“আকাশের পাখি” কলমে—নীরা মিত্র
“আকাশের পাখি”
কলমে—নীরা মিত্র
রাতের নিস্তব্ধতায় অনেক গুলো বছর পিছিয়ে গেল পিঙ্কি…
তখন আর কতোই বা বয়সঐ২০, ২১ হবে, গরমের ছুটি তে কলেজ বন্ধ পিসির বাড়ি এসেছে, ভালোই গরম পড়ে বহরমপুরে তাই বিকেলে পিসতুতো ভাই আর বোনকে নিয়ে গঙ্গা র ধারে বেড়াতে এলো, হঠাৎ কোথা থেকে পিসির পাশের বাড়ির বাবুনদা সাইকেল নিয়ে হাজির,পরিচয় ছিল আগে ই, একথা সে কথার পরে ওদের সবাই কে ফুচকা খাওয়ালো, ভাই বোন তো মহা খুশি আনন্দে খেলায় মেতে গেল, সেই সুযোগে বাবুনদা দা পিঙ্কি কে কাল এই সময় এখানে আসতে বললো। পিঙ্কি ঠিক বুঝতে পারলো না কেন?
যাই হোক সন্ধ্যে হয়ে এল ভাই বোনকে ডেকে নিয়ে ও বাড়ির পথ ধরলো…
বাড়ি ফিরে মনের মধ্যে একটা ‘কেন’ ঘুরপাক খাচ্ছে… তবুও পরদিন বিকেলে যথা সময়ে ভাই বোন কে নিয়ে গঙ্গার পাড়ে গেল, কিন্তু কই বাবুনদা তো নেই… ওর চোখ বাবুনদা কে খুঁজছে হঠাৎ পিছন থেকে সাইকেলের বেল, বাবুনদা, ভাই বোনতো মহা খুশি, আজও নিশ্চয়ই বাবুনদা কিছু খাওয়াবে, ওরা বাবুনদা কে ঘিরে ধরে গোল হয়ে ঘুরপাক খেলো,বাবুনদা মিটিমিটি হেসে বললো চল আজ কুলফি খাই… কুলফি খেতে খেতে বাবুনদা পিঙ্কি কে ওর ইন্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেল, বন্ধু দের গল্প করলো আর এও বললো ও তো এখন দুর্গাপুরে থাকে কোন একদিন সুযোগ করে কলকাতায় হাজির হয়ে পিঙ্কি র সাথে দেখা করবে, পিঙ্কি র কলেজে, …
পিঙ্কি র শুনে খুব ভালো লাগলো কাল থেকে বারে বারে বাবুনদার চেহারাটা মনে পড়ছিল…
যাই হোক এই ভাবে আরও চার পাঁচ দিন ওদের দেখা হলো তারপর পিঙ্কি র কলকাতা ফেরার দিন এসে গেল, কেন জানি পিঙ্কি র মনটা বেশ খারাপ, গঙ্গার পাড়ে সেই সন্ধ্যে তে বাবুনদা ওর হাত ধরে বললো ভুলে যাবে না তো?
পিঙ্কি র সারা শরীরে যেন শিহরণ খেলে গেল, অনেক কষ্টে চোখের জল লুকিয়ে ফিরে এলো, পরের দিন কলকাতা..
যথা নিয়মে কলেজ শুরু হয়ে গেল কিন্তু এই কটা দিনের বিকেল পিঙ্কি র মনে একটা আলাদা জায়গা করে নিলো।
মাসখানেক পরে একদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে বাস স্টপে হঠাৎ দূর থেকে একজন কে দেখে চমকে উঠলো, আরে বাবুনদা না?
