নিপ্পনের দেশে (৪ কিস্তি) কলমে #শ্বেতা_ব্যানার্জী

নিপ্পনের দেশে (৪ কিস্তি)

কলমে #শ্বেতা_ব্যানার্জী

এক অজানা ভাষায় মন ছুঁয়ে যায়
তুমি তো নও আমার স্বদেশ
তবু ছুঁয়ে থাকে টুকরো স্পর্শ
যা আমার কাছে আবেগ।—-

সবারই একটা নিজস্ব ভাষা আছে, প্রকৃতিও তা’তে বাঁধা, তবে প্রকৃতির ভাষা বোঝে ক’জন।
জীবনের প্রথমবার তুষারপাত দেখে আমি বিস্ময়কর উত্তেজনায় কেঁপে ও কেঁদে উঠেছিলাম,
প্রথম কাঁপুনি দিয়ে জাপান আমায় স্বাগত জানিয়েছিল যেদিন এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম, যেহেতু জাপান ভূ-কম্পন প্রবল দেশ, তারপর আরও তিনদিন উনি ঝাঁকিয়ে -নাড়িয়ে বললেন আনাড়ি আমার দেশে এসে খাবার হজম হলো?

আজ আরও একবার, আমার প্রত্যেকটি অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সে, আমি বিহ্বল হয়ে তুষারপাত দেখছিলাম। এমন সময় ছেলে গরম কফি এনে বললো..
চলো সেলিব্রেট করি,তোমার কাছে এই পাওনা তো
নতুন। আমার মনের বয়স এক নিমিষে যেন তিরিশটা বছর কমে গেল, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে
আমার ছেলেমানুষী দেখে ছেলে, বৌমা হেসেই খুন..
তারপর বললো মা ভিতরে এসো-
এরা ব্যালকনিতে দাঁড়ানো বা কথা বলা পছন্দ করেনা। আমি বায়না ধরলাম রাস্তায় যাবো…।

বৌমা বললো চলো, তাড়াতাড়ি রেডি হও, আমরা আজ হানামি উৎসব দেখতে যাবো।এ কথা শুনিয়ে মন বলে উঠলো “ভ্রমরা বড়া নাদান হ্যাঁয়” কিন্তু বৃষ্টি!!
বৌমা বললো, ও এক্ষুনি ছুটি নেবে।।

#হানামি জাপানি ভাষায় যার মানে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করা।
পৃথিবী জুড়ে নানান উৎসবের নানান রঙ,যেমন আমাদের দুর্গোৎসব, কোনো কোনো দেশে কবিতা
উৎসব, তবে রঙের উৎসব আরও রঙিন হয় তা যদি হয় ফুল, মনের জয় ছুঁয়ে নিয়ে ভাসাবে বিলকুল।

#হানামি উৎসব জাপানের এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব।

প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিলে চেরি ফুল ফোটার সময়। অতি অল্প সময়ের জন্য এ ফুল ফোটে। এসময় পুরো জাপান ছেয়ে থাকে সাদা আর গোলাপি চেরি ফুলে। এ এক নৈসর্গিক দৃশ্য। চেরির এই সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য জাপানিরা চেরি গাছের নিচে সারাদিন বসে থাকে আর এই অনিন্দ্য সুন্দর ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করে।
চেরি ও আরও হরেকরকম ফুলের আসর, সে যেন এক মেলার খেলা গাছের ডালে ভুবনমোহিনী রূপ রূপকথার হয়ে।

প্রায় ১৩ শ বছর ধরে জাপানিরা এই ফুলটিকে নিয়ে #হানামিউৎসব পালন করে আসছে।

এই উৎসব উপভোগ করার জন্য এ সময় সারা জাপানে সরকারিভাবে সপ্তাহব্যাপী কর্মবিরতি পালিত হয়। সপ্তাহব্যাপী এই #সাকুরা বা #হানামিউৎসব যেন কর্মব্যস্ত জাপানিদের অবসর উদযাপন ও বিনোদনের একান্ত উপলক্ষ। কর্মব্যস্ত জাপানিরা এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পরিবার-বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকের আমেজে সময় কাটায়,নানাবিধ খাবার দাবার পানীয় নিয়ে এরা সারাদিন গাছতলায় শুয়ে-বসে থাকে।

আমি ফুলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বৌমাকে বললাম ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে আন।
আমি গাছেদের সাথে কথা বলে তাদের বাহারি বাহারের রহস্য জেনে তারপর যাবো।
আমার কর্তা বললো, তোমার ভিসার মেয়াদ বাড়াতে লাগবে না, এমনই তোমাকে ওরা এদেশি ভেবে রেখে দেবে। আমি যে কেন এলাম তোমায় নিয়ে–
বুড়ো বয়সে বউ খুইয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।

হ্যাঁ, আমাদের ধারণা জাপানিরা বুঝি চিনা-দের মতন। না, তা ঠিক নয়।
এরা মোটামুটি লম্বার দিকেই পুরুষ কিম্বা স্ত্রী উভয়ই। খুব ফ্যাশানেবল্, চুলের স্টাইল তাকিয়ে দেখার মতন। সাজপোশাকে খুবই উন্নতরুচির পরিচয়। নাক একদম চাপা নয়, আবার উন্নত নাসিকাও নয়।
মোটামুটি নাক, চোখ ধারালো না’হলেও চিনা দের
মতন নয়।
এখানে প্রতিটি মোড়েই পার্লার, আর দেখে মনে হবে কর্পোরেট কোম্পানির অফিস।
চুলের কাটিংএ সর্বনিম্ন দাম,পনেরো হাজার টাকা।
যা আমাদের দেশের অনেকক্ষেত্রেই এক মাসের সংসার খরচ।

যাইহোক সন্ধ্যায় দিকে আমরা ফেরার পথে টোকিও’র চারপাশ জুড়ে কি আর কি আছে
পা’য়ে হেঁটে দেখতে দেখতে আমি পার্কে গিয়ে ছেলেমানুষী করে ফেলছি, ভুলে যাচ্ছি এরা মাপা ছন্দে পা ফেলে হাঁটে, এদের পোষা বিড়ালরাও ম্যাঁও শব্দ করেনা। এত কুদোকুদো মোটাসোটা বিড়াল দেখেছি পার্কে, কিন্তু ওদের ম্যাঁও শুনিনি, নিজের ডাঁটে নিজেরা মশগুল।
পার্ক থেকে ঘুরে আমরা গেলাম নদী অসম্ভব সুন্দর সুরেলা ঢেউ তুলে সে বয়ে চলছে. … তার তিরতির ছন্দ মাতোয়ারা কবিতা জীবন্তিকা…।

ক্রমশ…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *