অঘটনঘটনপটিয়সী —– মীনা দে
অঘটনঘটনপটিয়সী
মীনা দে
আজ বইমেলার চতুর্থ দিন। অর্ণব খুব এক্সাইটেড,
আজ তার পঞ্চম কবিতার বই প্রকাশ হবার দিন। বিশিষ্টজনেরা সবাই মঞ্চে উপস্থিত। একটু পরেই এসে পড়বেন স্বনামধন্য কবি,সুবিমল সমাদ্দার। তিনিই মোড়ক উন্মোচন করবেন। আরও কিছু উঠতি লেখক, কবির বইয়েরও তিনি মোড়ক উন্মোচন করবেন।
অনুষ্ঠান শুরু হলো, একে একে সকলের বই পাঠকের হাতে পৌঁছে যাবার ছাড়পত্র পেলো। সব শেষে অর্নবের বই হাতে নিয়ে যখন মোড়ক উন্মোচন করতে যাবেন ঠিক তখনই হঠাৎ মেলা প্রাঙ্গণের অদূরেই শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি। বোঝাই গেল কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। দর্শকাশন প্রায় খালি হয়ে গেল। কোনোমতে অর্নবের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন পর্ব শেষ হতেই মঞ্চ খালি করে সকলেই তাড়াতাড়ি হাঁটা দিলেন কী ঘটেছে সেটা জানার উদ্দ্যেশ্যে। অর্ণবও প্রকাশকের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটা দিল। হাঁটতে হাঁটতে তারা সেই জায়গায় এসে পৌঁছে গেল যেখানে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। সেখানে এগিয়ে গিয়ে জানা গেল যে, কেউ এক বয়স্ক মানুষ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে মেলায় আসা প্রচূর মানুষ। অর্ণব কোন রকমে ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখলো একটি মেয়ে একজন বয়স্ক মানুষের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ মানুষটি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মেয়েটি মুখ নিচু করে রাখার জন্য মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। সেখানেে উপস্থিত সকলেই ভদ্রলোকের জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মেয়েটি মুখ তুলতেই অর্ণব অবাক। আরে! এ তো তার খুব চেনা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ তো ! এ তো ফেসবুকের সেই মেয়েটা। মনে হয় যেন অর্ণবের লেখার খুব বড়ো ফ্যান । অর্ণব নিজেকে একটু দূরেই রাখে ফেসবুকের বন্ধুদের কাছ থেকে। লেখালেখির জন্য যেটুকু রাখা প্রয়োজন ব্যাস তার বাইরে নয়। এই মেয়েটিকে একটু বেশিই চেনে কারণ তার লেখায় সব থেকে ভালো মন্তব্যটা পায় এই মেয়েটির মানে মিতার কাছ থেকেই। তার মনটা কেমন যেন অনেকটা আশা নিয়ে অপেক্ষা করে ,আজ মিতা কি লিখবে তার কমেন্টে সেটা দেখবার জন্য। অর্ণবও খুব ছোট করেই প্রতিমন্তব্য করে। ব্যাস ওই পর্যন্তই। কিন্তু আজ এই অবস্থায় মিতাকে দেখে অর্ণবের প্রাণটা কেমন যেন করে উঠলো সে এগিয়ে গেল আর মিতাও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল অর্ণবকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে। অর্ণবই প্রথম কথা শুরু করল—কী করে হলো এসব? মিতা ছল ছল চোখে যা বলল তা হলো, বই মেলায় প্রতি বছরের মতো এবারেও বাবার সাথে এসেছে সে। বাবা ভালো ভাবেই এই স্টল থেকে ওই স্টলে যাচ্ছিলেন বই দেখছিলেন । হঠাৎ কী যে হলো হাঁটতে হাঁটতেই বললেন আমার শরীরটা কেমন যেন করছে। বলতে বলতেই ঢলে পড়লেন মিতার গায়ের ওপর। মিতা টাল সামলে উঠতে উঠতেই তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। বলেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিল।
