মধুঝরা কন্ঠ —– ডঃ অশোকা রায়
মধুঝরা কন্ঠ.
ডঃ অশোকা রায়
আজ তিতলির জন্মদিন | পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পা দিল| তিতলির মা নীরার খুব ইচ্ছে হয়েছে তিতলির এই পাঁচ থেকে ছয়ে পা দেওয়ার দিনটা ধুমধাম করে সেলিব্রেট করে| আমাকে বলতে ইতস্ততঃ করেছে প্রথমে| কারণ আমাদের দশবছরের বিবাহিত জীবনে সে আমার রুচি-অ- রুচির ব্যাপারটা বুঝেছে | যেখানে তার আর আমার রুচির মধ্যে গরমিল, সেখানে সে আমার রুচি-অরুচিকে প্রাধান্য দিয়েছে| আমি হয়তো আত্মতৃপ্তি পেয়েছি, কিন্তু আমার অবিবাহিত বোন গর্জে উঠেছে, ” এ্যাই দাদা তুই কি রে! বৌদির নিজস্ব ইচ্ছে বা অনিচ্ছের কোন দাম দিস না কেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের চাওয়া – পাওয়া আর কতো নিষ্পেষিত হবে?” আমি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হেসেছি,” দুপাতা সমাজত্ত্ব পড়ে খুব লায়েক হয়েছিস তাই না? আটবছরের দাদার আচরণ শোধরাতে বসেছিস? তোদের সাবজেক্টে বিহেভিয়ারলিজম বলে একটা চ্যাপ্টার আছে তো? আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, ওটার ওপর লেকচারটা কাল তুই ক্লাসে মন দিয়ে শুনিসনি. সুগতর কথা ভাবছিলিস. ওরে এটা পুরুষতান্ত্রিকতার কোন ব্যাপার নয় | স্রেফ দাম্পত্য সমঝোতা |” সাড়ে আট বছরের বড়ো দাদার মুখে সুগতর নাম শুনে লজ্জায় বোন পালিয়ে বেঁচেছে| পিছন থেকে আমি বলেছি,” হ্যাঁ রে পাগলি, তোর বৌদি কি তোর কাছে কিছু অতৃপ্তির কথা বলেছে? ” বোন বলেছে না থেমে,” আমার বৌদি সেরকম মেয়ে নয় “| মনটা খারাপ হয়ে যায়|আত্মগ্লানির টুকরো মেঘের ছায়া মনে | মনে হয় সত্যি কি আমি নীরার ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাম দিই না? নিজেকে প্রশ্ন করেছি উত্তর পাই নি| রাতে নীরাকে প্রশ্ন করেছি| হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, ” বাদ দাও ঐ পাগলির কথা| আমাকে ভালোবাসে, তাই দাদার সাথে আমার হয়ে ওকালতি করেছে |” ” তুমি কিন্তু এখনও বললে না, আমার রুচি-অরুচি মেনে চলাটা তোমার কাছে অত্যাচার মনে হয় কি না?” ” তুমিও তোমার বোনের মতো একটা পাগল| বড্ড ঘুম পেয়েছে, একটু ঘুমোই এবার? তুমিও লক্ষী ছেলের মতো ঘুমোও.” নীরা ঘুমোবে কিনা, সে বিষয়ে আমার পারমিশন নিল| কিন্তু সরাসরি উত্তর দিল না, আমার রুচি-অরুচি কে কি সে নিজের ইচ্ছেতে প্রাধান্য দিচ্ছে, না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতি অনুযায়ী মেনে চলেছে| ঘুমটা সেদিন ঘোলাটে হয়েছিল, বেশ মনে আছে | সকাল হতেই আমি ভুলে গেছি রুচি-অরুচির কথা| নীরাকে বলেছি, বাজার থেকে ফিরে, “মাগুর মাছ এনেছি| আলু ফুল কপি দিয়ে পাতলা ট্যালটেলে ঝোল করো তো | তখন আমাদের বিয়ের তিন বছর| না জানার কথা নয় যে, নীরা মাগুর মাছ খায় না, বা ট্যালটেলে ঝোল পছন্দ করেনা | আমার অবশ্য মাগুর মাছের লাইট প্রিপারেশনেই রুচি| তবে অন্য অনেক তেলমশলাদার খাবার আমার