#গুপ্ত বিক্রম #কলমে: অর্ণব পাল
#গুপ্ত বিক্রম
#কলমে: অর্ণব পাল
#রাজ্যাভিষেক
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যভাগ। গুপ্ত শাসনাধীন ভারতবর্ষ। সদ্য সিংহাসনে আরোহণ করেছেন সম্রাট কুমারগুপ্তের সুযোগ্য পুত্র মহাপরক্রমশালী সম্রাট স্কন্দগুপ্ত। তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্য কে নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা করে ভারতবাসীকে শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করে বিধবা জননীর কাছে আশীর্বাদ নেবার জন্য অন্দরমহলের বাইরে অপেক্ষারত।
একজন রাজ অবরোধের খাস দাসী এসে খবর দিল, ” ভারত সম্রাট স্কন্দগুপ্তের জয় হোক! মাতা দেবকী পূজা সমাপ্ত করেছেন। আসতে আজ্ঞা হোক!” বহুদিন পর মাতা পুত্রের মিলন। পিতা সম্রাট কুমার গুপ্তের মৃত্যুর অব্যহিত পরেই নর্মদা উপত্যকার বর্বর পুষ্যমিত্র জাতি আক্রমণ করে গুপ্ত সাম্রাজ্য। দাহ কার্য্য ঠিক ভাবে সমাপণ না করেই প্রায় দুই মাসাধিক খাল স্কন্দগুপ্তকে দক্ষিণের স্কন্ধাবারে কাটাতে হয় যুদ্ধ হেতু। মাতা পুত্র শোক নিরূপণের নিভৃত সময়টুকু অবধি পাননি। দুজনের চোখই অশ্রু সজল! ধীর স্বরে সম্রাট বলে উঠলেন, ” মা! শত্রুর নিকেশ সম্পন্ন। গরুড় ধ্বজা আবার স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ক্ষমা করবেন আমায়, অমন সংকট মুহূর্তে আপনাকে আমি একা ফেলে রেখে গেলাম।”
অশ্রু মোচন করে মাতা উত্তর দিলেন, ” হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করা এবং পূর্বপুরুষের সম্মান ফেরানোর মত মহৎ কার্যে ব্রতী ছিলে পুত্র। ক্ষুদ্র আবেগের স্থান নেই সেখানে! একটাই খেদ, সম্রাট দেখে যেতে পারলেন না কিরকম অমিত বলশালী পুত্রের জনক তিনি! আশীর্বাদ করি পুত্র, ইতিহাস তোমায় মনে রাখুক অন্যতম শ্রেষ্ট ভারত সম্রাট হিসেবে!”
সম্রাট মাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুরু করলেন সাম্রাজ্য পরিচালনা। প্রথমেই অমাত্য পর্নদত্ত কে আদেশ করলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কৃত সুদর্শন সরোবর কে মেরামত করার। পানীয় জলের সমস্যা মিটবে তাতে। অর্থনীতি কে সচল করতে অতিরিক্ত খাদ মেশানো স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলন করলেন। আপাতত দৃষ্টি তে দেশে শান্তি ফিরে এলো। কিন্তূ এই আপাত সমৃদ্ধির আড়ালে আবডালে সাম্রাজ্যের মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি অস্পষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছিল। তার প্রধান কারণ জানতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
#হুন পরিচয়:
মধ্য এশিয়ার একটি অত্যন্ত বর্বর জাতি এই হুন। নৃশংসতা তাদের বর্ম। হুন শিশু জন্মানোর পরপরই তার মুখ আগুনে পোড়া লোহার শলাকা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হতো যাতে করে সে আজন্ম নিষ্ঠুর তৈরী হয়। নারীকে শুধূ যৌনতা এবং সন্তান প্রতিপালন করার যন্ত্র মনে করতো তারা এবং কার্য্য সমাধা হয়ে গেলে তাদের হত্যা করতে হুন দের হাত কাঁপত না। এমনকি হুন সৈন্য বৃদ্ধ হয়ে পড়লে তার কপালেও একই পরিণতি নাচতো। এর প্রধান কারণ, বৃদ্ধ ও নারী দুর্বল করে দেয়। সম্রাট কুমার গুপ্তের আমলেই হুন রা পশিম ভারত দখল করে নেয়। এরপর নৃশংস সম্রাট তোরমানের নেতৃত্বে হুন আক্রমণ করে মধ্য ভারতের গাঙ্গেয় অববাহিকা। কিন্তূ তারা জানত না যে সিংহাসনে আসীন ব্যাঘ্র পরাক্রমী সম্রাট স্কন্দ গুপ্ত!
#যুদ্ধ প্রস্তুতি
বৈশাখী গ্রীষ্মের রৌদ্রজ্জ্বল সকাল। গুপ্ত রাজ সভায় সদ্য কাজ শুরু হয়েছে। হঠাৎ দরবারের প্রধান প্রবেশ দ্বারের কাছে একটি কোলাহল সম্রাট স্কন্দ গুপ্ত কে সচকিত করে তুললো। তিনি আদেশ করলেন, ” দ্বারপাল! এই শান্তি বিঘ্ন কারি কোলাহলের হেতু অতি দ্রুত আমায় জানাও!”
