লণ্ঠনে সাজানো এই
মন্দির, বিশাল.. প্রায় পাঁচতলা সমান প্যাগোডা,
আর বিশাল এক হলঘর। ডানপাশে বিশাল বুদ্ধমূর্তি।
মন্দিরের সামনে জ্বলছে দীপক, অনেকটা আমাদের দেশের শিব মন্দিরে সামনে বাতি দেবার স্থানের মতন।
সকলেই সেখানে তাপ নিচ্ছে, প্রণাম জানাচ্ছে, ঠিক ভারতীয়দের মতন —
আমরাও সেখানে তাপ নিয়ে, প্রণাম জানালাম #তথাগত কে।
মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করে নিজের ভিতর অপরূপ
প্রশান্তি অনুভব করলাম, সকলেই দেবতা কে ডাকছেন, কিন্তু কোন আওয়াজ, কোন বিশৃঙ্খলা নেই, সব কিছুই নিয়মমাফিক, নিজের মনের ভিতর
এক আধ্যাত্মিক আবেশ আমাকে আচ্ছন্ন করলো…
আমি ডুব দিলাম প্রাণভরে অমৃত আনন্দে।
এখানে বিশাল এক মজার ব্যাপার হ’লো মন্দিরে ঢোকার মুখে প্রায় ২৫০ মিটার চওড়া একটা শপিং স্ট্রিট আছে, এই রাস্তাটার নাম# নাগামিসে স্ট্রিট।
জাপানি ঐতিহ্যের অনেক জিনিস এখানে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় উন্নত মানের খেলনা। আরও নানারকম, নানারূপের ডালি দিয়ে সাজানো এই মার্কেট —
বিদেশীরা দেখলাম প্রচুর কেনাকাটা করছে, আমিও
ভাবলাম কিছু দেখি, ওমা!! হাত দেবো কী!
ছ্যাঁকা লেগে হাতে জ্বলন শুরু… আমার সিলভার এক্স চোখ মোটা করে আমার দিকে তাকিয়ে —
ওদিকে ছেলের আশকারাদান না-ও না,”মা” আমি তো আছি…
তবুও নিতে পারলাম না। দামের দমকে হাড়ে হাড়ে
ঠোকাঠুকি যেন লাল সিপাহী কাঠঠোকরা তালে তাল ঠুকছে।
সামান্য একটা চাবির রিং বলে ৬০০-৮০০ তাজ্জব কী বাৎ!! আমি মনে মনে বলি চলনা বাপু আমাদের # গড়িয়াহাট ফুটে ঢেলে লে লে ২০ টাকা করে বিকোচ্ছে। তবুও যষ্মিনদেশে যদাচরণ, কিছু মেমেন্টো, ছেলে পেমেন্টো করে শুভ দুপুর জানিয়ে
এগিয়ে চলো…. নির্দেশ দিল।
আমরা এগিয়ে চললাম—
ভগবান বুদ্ধের স্মরণ নিয়ে আমরা বাতি জ্বালালাম,
মন্দির প্রদক্ষিণ করলাম, এখানে বেশির ভাগ মেয়েরা
তাদের জাতীয় পোষাক #কিমোনো পরেই আসে।
কি সুন্দর যে লাগে তাদের যেন পুতুলের সারি…।
আমারও ইচ্ছে ছিল #কিমোনো পরার কিন্তু লজ্জা
বললো , ইস-স্ পরিসনি ভাগ্যিস!
মন্দিরে একদিকে বিশাল এলাকা নিয়ে খাবারের দোকান, সব গরম গরম পরিবেশন করছে, দেখলাম
অক্টোপাসের স্যুপ, শার্কের স্যুপ, নানা প্রজাতির
সি-ফুড, লবস্টার, আরও নানারকম অদ্ভুত খাবার যার নাম জানিনা, স্বাদ জানিতেও চাইনি
শুধু দেখে চোখ দিয়ে চেখেছি।
আসলে যে দেশে যাবো সে দেশের খাবারের স্বাদ জানতে পারবোনা তা তো হয়না।
সেই দেশ কে চিনতে কিছু খাবার খেতেই হয়। নাহলে অধরা থেকে যায় সে দেশের উঠোন ছোঁয়া।
আমরাও খেলাম.…#টেম্পুরা আর ক্রেপ
গতির প্রগতির জন্য বিখ্যাত জাপানে দেখলাম মানুষের টানা# রিক্সা, সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত
এই রিক্সাচালক, কিন্তু দুঃখের বিষয় আর একটা
রিক্সা না থাকায় আমাদের আর চড়া হ’লোনা।
যদি দু’জনে হারিয়ে যাই কিছু তো বোঝাতে পারবোনা, আসলে ভীতু বাঙালি এ্যডভেঞ্চারে
নৈব নৈব চ, তায় আবার এই বুড়ো বয়সে!!
আমরা হেঁটে চলেছি রাজপথ ধরে শহরটা দেখবো বলে.. আকাশের কালো বুকে মাথা রেখে চাঁদ বলে আমি জেগে আছি আয়েশি হয়ে তোমরা ঘুরে দ্যাখো…।
সব আনন্দ একদিনে মুঠো ভরতে গেলে বাকি আনন্দ পিচ্ছলিয়ে যায়–
প্রকৃতির অপরূপ শোভা চুরি করে মুঠোফোনে বন্দী
করি, সে কপট রাগ দেখায় আমায় মেঘে মুখ ঢেকে।
আমি বলি আঁকা যদি শিল্প হয়,ফটো নয় কেন!?
আমি তোমাকে মুক্তি দেবো আমার লেখার পাতায়,
খোলা স্বাদ পাবে আর পাঁচজন যারা তোমাকে দেখেনি তারা তোমায় দেখবে, দীর্ঘ স্থায়িত্ব পাবে তুমি।
দর্শন আর দর্শনের আধুনিক রূপচিন্তনে তোমাকে আধুনিক করে দেবো আমি।
মান ভাঙে, আকাশের বুকে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে র্যাম্পে হাঁটতে শুরু করলেন।
আমি বলি–
গল্প উপন্যাস নয়
তুমি বিমূর্ত চিত্রকলা
যা সস্নেহে এঁকেছেন চিত্রকর
আসমানী আদরে সারা আকাশ জুড়ে
আকাশের ক্যানভাসে কল্পনার উন্মাদনা
এসো প্রিয়, আমি সম্মানিত করি তোমাকে।
ক্রমশ..