খুব প্রিয়| শান্তা, আমার বোন খেতে বসে বলেছে, ” দাদা বৌদি তো মাগুর মাছ খায় না.” নীরা শান্তাকে বলেছে” ও কি কথা শান্তা? তোমরা অত ভালোবাসো মাগুর মাছ! আমার জন্য আসবে না, তা কি হয়?” আমি তখন বেসিনে হাত ধুচ্ছি লিক্যুইড লাইফ বয় দিয়ে | বুঝতে পারি আবার সেই রুচি-অরুচির সংঘাত| আবার নীরার নীরবে নিজস্বতা ত্যাগ| আমার মনে হয়, এজন্য নীরা আজকে আমাকে তাগাদা দিয়ে আগে খাইয়ে দিয়েছে| ছুটির দিনে আমরা সাধারণত একসাথে খাই|শবরী কি কাজ করছিল, ভাত ওর নীরা টেবিলে চাপা দিয়ে রেখেছিল| ঘরে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়াই| আমার ফ্ল্যাট-বাড়ির নীচে একটা নামকরা রেস্তোরাঁ | আজ রবিবার | আজকালকার ট্রেন্ড রবিবার ডাইনিং আউট| এক দম্পতি ঢুকছে রেস্তোরাঁয়| স্বামী স্ত্রীকে বলছে, ” সেদিন আমার মনের মতো অর্ডার দিয়েছো, আজ তোমার রুচি মাফিক|” জানলার ধার থেকে সেদিন সরে এসেছি এক বিবেকের ব্যাথা নিয়ে | তবু বোধহয় আমি এ ব্যাপারে এক থেকে গেছি| তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব কি অলক্ষ্যে আমার অবচেতনে কাজ করছে? কে বলে দেবে আমাকে? আমার বোন ছিল আমার বিবেক| সে তো এখন সুগতর সাথে আমেরিকার বাসিন্দা | কালেভদ্রে ফোন| বিবেকের ভূমিকা রহিত সে ফোন| আমেরিকান বিলাসবৈভব সংক্রান্ত তথ্য|
কলকাতার উন্নতি বা অবনতি নিয়ে আলোচনা – সমালোচনার সীমিত আলাপ| আন্তর্জাতিক কল না! তারপর তিতলি এসেছে| তিতলিকে নিয়ে আনন্দ আর ব্যস্ততার মাঝেও যে নীরা আমার রুচি – অরুচি নিয়ে খেয়াল রেখেছে, তা নিয়ে ভাববার সময় পাই নি| আর ভাববার মতো তো কিছু ঘটেনি নীরার দিক থেকে, কোন অসন্তোষ, কোন প্রতিবাদ,.. কোনদিন কিছু নয়|সুতরাং খামোখা ভাবতে যাবো কেন? আমি বিন্দাস আমার রুচি-অরুচি নীরার ওপর চাপিয়ে দিই| এতটুকু সংকোচ হয় না| আমার মনে হয় নীরা আর আমি কি আলাদা? মা চলে গেছে বাবার যাওয়ার আগে| নীরার সাথে এদের কারো দেখা হয় নি| সুতরাং আমার রুচি-অরুচির ব্যাপারটা নীরার হেফাজতে থাকা উচিত বলে আজকের আমি’ র মনে হয়| হয়তো এটা আমার আত্মপ্রবোধ, যার মোড়কে স্ত্রীর সাথে সুখী গৃহকোণের নীতিবোধ আমার পালন করা হচ্ছে বলে মনে হয়| মা বেঁচে থাকলে হয়তো মা আর স্ত্রীর মধ্যে আমার রুচি-অরুচির বিষয়টা ভাগ করে দেওয়া যেতো| তাহলে হয়তো আমার মধ্যে অপরাধ বোধ কাজ করতো না| তবে আজকাল এই অপরাধ বোধ তেমন জোরালো ভাবে কাজ করে না| ব্যাপারটা আমার মধ্যে নির্ঘাত ইমিউনড হয়ে গেছে| তার আমার মধ্যে থেকে ইমিগ্রেশনের চান্স কম|