হ্যা তাই তো বাবুন কাছে এসে হেসে বললো কি কেমন চমকে দিলাম বলো…
চলো সামনের রেস্টুরেন্টে বসে একটু চা খাই…
পিঙ্কি তো নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না…
অনেক গল্প করলো বাবুন, যাবার সময় বললো তিন দিন আছি চলো কাল ভিক্টোরিয়া যাই।
তাই হলো দুজনে ভিক্টোরিয়া, মিউজিয়াম ঘুরে বিকেলে ফিরলো, পরের দিনও কলেজ কেটে এদিক ওদিক, সময় পেরিয়ে গেল বিকেলের ট্রেনে বাবুন হস্টেলে ফিরে যাবে যাবার আগে পিঙ্কি র হাতে একটা নীল খাম দিয়ে বললো আমার ট্রেন ছাড়বে ৫-২০তুমি তখন খাম খুলবে…
বাবুন কে বাসে তুলে দিয়ে জল ভরা চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো পিঙ্কি, বাস চলে গেল ও বাড়ি ফিরে এসে ঠিক ৫-২০ তে খাম টা খুললো ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে… একটা লাইন, “আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি”….
পিঙ্কি তো মনে মনে অনেক আগেই ধরা দিয়েছিল…
খুশী তে চোখের জল বাধ মানলো না…চলছিল সব ঠিক ঠাক, পিঙ্কি বি. এ অনার্স পাশ করে এম এ তে ভর্তি হলো এদিকে বাবুন ও এন্জিনিয়ারিং পাশ করে কাম্পাসিং এ ব্যাঙ্গালোরে ভালো চাকরি পেলো,… এবার তো বাড়িতে বলতে হবে, পিঙ্কি র মা বাবা এবার বিয়ের সম্বন্ধ করতে চান… পিঙ্কি একদিন মাকে সব বললো, মা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন আচ্ছা দেখি তোর বাবা কি বলেন, পিসির বাড়ির যখন কাছে খোঁজ নিতে কোন অসুবিধা হবে না…
বেশ কদিন সব চুপচাপ তারপরে বাবা বহরমপুরে গেলেন এবং ফিরে এসে যথারীতি না করে দিলেন… পিঙ্কি কিছু বুঝতে পারলো না মাকে জিগেস করেও কোন সদুত্তর পেলো না…
বাবুন কে চিঠিতে সব জানালো কিন্তু বাবুন ও চুপ চাপ চিঠির কোন উত্তর নেই…
পিঙ্কি অকুল পাথারে ওর এক বন্ধুর ফোন নম্বর আছে সেখানে ফোন করে জানলো বাবুন ঐ চাকরি ছেড়ে চলে গেছে কোথায় গেছে কেউ জানে না…
প্রথম টা খুব কান্নাকাটি করলো তারপরে প্রচন্ড রাগ অভিমানে পাথর হয়ে গেল।
মা বাবা বিয়ের সম্বন্ধ করলেন ও সম্মতি দিলো এবং নিদৃষ্ট দিনে বিয়ে ও হয়ে গেল। বর খুবই ভাল মানুষ তার বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই কিন্তু পিঙ্কি মন থেকে বাবুন কে মুছতে পারলো না…
তারপরে অনেকদিন কেটে গেছে, চুলে রূপলি রেখা, চোখে চশমা , ওর মেয়েই এখন এম এ স্টুডেন্ট।
বাবুনের সেই ২৭ বছরের চেহারাটাই মনে আছে…
আজ সকালে রোজ কার মতো মর্নিং ওয়াকে গিয়ে পার্কের কোনার বেঞ্চে লাঠি হাতে চোখে কালো চশমা একজনকে দেখে চকিতে বাবুনের কথা মনে পড়ে পিঙ্কি র, অনেকক্ষণ ভদ্রলোক কে নজর করে, উনি উঠে খুব আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেলেন ঐ কোণের বাড়িটার দিকে, হাঁটাটা যেন বাবুনের মতো না? দূর কি সব ভাবছি বাবুন কোথা থেকে আসবে? তবে খটকা একটা লাগলো মনে এতো সকালে চোখে কালো চশমা কেন? কি জানি হয়তো চোখের কোন সমস্যা আছে।
সারাদিন আর কিছু মনে পড়ে নি, কিন্তু আজ রাতে হঠাৎ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে ২২শে জুনে চোখটা আটকে গেল… কালই তো সেই দিন, আকাশের পাখির ধরা দেবার দিন…
রাতের অন্ধকারে সেই সব দিনের কথা এক এক করে মনে পড়ে গেল। কিন্তু বাবুন যে কোথায় হারিয়ে গেল? এর উত্তর জানা গেল না।
কখন দু চোখে ঘুম এসে গেছে সকালে উঠতে দেরী ও হলো আজ আর মর্নিং ওয়াক হলো না। কর্তা বেরিয়ে গেছেন ওকে ডাকেন নি…
ফিরে এসে চায়ের টেবিলে বসে কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন— আজ একজন নতুন পড়শীর সাথে আলাপ হলো বুঝলে…
পিঙ্কি তাকালো, আরে ঐ কোনের বাড়িটা, ৬মাস আগে বিক্রি হলো না, ওটা একজন রির্টায়ার্ড ভদ্রলোক কিনেছেন, উনি একাই থাকেন, চোখের সমস্যা আছে, তবে একেবারে একা নন দুটি দুস্থ ছেলেকে নিজের সন্তানের মতো দেখেন তাদের সব খরচ দিয়ে পড়াচ্ছেন, ছেলে গুলিও খুব ভালো, একদিন যেতে বললেন ওর বাড়ি, যাবে?
বেশ তো যাবো একদিন।
কদিন আবার বৃষ্টি হচ্ছে ভোরে তাই আর মর্নিং ওয়াকে যাওয়া হয়না,… শনিবার পিঙ্কি র স্বামী বললেন চলো আজ বিকেলে মিঃ বিশ্বাসের বাড়ি যাই।
পিঙ্কি একটু চমকালো , কি নাম ওনার? অনুরেশ বিশ্বাস…
পিঙ্কি র মাথাটা যেন ঘুরে গেল। কিছু বললো না, বিকেলে গেল ওনার বাড়ি, ভদ্রলোক সাদর সম্ভাষণ করলেন।
পিঙ্কি একটা ঘোরের মধ্যে যেন। আরে এতো সেই… এতো দিন পরে, কিন্তু চোখে কেন কালো চশমা? এবার কথা প্রসংগে জানা গেল ওনার দুচোখে গ্লোকোমা, একটি চোখ ৩০বছর বয়সে নষ্ট হয়ে গেছে আর একটি ও প্রায় যাবার মতোই…
পিঙ্কি বিশেষ কথা বললো না, ওরা ফিরে এলো। পরদিন রবিবার, পিঙ্কি র বর রবিবার ভোরে ওয়াকে যান না, অতএব পিঙ্কি ই গেল, সারা রাত দু চোখে র পাতা এক করতে পারেনি, প্রথমেই পার্কে গিয়ে ঐ নিদৃষ্ট বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখলো
মিঃ বিশ্বাস বসে আছেন, ও কাছে যেতেই বললেন জানি আজ তোমার মনে অনেক প্রশ্ন, কেন আমি হঠাৎ হারিয়ে গেছিলাম, বলছি একে একে… এন্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল ইয়ারেই গ্লোকোমা ধরা পড়ে, তারপরে চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যাই ভাবলাম ওখানে ভালো ট্রিটমেন্ট করিয়ে সেরে যাবে, কিন্তু ওখানের ডাক্তার রাও বললেন না কিছু হবার নেই, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমার এ জীবনের সাথে তোমায় জড়াবোনা তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছিলাম। তোমার বাবা আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যখন গেছিলেন তখন আমি ছিলাম আমি ওনাকে সব বলে এও বলেছিলাম আমি এই ভাবে হারিয়ে না গেলে তুমি বিয়ে করবে না, আর তাই আমরা প্ল্যান করেই এটা করেছিলাম। আর এই কলকাতায় আসার সিদ্ধান্ত টা আমার ঐ দুই ছেলের পড়াশুনো জন্য, কিন্তু এটা ভাবিনি যে এভাবে আবার আমাদের দেখা হবে…
পিঙ্কি চুপ সব শুনে শুধু একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো, তুমি আকাশের পাখি তোমায় বাধবো এমন সাধ্য তো আমার নেই… আমি শুধু তোমার ডাক শুনে কাটাবো বাকি দিন কটা…
(কলমে—নীরা মিত্র)