শিরোনাম: মুছে যাওয়া দিনের চিঠি ✍🏼 শান্তনু
শিরোনাম: মুছে যাওয়া দিনের চিঠি
✍🏼শান্তনু
সেই ছোটবেলা থেকে দিয়াকে বড্ড আকর্ষণ করে পরিবারের সবচেয়ে আপনজন, তার ঠাম্মি। এক অদ্ভুত পার্সোনালিটি। তেমনভাবে স্কুলে যাওয়া শিক্ষা না থাকা সত্বেও পড়াশোনার প্রতি তীব্র আগ্রহ, জীবনে মেরুদন্ড সোজা করে চলা , দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ অথচ সংসারে অদ্ভুত এক অনীহা, দারুন রান্না- সে নিরামিষ হোক অথবা আমিষ, পথের ধার থেকে নাম না জানা গাছগুলো তুলে নিয়ে পরম যত্নে বড় করা , সব মিলিয়ে “ঠাম্মি ইজ দ্যা বেস্ট”।
আজ সেই ঠাম্মির পারোলৌকিক কাজ চলছে একতলার ঘরে। গত কয়েকদিন ধরে মনটা খুব খারাপ দিয়ার। এত তাড়ার কি ছিল ঠাম্মির! দোতলায় ঠাম্মির ঘরটায় শুয়ে পুরনো কথা ভাবছিল। ঠাম্মি বলতো,”দিদিভাই যখন আমি থাকবো না, সেদিন যদি আমার জন্য মন খারাপ করে তবে আমার নিজের হাতে রং করা যে কাঠের ছোট বাক্স টা আছে, ওটা খুলিস। ওটার মধ্যে তোর ঠাম্মির অনেকগুলো বছর বন্ধ করা আছে। “দিয়া এক দৌড়ে ঠাম্মির আলমারি খুলে ফেলল। একটু এদিক-ওদিক খুঁজতেই পেয়ে গেল কাঠের বাক্সটা। দিয়া ঠাম্মিকে এর আগে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে বাক্সটার রহস্য। ঠাম্মি একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল “এখনো সময় হয়নি পান্ডোরার বক্স খোলার”।
প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাক্সটা খুলে ফেলে ,তার ভেতর একটা খামে একটি চিঠি আর দুটো সোনার বালা। খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা পড়তে থাকে দিয়া, “স্নেহের দিদিমণি, তুই যে স্নেহলতাকে চিনিস, ভালোবাসিস ,শ্রদ্ধা করিস তাকে পুরোটা জানার অধিকার তোর আছে। কারণ আমার জীবনে তুই সবচেয়ে স্নেহের পাত্রী। আজ তোকে জানাই অনেক বছর আগে বছর কুড়ির স্নেহলতার জীবন কথা। বাপমরা সদ্য যৌবনে পা রাখা স্নেহলতার সাথে বিয়ে হল রামেশ্বর রায়ের। শহরের বড়লোক বাপের ছেলে, সেনাবাহিনীতে কাজ করে। আমার মত ভাগ্যহীনার এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর হতে পারে না। বিয়ের একমাস পরেই স্বামী চলে গেলেন পাঞ্জাব। শশুর এবং একমাত্র ভাসুর নিয়ে আমার ছোট সংসার। দুই স্নেহশীল অভিভাবক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই নখদন্ত প্রকাশ করল। স্ত্রীহীন শশুরমশাই আর অক্ষম পৌরুষত্ব বিশিষ্ট ভাসুরের নোংরা কদর্যময় খেলার পুতুল ছিলাম আমি। আট-নয় মাস পরে স্বামী বাড়ি ফিরেছিলেন। আমার জীবনের শেষ সম্বল এই মানুষটিকে আমার নরক যন্ত্রণার কথা বিশ্বাস করাতে পারলাম না। পিতা ও দাদার প্রতি অন্ধবিশ্বাসে আমাকে বিকৃত মানসিকতার দায়ে অভিযুক্ত করল। নরমে গরমে আমার স্বামী আমাকে বুঝিয়ে দিলেন আমাকে এখানে এভাবেই থাকতে হবে। আমার প্রতিটা যন্ত্রণার দিন আমি তোকে বুঝিয়ে বলতে পারবোনা দিদিভাই। বিয়ের সাত বছর পরে তোর বাবা জন্ম নিল। আমার অন্ধকারময় জীবনে আশার প্রদীপ। তোর বাবার জন্মের পর আমার জীবনের কলঙ্কিত দিনগুলোর সংখ্যা কমতে থাকে। কিন্তু আবার নতুন সংবাদ। তোর দাদু চাকরীর জীবন সমাপ্ত করে তার চারবছর পুরানো অপর এক স্ত্রী এবং বছর আড়াই এর একটি পুত্র সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন তার নিজের বাড়িতে। প্রচন্ড অপমানে পরদিন ঘর ছেড়েছিলাম।ছয় বছরের ছেলের হাত ধরে অসম জীবনযুদ্ধে অসীম লড়াই। একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে বাগান পরিচর্যা ও সাফাই কর্মীর কাজ করেছি দীর্ঘদিন। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহাশয়এর দয়াতেই তোর বাবার শিক্ষালাভ। আমার যা কিছু শেখা বা শেখার ইচ্ছা সব ওই কর্ম জীবনের দিনগুলোতেই। আজ তোর বাবা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, এই কৃতিত্ব তার এবং অবশ্যই ভগবানের করুণা।
মেয়ে হিসেবে আমার জীবন শিক্ষা এই যে মেয়েদের অবশ্যই স্বাবলম্বী এবং জীবন সচেতন হওয়া উচিত। আমি তোর মধ্যে আমাকে খুঁজেছি বারবার। তাই আমি চাই তুই সঠিক অর্থে পূর্ণ নারী হয়ে ওঠ।
তোকে দেওয়ার আমার কিছুই নেই, তাই আমার মায়ের এই বালা দুখানি, যেগুলো হাজার কষ্ট সত্বেও আমি বিক্রি করতে পারিনি, তোকে দিয়ে গেলাম। খুব ভালো থাকিস দিদি ভাই।”আরো কিছু লেখা ছিল, কিন্তু চোখ ঝাপসা হয়ে আসায় আর পড়তে পারেনি দিয়া। তক্ষুণি ডাইনিং স্পেসের যে কোনে পরিবারের সবার ছবি টাঙ্গানো ছিল তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে তিনটি ছবিতে কাজল পেন্সিলটা ঘষে কালো করে দিল মুখগুলো আর এক ছুটে বাগানে গিয়ে চিৎকার করে বলল “ঠাম্মি আমি ঐ লোকগুলোর মুখগুলো কালো করে দিয়েছি, তুমি খুশি তো? তুমি ভালো থেকো ঠাম্মি, খুব ভালো থেকো”।