যহোক প্রথম আরম্ভ করেছিলাম তিতলির পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছোটো খাটো ভোজের আয়োজন করেছি নীরার ইচ্ছে রাখতে, এই কথা জানিয়ে |নীরা যখন নিজের ইচ্ছেটা জানিয়েছে, এবার, তখনই আমি খুশি মনে সম্মত হয়েছি তিতলির জন্মদিন উপলক্ষে লোকজন নেমন্তন্ন করতে. কারণ নেপথ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যার কাছে সব মা বাবা সাধারণত সারেন্ডার করে|আমি ডাক্তার | সুতরাং টাকা পয়সা এখানে কোন ফ্যাক্টর নয়| ফ্যাক্টর আমার রুচি-অরুচি| আমি কোন অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী নই| একমাত্র বিয়ে আর শ্রাদ্ধ ছাড়া|এ দুটো অনুষ্ঠান শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান| আমার মনে হয়, জন্মদিন, বিবাহ-বার্ষিকী ঘটাপটা করে করার চেষ্টা সিম্পল বাতুলতা| নিজেদের মধ্যে করলে বেশি চার্মিং হয়| অন্তরের ছোঁয়া থাকে এ ভাবে পালনের মধ্যে| তবু আজ আমি রাজি হয়েছি, নীরার জন্য যত না, তিতলির জন্য তার থেকে বেশি| তিতলি কয়েক দিন আগে রাতে শোবার ঘরে আমার কোলে এসে বসে হঠাৎ. কচি হাতে আমার গলা জড়িয়ে বলে, বাপী, আমার সব বন্ধুদের বার্থডে হয়. প্লিজ এবার আমারটা করো|তখনো নীরা তার আর্জি পেশ করেনি| আমি অবাক হয়ে তিতলিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “কেন রে, হঠাৎ?” তিতলি শুধু বলেছিল,” আমার রুচি|” ছোট্ট একটা ধাক্কা মনে|রুচি!!! আত্মজার মধ্যে নিজের ছায়া দেখেছি|অসহায়ত্ব বোধ করেছি| আপত্তির অবকাশ আর কোথায়? তিতলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে | আমার কানে ফ্যান ঘোরার মৃদু আওয়াজ| বেশিরভাগ সময় এ. সি চলে| এটা হেমন্তের সন্ধ্যা|কলকাতার বাতাসে সামান্য ঠান্ডা ভাব| ফ্যানটার বোধহয় অয়েলিং প্রয়োজন|
নীরা রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত| মুসুর ডালে পেঁয়াজ ফোঁড়ন পড়লো| আমার কাছে ভীষণ রুচিকর| আজ পাঁচবছর পার হবো হবো তিতলি তার রূচির কথা জানিয়ে গেলো. আমার কেন ধাক্কা লাগলো? তবে এটা কি আমার কাছে টেকেন-ফর গ্র্যান্টেড যে, আমার মা, আমার বৌ, আমার মেয়ে সবসময় আমার রুচি-অরুচির খেয়াল রেখে যাবে? তিতলির কাছে আমার রুচি-অরুচির কোন দাম থাকবে বলে মনে হয় না| নীরা রেখেছে, আমার মা রাখতো, আর রেখেছিল আমার মনিমা| রক্তের সম্পর্ক নেই| স্নেহের বিনি সুতোর মালা|তাই বোধহয় তার কাছে আমার রুচি অরুচির কথা জানাতে আমার কোন সংকোচ হতো না| মনিমা আমার বন্ধু মন্টুর মা| তার কাছে মন্টু আর আমার কোন তফাৎ ছিল না| আমার বাবা ছোটোখাটো চাকরি করতেন| | সামান্য আয়ে চারজনের সংসার চালানো মুশকিল| অত বছর আগে এক বেসরকারি অফিসে কাজ করে বাবা কটাকাই বা ঘরে আনতেন| আমি লেখাপড়ায় ভালো|তাই স্কুলটা ফ্রি| বইপত্র, খাতা পেন হেডস্যারের কৃপায়| আর অনেকটাই মনিমার বদান্যতায়| মন্টুর বাবা মোহিত মেশোমশাই ব্যবসায়ী |আমাকে পছন্দ করেন| কিছু খাবার বাইরের থেকে আনলে, মনি মা বলেন, ” বিরিয়ানি এনেছো? রোহিত খুব পছন্দ করে| রোহিত আমি| ছুটির দিনের জলখাবার আসে হরি মোদকের দোকান থেকে| মনিমার কাজের লোক ফিরলে উৎকন্ঠা,” কিরে হরি আজ হিঙের কচুরী করেছে তো?রোহিতের বড়ো প্রিয় |” মনিমার কাছে আবদার আমার,” কাল পরোটা-আলুরদম, তো কোনদিন রূটি- চাপ|