দ্বারপাল অতি দ্রুত গিয়ে ত্রস্ত পেয়ে ফেরত এলো,” সম্রাট! খুব খারাপ সমাচার! ভগ্ন দূত খবর দেবার নিমিত্ত অপেক্ষারত!” সম্রাটের আজ্ঞা পেয়ে ভগ্ন দূত রক্তাক্ত অবসন্ন হয়ে দরবারে সম্রাট সমীপে উপস্থিত হয়ে বলে উঠলো, ” সম্রাট এর জয় হোক! সম্রাট হুন নৃপতি তোরমান গঙ্গা অববাহিকা আক্রমণ করেছে। আসে পাশের সমস্ত জনপদ বিনষ্ট হয়ে গেছে। এরকম পৈশাচিক মানুষ আগে কোনদিন দেখিনি। সুউচ্চ স্থান থেকে হাতি কে ছুঁড়ে ফেলে সৈন্য দের আদেশ করে নীচে খোলা তরবারী হাতে দাঁড়াতে। হাতির মরণ চিৎকার তার আমোদের উপকরণ! হেন ঘর নেই, যার নারী তার অঙ্ক শায়িনি হতে বাধ্য হয়নি। তার তাঁবুর চারিপাশ নগ্ন নারী দ্বারা বেষ্টিত এবং তাঁদের সাথে কি হচ্ছে–!!”
বজ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন সম্রাট, ” স্তব্ধ হও দূত! হে ঈশ্বর! আমাদের রাজকীয় সেনাবাহিনী করছিলো কি? ” উত্তরে দূত বললো, ” তারা বিনষ্ট সম্রাট! তাদের মৃতদেহ দিয়ে পাহাড় তৈরী করা হয়েছে এবং শেয়াল শকুনে ছিঁড়ে খাচ্ছে!”
ক্রোধান্বিত সম্রাট আদেশ করলেন, ” এর বিহিত না করে আমি আর রাজধানী ফিরবো না। মালবরাজ এবং অন্যান্য সামন্ত দের এক্ষুনি খবর পাঠানো হোক অতি শীঘ্র রাজধানী আসতে! অস্ত্র সরবরাহে কোনো বিঘ্ন যেনো না ঘটে। ভগবান বিষ্ণুর নামে শপথ নিচ্ছি হুন দের কে এই পুণ্যভূমি থেকে বিতরণ না করা অবধি রাজ পালঙ্কে শোবো না!”
#স্কন্ধাবার
মধ্যরাত্রি। আপন তাঁবু তে অস্থির চিত্তে পদচারণা করছেন সম্রাট। চারিদিকে বেষ্টন করে আছে সমস্ত সামন্ত গণ। সহসা গমগম করে উঠলো সম্রাটের গলা, ” সাথীগণ!
পূণ্য ভারত ভূমি আবার আক্রান্ত! এবার শত্রু, না শত্রু নয়, পিশাচ দ্বারা! ভীষণ ভয়ঙ্কর বিপদ! কিন্তূ ভুললে চলবে না, আমরা স্বয়ং শ্রী বিষ্ণুর সন্তান। আমাদের রাজকীয় নিশান ভগবান গরুড়! তাই আমরা দুর্বার, অজেয়। এই নর পিশাচ গুলিকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে পুন্যাত্মা ভারতভূমি এমন সহস্র পিশাচের বধ্যভূমি। মনে রাখতে হবে আমরা সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী। আমরা ভাগ্যবান যে এমন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে ভারত মা কে মুক্ত করার মহান দায়িত্ব ভগবান বিষ্ণু আমাদের দিয়েছেন। তার মর্যাদা রক্ষায় জীবন পণ সংগ্রাম করতে হবে।” তার পর যুদ্ধ ভূমি নমুনার দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ” পূণ্য তোয়া গঙ্গা মায়ের বক্ষে কোনো পাহাড় এর আড়াল নেই। তাই সম্মুখ সমরে ওদের পরাস্ত করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। কিন্তূ তাতে কি গুপ্ত বীর গণ পিছপা হবে?” সমস্বরে সমবেত সকলে হুংকার দিয়ে উঠলো, ” একদম না।” । যুদ্ধ ভেরী সিংহনাদ করে উঠে রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান করে দিলো।
ওইদিকে হুন শিবিরে তখন এক পৈশাচিক উল্লাস চলছে। হুন রাজ তোরমান একটি হাতির পেটে একটি একটি করে অগ্নি শলাকা প্রবেশ করাচ্ছে এবং তার মরণ আর্তনাদ শুনে আমোদিত হচ্ছে। সহসা এক দূত এসে স্কন্দগুপ্তের যুদ্ধ প্রস্তুতির বিবরণ দেওয়াতে তার ক্রুর চোখ জ্বলে উঠলো। সে বললো, ” হুন বীর গণ! যেমন ভাবে তোমরা এতদিন ধরে বিজিত জাতির নারীদের বক্ষ লগ্ন কাপড় একটানে খুলে দিয়ে এসেছ, এই ভারতের ও একই হাল করবে। তারপর গুপ্ত কূল রমণী গণ আমাদের খেলনায় রূপান্তরিত হবে এবং ভারত সম্পদ আমাদের শোভা বর্ধন করবে! ” এই বলে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো ।