অর্ণবের মনটা কেমন যেন হয়ে গেল সে হঠাৎ বলেই ফেলল , চলুন আমার সাথে গাড়ি আছে, ওনাকে নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হবে। কয়েকজন মিলে ধরাধরি চরে মিতার বাবাকে গাড়িতে তুলে দিলো মিতাও উঠে বসল। গাড়ি সোজা গিয়ে থামল অর্ণবের চেনা নার্সিং হোমের গেটে।
প্রাথমিক যা কিছু করার সে সব করে ওনাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো। বাড়িতে মা একা রয়েছেন । সেটা ভেবে মিতা এতক্ষণ বাড়িতে ফোন করেনি। এইবার মাকে ফোন করে সব জানালো। অর্ণবও বাড়িতে জানিয়ে দিল তার ফিরতে একটু দেরি হবে। দুজনে এটা সেটা নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে দিল। দুজনে দুজনকে শুধূই ছবি দেখে চিনত। এখন দুজন দুজনের সম্পর্কে জানার সুযোগ পেল।
কথায় কথায় । বিয়েটিয়ের ব্যাপারে।
প্রায় দু ঘন্টা বসে থাকার পর ডাক্তার বাবু এসে খবর দিলেন যে পেসেন্টের জ্ঞান ফিরে এসেছে তারা দেখা করতে যেতে পারে। সবকিছু টেস্ট লিখে দিয়েছেন ডাক্তার বাবু আর আশ্বাস দিয়েছেন,টেস্টের পরই বলতে পারবেন কেন এমন হলো। যাইহোক তারা দূজনেই গেল দেখা করতে। মিতা তার বাবার সাথে অর্ণবের পরিচয় করিয়ে দিল। অর্ণব আর মিতা দুজনেই লক্ষ্য করল ভদ্রলোক বার বার অর্ণবের দিকে তাকাচ্ছেন আর কিছু একটা ভাবছেন । তারপর হঠাৎই জানতে চাইলেন তুমি কী বিকাশ বাবুর ছেলে? অর্ণব বেশ অবাক হয়ে বলল আপনি আমার বাবাকে চেনেন? আলবাৎ চিনি। আর তাঁর যে একটি পুত্র আছে তাও জানি। তোমার মুখের আদলই বলে দিলো তুমি বিকাশ বাবুর ছেলে। বিকাশ বেশ গর্ব ভরেই বলল হ্যাঁ সবাই তাই বলে আমাকে নাকি হুবহু আমার বাবার মতো দেখতে। মিতার বাবার সাথে বিকাশবাবুর পরিচয় প্রাতঃভ্রমনকে কেন্দ্র করে। দুজনেই একই পার্কে যান আর সেখান থেকেই পরিচয় । মিতার বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। অর্ণবই সব ব্যবস্থা করে দিল। রিপোর্টে জানা গেল সামান্য হার্টের সমস্যা রয়েছে। ওষুধপত্র সব ডাক্তার বাবু লিখে দিলেন।
দিনকয়েক পর একদিন অর্ণবের মা অর্ণবকে একটা ছবি দেখিয়ে জানতে চাইলেন তার পছন্দ কিনা । ছবিটা দেখেই অর্ণব বিষ্ময়ে হতবাক। এই ছবি তোমরা কোথায় পেলে ! এটাতো মিতার ছবি। অর্ণবের মা তখন মিটিমিটি হাসছেন আর বলছেন পছন্দ তো? তাহলে শোন তোর বাবা আর মিতার বাবার বছর খানেক হল
পরিচয় হয়েছে। ওনারা নিজেদের মধ্যে ইচ্ছা প্রকাশ করে ছিলেন ছেলে মেয়ে দুজনকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে বন্ধুত্বটা পাকাপোক্ত করে নেবেন। অবশ্যই দুজনের মনের কথা জেনে তারপর। কিন্তু তাঁরা তো জানতেন না পাত্র পাত্রী দুজনেই পরিচিত। মিতা সমস্ত ব্যাপার টা শুনে একটা কথাই বলল ওই অঘটনঘটনপটিয়শী তো ব্যাপার টা সোজা পথে সহজভাবেই ঘটাতে পারতেন এত ঘুরপথে যাবার কী দরকার ছিল তা তো বুঝলাম না।