মনিমা সযত্নে খাওয়ান আমায়| আমার রুচি- মাফিক কোন না কোন রান্না রোজ প্রস্তুত থাকে মনিমার রান্নাঘরে| জানলা দিয়ে হাঁক দেয় ,” মন্টু আয়|”
আমরা বড়ো হচ্ছি. মানে আমি আর মন্টু| আমার হায়ার সেকেন্ডারীর রেজাল্ট ভালো হবে বলে স্যারদের আশা| আর মন্টু বকুনি খায় পড়াশোনায় মনোযোগ না থাকার জন্য| কথায় কথায় স্যারেরা আমার উদাহরণ দেন| স্যারেদের অনুপস্থিতিতে আমি মন্টুর পিঠে হাত রাখতে যাই| একঝটকায় সে আমার হাত সরিয়ে দেয়| যত দিন যাচ্ছে, মন্টু কেমন যেন বিদঘুটে ব্যবহার শুরু করেছে আমার সাথে| কি রকম ইনডিফারেন্ট ভাব| আমি গেলে হয় ফোন করতে ব্যস্ত হয়, নয় কোন গেম নিয়ে মত্ত থাকে| আমার মন খারাপ হয়ে যায়| মনিমার আমার মুখে তুলে দেওয়া খাবারের গ্রাস কেমন যেন বিস্বাদ লাগে| মনিমার কথা কখনও ফেলিনি. তাই খেয়ে দেয়ে বাড়ি যাই|
সেদিন খুব বর্ষা| মন্টুর বাড়ির রান্না ঘর ঠিক আমার থাকার কুঠুরির পাশে| মন্টুদের বাড়িটাই তো আমাদের পাশের বাড়ি| মন্টুদের দোতলা বাড়ি আর বড়ো সড়ো| আমাদের একতলা আর জীর্ণ| মন্টুদের দোতলায় রান্না ঘরের জানালার গ্রীল গলিয়ে আসছে কষা মাংসের গন্ধ| গাওয়া ঘিয়ে পরোটা ভাজার গন্ধ পেয়েছি একটু আগে| আমি জানি মনিমা ওগুলো টাইট ঢাকনা দেয়া বড়ো টিফিন বক্সে পুরে রেখেছে| মনটা আমার পালিয়েছে, মন্টুর বাড়িতে| পরোটা আর কষা মাংসের লোভে| জানি মনিমা ডাকবে আমায়. সুন্দর বাস বেরিয়েছে| আমি ডাকের অপেক্ষায়|
বাড়িতে আজ রুটি-তরকারি| বাড়তি শুধু টম্যাটোর চাটনী|
ডাক আসে না| মনকে বোঝাই নিত্য মেম্বার কে রোজ ডাকার কি দরকার?আমি নিজের থেকে যেতে পারি না? চটিতে পা গলিয়ে সদর দরজা খুলি, আওয়াজ ওঠে ক্যাঁচ| মা জিজ্ঞেস করে, “কে? রোহিত নাকি? এই বৃষ্টির মধ্যে বেরোস না| ভিজে জ্বর হবে| বাদলার দিনে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়| ” মা আজকাল পয়সার অভাবে আমার রূচির কথা মনে থাকলেও ইচ্ছে করে ভুলে যায়| মনিমা মনে রাখে|
” মা, মন্টুর বাড়ি যাচ্ছি|ছাতা নিয়েছি| মন্টুর বাড়ির দরজায় নক করে ফেলেছি| মন্টুর গলা ভেতর থেকে পেয়েছি, “ঐ হ্যাংলা রোহিত এলো| বাপের মুরোদ নেই| বাড়িতে শুধু ঘ্যাঁট-চচ্চড়ি| এখানে গিলতে এলো বাবু|” কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছি, কতক্ষণ আর মিনিট কয়েক | নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি নি |আমি ফেরত আসার জন্যে পা বাড়িয়েছি|লোডশেডিং হয়ে গেল| কার হাত আমায় টেনে নেয় ভেতরে| স্পর্শে বুঝি, মনিমা| মোমবাতি কয়েকটা জ্বেলে আনে কাজের মেয়েটা| মন্টুকে গুল মারি, খেতে আসি নি রে কিছু| যোগেশ স্যার বলেছিলেন, তোকে অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দিতে, তাই এলাম| বাবা এনেছেন আজ আফগানী চাপ আর
মাটন বিরিয়ানি|মায়ের মাথা ধরেছে| বলল, ওষুধ খেয়েছে| কমে যাবে একটু পরে| উঠে গরম করবে| তাই ভাবলাম,খেতে বদেরি আছে, অঙ্কটা তোকে দেখিয়ে দিয়ে যাই| মন্টুর নির্বিকার বিদ্রুপ, “এত রাতে, এই বৃষ্টিতে!”