#যুদ্ধ
গঙ্গা অববাহিকার এক বিস্তীর্ণ এলাকা। আজ এখানেই লেখা হবে ভারত ইতিহাসের এক শিহরণ জাগানো অধ্যায়। অস্ত্রে সুসজ্জিত রাজকীয় সেনাবাহিনী। নেতৃত্বে স্বয়ং সম্রাট স্কন্দ গুপ্ত। তিনি হাতির পিঠে হাওদায় আসীন। স্বর্ণ খচিত গরুড় ধ্বজা রোদে ঝকমক করছে। সমস্ত বীরদের মাথার শিরস্ত্রাণ রক্ত বর্ণের। আজ তাঁরা জীবন পণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছেন। শত্রু শোনিতে ধৌত হবে পূণ্য ভূমি ভারতবর্ষ! সম্রাট বলে উঠলেন, ” যুগে যুগে ভগবান বিষ্ণু অধর্মের নাশ করে পৃথিবীকে রক্ষা করে চলেছেন। আজ হুন দের শেষ করে আমরা ভারত ভূমি রক্ষা করবো। অভ্যুত্থানাম অধর্মস্য গ্লানির ভবতি ভারত!!! ” এরপর যুদ্ধ শঙ্খ বাজিয়ে দিলেন। সমুদ্রের স্রোতের মতো হুন সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো সম্রাট ও তাঁর সেনাবাহিনীর ওপর। কিন্তূ সমুদ্রের ঢেউ যেমন বলিষ্ট পর্বত গাত্রে বাধা প্রাপ্ত হয়ে পিছিয়ে যায়, সম বিক্রমে গুপ্ত সৈন্য দল প্রতিহত করে চললো হুন দের। তলোয়ারের ঝনঝনানি, তীরের শন শন শব্দ, হাতির বৃংহতি ও ঘোড়ার হৃেষা ধ্বনি তে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো। স্বয়ং সম্রাট স্কন্দ গুপ্ত ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করতে লাগলেন। সহসা একটি তীর তাঁর বাম হাতে বিঁধে গেল। তাতে যেন সম্রাট আহত বাঘের মতো হয়ে উঠলেন। তিনি এক লাফে হাতির পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়লেন এবং খোলা তলোয়ার হাতে হুন রাজ তোরমানের দিকে ছুটে চললেন। চারিদিক দিক থেকে হুন সৈন্য তাঁকে ঘিরে ধরলো। তিনি মত্ত হাতির মতো দাপাদাপি করে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিছুক্ষনেই সব ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেলো। তাঁর তরবারির প্রবল আঘাতে তোরমানের ঢাল দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। তোরমান একটা বড় প্রস্তর খন্ড সম্রাটের দিকে ছুঁড়ে মারলো। তার আঘাতে সম্রাটের মাথা ফেটে রক্ত পড়তে লাগলো। সম্রাট সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সামনে পড়ে থাকা একটি বর্শা তোরমানের দিকে ছুঁড়ে মারলেন যা তোরমানের ডান হাত ফুঁড়ে বেরিয়ে গেলো। তোরমান গতিক সুবিধের না দেখে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলো। অমনি যুদ্ধের গতি সম্পূর্ণ গুপ্ত অনুকূলে চলে এলো। এরপর হুন সৈন্য কে নিকেশ করতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। রচিত হলো ভারত ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। সম্রাট স্কন্দ গুপ্ত মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন এবং হাতির পিঠে উঠে সহস্তে রাজকীয় নিশান গরুড় ধ্বজা তুলে ধরলেন। বাকি সবাই আনন্দ কোলাহল করে উঠলো।
এইভাবে হুন আক্রমণ প্রতিহত করে ভারত ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন সম্রাট স্কন্দ গুপ্ত। তাঁর এই মহান বিজয় কে চিরস্মরণীয় করে রাখতে খ্রিস্টীয়সপ্তমশতকে লেখা হলো চন্দ্র ব্যাকরণ যাতে লেখা থাকলো অমর উক্তি, ” অজয়াদ গুপ্ত হুনান” অর্থাৎ গুপ্তরা জয় করেছিলেন হুন দের!!!
দুঃখের বিষয় আমরা এই বীর গাথা মনে রাখিনি। তার ফল পরবর্তী সময়ে হুন দের ভারত বিজয় ও আরো পরে ব্রিটিশ অধীনতা!