আশাদীপ —- তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
আশাদীপ
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
ভেজানো দরোজার ওপারে সদ্যোজাতর কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই, খুশির চ্ছটা ছড়িয়ে পড়ে অশীতিপর বিন্দু বুড়ির সারা মুখে। অসংখ্য বলিরেখা, ছানি কাটানো চোখে ভারী কাঁচের চশমা আর একমাথা সাদা চুলের খোপা, সবাই হাসতে থাকে বুড়ির সাথে। চিৎকার করে মালতী বলে, ‘মেয়ে হয়েছে গো…. মেয়ে’, সেই চিৎকার আর বাচ্চার কান্নায় সবাই জড়ো হয় এক এক করে। আশাদীপ….. সত্যিই আশার দীপ জ্বালছে।
‘আমি মা’র কাছে যাবোওওও’…. হাত পা ছুঁড়ে কি ভীষণ কান্না কেঁদেছিল সেদিন…. আবছা আবছা মনে পড়ে বিন্দু বুড়ির। মায়ের কাছে নয়, কোথায় কতদূরে যে তাকে ওরা নিয়ে চলে এসেছিল….মায়ের মতোই একজন আর একজন বাবার মতো। ভালোবাসা আদর নয় জুটেছিল মুখ চেপে ধরে ধমক। তখন তো সে একটা পুচকে মেয়ে। চার বছর হবে বয়স। কে বা কারা কেন যে জোর করে তাকে তুলে এনেছিল বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে সবার অলক্ষ্যে সেই শিশু বয়সে না বুঝলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, পরে।
‘শোন, যা দেবো তাই খাবি আর ঘরের বাইরে বেরোবার চেষ্টা করবি না, তোর মতোই আরও অনেকে আছে এখানে। কথা না শুনলে চরম শাস্তি পাবি’ মণিকা মাসির হুমকি, মারের ভয় তো আছেই। তাই চুপ করে সব শুনত বিন্দু। দাদা আদর করে বিন্তি বলতো, জিজ্ঞেস করায় সেটাই বলেছিল সেদিন।আর তার থেকে নাম দিল এরা ‘বিন্দু।’
শুরু হলো নতুন জীবন নতুন অভ্যাস। এখানকার সব কিছু শিখে মানিয়ে নিতে নিতে কখন যে পেরিয়ে গেছে দশটা বছর….. ঋতুমতী হলো বিন্দু। মাসি এসে কড়া গলায় শুনিয়ে গেল যে এবার তাকেও কাজ করতে হবে। বড় হয়ে গেছে সে। এতদিন তো ফাইফরমাশ খেটে আর তালিম নিয়ে কেটেছে কিন্তু কাজ!! মনু, তপা, রূপসী, ছোটি, জোছনা, সব দিদি গুলো যেমন সেজে, ঠোঁট কামড়ে, বেণী দুলিয়ে, নানা অঙ্গভঙ্গী করে পুরুষ মানুষ আসলে, তাকেও ঐসব করতে হবে!!
সন্ধে নামার মুখেই পাতলা ফিনফিনে শাড়ি আর ব্লাউজ পরিয়ে, সাজিয়ে দিল মনু দিদি। তারপর গায়ে একটা ঠেলা মেরে বললো, ‘দেখি কেমন পারিস খেলাতে??’ সবাই হেসে ঢলে পড়লো এ ওর গায়ে। সেই শুরু। প্রথম দিনের অসহ্য কষ্ট সারা শরীরে আজও বয়ে বেড়ায় বিন্দু বুড়ি। শক্ত হাতের দুরমুশ সারা শরীরে আর কামড়, খামচি, বাথরুম করতে অসহ্য যন্ত্রণা….. উঃ…. ভুলতে পারে না সে… এই বয়সেও।
‘কি দিদা, কি নাম রাখবে এই নতুন অতিথির??’ মালতী ন্যাকড়ায় জড়ানো মাংসের ডেলা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।
কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয় বিন্দু ‘বিন্তি’
দিন যেতে যেতে অভ্যাস হয়ে যায় বিন্দুর ঐ সব শরীরে আঘাত। বিনিময়ে টাকা আসে। রাতের পসরায় সাজাবে বলে সবাই দিনে খুব যত্ন নেয় শরীরের। বিন্দু দেখতে সবার থেকে সুন্দর। একটা আলাদা চটক আছে চেহারায়, কথায়। অনেক মেয়েকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে এই কাজে লাগানো হতো। কান্নাকাটি করলে বা পালানোর চেষ্টা করলে জুটতো কিল, চড় আর খাওয়া বন্ধ। এরপর এদের কাউকে কাউকে আর দেখাই যেত না। শুনতো ফিসফাস যে ওদের অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আর যারা এখানে সব মেনে খদ্দের সামলায়, টাকা রোজগার করে, তাদের নিজেদের হাতে টাকাই দেয় না কেউ, না খদ্দের না মাসি। ঐ রূপসী দিদি খুব জ্বরে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মরেই গেল অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে। এত বছর রোজগার করলো অথচ অসুখে ডাক্তার ওষুধ কিচ্ছু পেল না। তবে তাদের সবারই এই দশা হবে!!
অনেক ভেবে একদিন মণিকা মাসিকে বিন্দু সরাসরি বলে যে, ‘আমাদের রোজগারের টাকা সবটা না হলেও বেশিটাই আমাদেরকে দিতে হবে। নৈলে ঐ রূপসী দিদির মতোই দশা হবে আমাদেরও, যদি না দাও তবে এইকাজ আর করব না আমরা। সব জানিয়ে দেবে সবাই কে।’
পান টা সবে মুখে দিয়েছিল মণিকা। বিন্দুর কথা শুনে হাঁ করেই রৈলো খানিক। তারপর ছুটে এসে চেপে ধরলো চুলের বেণী। এলোপাথারী চড়, থাপ্পড়। টানতে টানতে ঘরে নিয়ে দরজা বাইরের থেকে শিকল তুলে দিয়ে বললো, ‘আজ থেকে ওর খাওয়া, বেরোনো সব বন্ধ। দেখি ওর জেদ কদিন থাকে? কেউ আসবি না ওর ঘরে, ওর টাকা চাই?? থাকা খাওয়া পেয়ে মন ভরছে না শয়তানীর, চোপা করছে আমার সাথে!! আবার দল পাকিয়ে নেত্রী হয়েছিস!! দেখাব ওকে অন্য মজা’
চিৎকারে সেদিনও সবাই এসেছিল ছুটে কিন্তু হাসি নয় সাংঘাতিক ভয়ার্ত ছিল সবার মুখ… প্রতিবাদ তো দূর, কথাই বলে নি কেউ….
আজ সবাই এক চিৎকারে জড়ো হয়ে হাসছে, আনন্দ করছে…
খিদে,তেষ্টায় কেটে গেছে কত দিন বা সময় মনে নেই বিন্দুর। অন্ধকার ঘরে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। এমন সময় জানলায় মৃদু টোকা। ভালো করে শোনে সে। কোনও রকমে ঘষে ঘষে জানলার কাছে আসে। পুরোনো দিনের বাড়ি। খড়খড়ি জানলা একটু উঠিয়ে এক টুকরো কাগজ আর কলম দিয়ে ছোটি দিদি বলে, তুই তোর কষ্টের কথা লেখ বিন্দু। একটা সংস্থা এসেছে এখানে আমরা কেমন আছি জানতে। মণিকা মাসির সামনে তো কিছু বলতে পারবো না। তুই একমাত্র লিখতে জানিস। লিখে দে আমি আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে ফাঁক বুঝে দিয়ে দেবো ওনাদের।
একটু পরে আয় দিদি, আমি লিখি থাম….
আধঘন্টা পর ছোটি এসে নিয়ে যায় ভাঁজ করা কাগজের টুকরো। লুকিয়ে তুলে দেয় এক দিদিমনির হাতে।
পরদিন ই চলে আসে যৌনকর্মীদের জন্য কাজ করা অনেক সংস্থা, পুলিশ এবং মানবাধিকার কমিশনের লোকজন।
বদলে যায় মণিকা মাসির ডেরার মেয়েদের চেহারা। এতদিন যারা মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করেছে তারাই তখন লাভা উগরানো আগ্নেয়গিরি।
নিজের অমতে যারা বাধ্য হয়ে একাজ করছিল মুক্তি পায় তারা। সমাজসেবী সংস্থা ‘আশা’ পাশে থেকে পথ দেখায়। ছাড়া পাওয়া সব যৌনকর্মীরা বিন্দু কে তাদের প্রধান মেনে এগিয়ে চলে অন্য পথে। হাতের কাজ শিখে রোজগার করে ওরা তৈরি করে ‘আশাদীপ’ যেখানে আলো কেবল আশার। নাচ, গান, ছবি আঁকা এসবও চলতে থাকে পাশাপাশি ‘আশা’ র উদ্যোগে। পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। ‘আশাদীপ’ কে বিন্দু অনাথালয় করে গড়ে তোলে। অবাঞ্ছিত বাচ্চারা এখানে আদর যত্নে বড় হয়। স্কুল যায়। এরপর তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করে চলে যায় কেউ, কেউ আবার এখানেই ফিরে আসে।যেমন বিয়ের পরে বাচ্চা পেটে চলে এসেছিল রাখি। আজ তার মেয়ে জন্মালো এই আশাদীপে।
আশির ঘরে বিন্দু বুড়ি জীবন যন্ত্রণায় জিতে যাবার আনন্দে আর হার না মানা প্রত্যয়ে আজও দীপ্তিময়ী।। অন্ধকারে নষ্ট হয়ে যাওয়া অনেক জীবনের সেই আলো।
তার হাতের ব্যাটন ধরার অনেক মেয়ে যদিও, আজ নিজের নাম দিয়ে নতুন আশার বীজ রোপন করলো সে….
শব্দ সংখ্যা ১৪৭৭