আমার মুখের ভিতর জিভময় জল আসে সেদিন বারবার| সুরুৎ শব্দে
ভিতরে টানতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ঠোঁটের কোণে খানিক| ভাগ্যিস কেউ দেখেনি| মুহূর্তে শার্টের হাতায় চালান হয়ে গিয়েছিল |
চোখ দুটো বেহায়া বড়ো| চলে যায় রান্নাঘরের দরজার দিকে |
মন্টুর মা ওপনার দিয়ে পেপসির বোতল খোলে| ফুলকাটা ডিশে পাটকরা পরোটা, কটা আমি গুনি না| কাঁচের বোলে
লাল ঝোলে চারটুকরো মাটন|
মন উচাটন| গন্ধে নাড়িভুঁড়িতে
লোভের মাতন|
মন্টুর মা বলে, অল্প বয়েস, খেয়ে নাও অল্প বিস্তর| বাড়িতে খেতে দেরি আছে তো |একে রুচিকর খাবার, তার ওপর মনিমার মধুঝরা কন্ঠে খেয়ে নেওয়ার অনুরোধ|
মিনিট দুয়েক মাত্র, প্লেট আমার সাফ|সবার ওপর দেড়দিন দিন জলে ভেজা চিঁড়ে খাওয়ার জিভ | তাই সব মিলিয়ে কন্ট্রোল করতে পারি নি নিজেকে|
জিভ লেহন করে বাটির ঝোলের অবশিষ্টাংশ|
মন্টুর মার হাতে আবার পরোটা চারখান| বড়ো হাতা ভর্তি মাংস|
স্নেহমাখা স্বর একখান আজো কানে বাজে, পেট ভরে খাও বাবা| কাল এসো| মন্টুর বাবা আনবে বিরিয়ানি| পেট পুরে খেয়ে যেয়ো| মন্টুর কথা ধরো না| ওতো অবুঝ আর বেয়াদপ| তুমি তো তা নও বাবা|” মন্টু উঠে গেছে ভেতরের ঘরে অনেক আগে| মনিমা যত্ন করে খাইয়েছে আমাকে| মনিমার কথা সেদিন মন্টুর অত অপমান সত্ত্বেও আমি ফেলতে পারি নি| অবশ্য তারপর আর মনিমার বাড়ি যাইনি| মনিমাও যেতে বলেনি| হয়তো ছেলের ব্যবহারে মর্মাহত তিনি| কয়েকমাস বাদে মন্টুদের বাড়ির সামনে একটা লরী এসে দাঁড়িয়েছে| মালপত্র বোঝাই করা হয়েছে| জানলা দিয়ে দেখেছি, মনিমা, মেশোমশাইকে মনে মনে প্রনাম করেছি| মন্টুর সামনে যেতে রুচিতে বেধেছে| সেই ছোট্ট বেলার থেকে রুচি শব্দটা আমাকে বড়ো জ্বালাতন করে| হয়তো ছোটবেলায় আমার ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সের ফল| কিন্তু আজ তো আমি সফল এক ডাক্তার| বাড়ি, গাড়ি, সুন্দরী স্ত্রী, ফুলের মতো মেয়ে, সমাজে সম্মান – প্রতিপত্তি.. সব আছে আমার| তবুও কেন আমি কারোর ইচ্ছে বা অনিচ্ছে বা রুচি-অরুচির প্রাধান্য দিতে শিখলাম না?
আজ পরিণত বয়সে এসেও প্রায়ই মনে পড়ে যায় মাসীমার মধুঝরা কন্ঠ |
আমাদের কমপ্লেক্সের সামনে একটা মাঠ. এই প্রথম তিতলির জন্মদিন উপলক্ষে অতিথি – অভ্যাগতদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা| লোকে এতদিন নানা কথা বলেছে পার্টি না দেয়ার জন্য|আজ আর কোন ত্রুটি নয়| সামিয়ানা বাঁধার লোকেদের পেছনে তদারকি করছিলাম| সঙ্গে আরো ছোটখাটো কাজের ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছিলাম| পেছন থেকে ভেসে আসা এক মধুঝরা কন্ঠস্বর.. ” বাবা, আমাদের একটা ফুলের দোকান রয়েছে| ফুটের দোকান বটে| তবে টাটকা ফুল নিয়ে আসে আমার স্বামী জগন্নাথ ঘাট থেকে | আজ একটা অর্ডার ছিল| বাতিল করলো| সবই কপাল|গেটের বাইরে আমাদের দোকান| শুনলাম আপনার মেয়ের জন্মদিন| ফুল দেব?” আমি রোহিত রায়, বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছি মধুঝরা কন্ঠের মালকিনের দিকে, বয়স চেহারায় থাবা বসিয়েছে, স্নেহপ্রবণ প্রকৃতিতে নয়| আজো সেই মধুঝরা কন্ঠ যেনো বলছে,
” পেট ভরে খাও বাবা| আর একহাতা মাংস দিই? ” আমার চোখে ভাসে হাফ প্যান্ট পরা এক ছেলে বলছে, “ও মনিমা কাল পায়েস করো তো. আমার বড্ড রুচি পায়েসে| ”
আমি মন্ত্রমুগ্ধ| বলেছি
” মনিমা, আমায় চিনতে পারছো না? আমি কলুটোলার রোহিত|” তারপর আর কি? সব ঘটনা ঘটেছে সিনেমাটিক কায়দায়| মনিমা বলেছে, মন্টু বড়ো লোকের মেয়ে কে বিয়ে করে দিল্লিতে| আমাদের কাছ থেকে মিথ্যে বলে সবটুকু জমা টাকা নিয়েছে, মায় বাড়ি পর্যন্ত|কি ভাবে জিজ্ঞেস করতে আমার সংকোচ হয়েছে | হয়তো
” স্নেহ বিষম বস্তু”ফর্মুলা কাজ করেছে |পড়াশোনা হলো না চেহারার জোরে বড়ো লোক শ্বশুরের কারখানার তদ্বির করে আর তার মেয়ের খিদমত খাটে| সেখানে কুকুরের কদর আছে, বরের মা – বাবার কদর নেই| মনিমার ফুলে তিতলি সেজেছে, নীরা সেজেছে| জন্মদিনের মন্ডপ সেজেছে| মনিমা আর মেশোমশাইকে রোহিত নিয়ে এসেছে নিজের রাজকীয় ফ্ল্যাটে| নীরা খুশি শ্বশুর – শ্বাশুড়ি পেয়ে| তিতলি দাদু-ঠাম্মির ন্যাওটা| সেদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমি বলেছি, ” আমার রেস্টের প্রয়োজন| রাতদিন পেশেন্ট, ওষুধ, ছুরি কাঁচি জাস্ট ডিসগাস্টিং| তোমরা চারজনে ট্যুরের প্ল্যান প্রোগ্রাম সারো| ফিনান্সের দিকটা আমি দেখব.” তিতলি চেঁচিয়ে ওঠে, ” থ্রি চিয়ার্স ফর বাবা. এই প্রথম নিজের রুচির কথা বলল না! ভেরি স্ট্রেঞ্জ! ” নীরা মুখ লুকিয়ে হাসে| তিতলির বক্তব্য, এবার দাদু-ঠাম্মির রূচি প্রাধান্য পাবে| না, না করলেও শেষ পর্যন্ত মোহিত মেশোমশাই আর মনিমা বলে ফেলেন কিন্তু কিন্তু করে, ” দার্জিলিং গেলে কি খুব অসুবিধা হবে? মন্টু বলেছিল নিয়ে যাবে|” নীরা ওদের দুঃখ বোঝে ,” কিসের অসুবিধা? আমরা দার্জিলিংই যাবো” |তিতলি বলে” টয়ট্রেন চাপবো তো বাবা”? আমার চোখে কিছু পড়ে নি তো? কেমন যেনো শিরশির করছে| নিজের রুচি-অরুচি অপরের কাছে সারেন্ডার করার কি আনন্দ বুঝতে পারছি| নীরা একটা ন্যাপকিন এগিয়ে দিয়ে বলেছে,” চুপিচুপি মুছে ফেলো| মেয়ে দেখলে বলবে এমা, বুড়ো ধাড়ি বাবা কাঁদছে| নীরার দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে থৈ থৈ আনন্দ.
****************************
“মধুঝরা কন্ঠ.”
ডঃ অশোকা রায়.
Block P, 846.
New Alipore. Kolkata 700053.
9831228223 /7044058223.