#গল্প_বিসমিল্লা —– তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

#গল্প_বিসমিল্লা
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

ঝমঝম করে ঝড় তুলে
চলে যায় রেলগাড়ি
কে জানে কোন অজানা পথে
দেয় যে রোজ পাড়ি??
আমিও যদি পারতাম যেতে
রেলগাড়িটার সাথে
দুঃখ সুখের পোঁটলা পুঁটলি
নিতাম বেঁধে কাঁধে

দূর থেকে আরো দূরে মিলিয়ে যাওয়া রেলগাড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের কথা ভাবে কলাবতী। ইঞ্জিন থেকে বগি একের পর এক ছুটে ছুটে চলে পরপর। তারপর শেষ হয়ে যায়। আনন্দ শব্দ ঝড়ের রেশও মিলিয়ে যায়। আবার ছুটে আসে দুরন্ত গতিতে দূরপাল্লার রেলগাড়ি। শব্দ ঝড় তুলে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যায়, স্থির হয় না। কিন্তু তার জীবনের আনন্দ ঝড়ের মতো হলেও স্থিরই ছিল….

একই রকম শব্দ ঝড় ছিল তার জীবনেও। আনন্দের খনক, উবলানো দুধের মতো ভালোবাসার ঝলক…. কখনও রিনরিনে চুড়ির মতো আবার কখনও ঐ রেলগাড়ির আওয়াজের মতো….. উথাল পাথাল অথচ স্থির ভালোবাসা ভরা….

আগের কথা…

ঝুপড়ি জীবনের স্বপ্নগুলো ভীষণ রকম রঙিন ছিল এক সময়। হাতের কাঁচের চূড়ির মতোই খনখনাতো। রিক্সা চালক নবীনের বৌ হয়ে বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে একেবারে শহর কলকাতায় চলে আসে কলাবতী। সব তেওহারে না হলেও ছট পুজোতে দেশের বাড়ি যাবার আনন্দ ই ছিল আলাদা। কত কি পাওয়া যায় এই শহরে… আগে কখনও দ্যাখেইনি সে। স্বামীর রোজগার থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আর নিজেও তিন বাড়ি ঘরের কাজ ধরে টাকা জমিয়ে সবার জন্য জরি চুমকি দেওয়া জামাকাপড় আর রঙবেরঙের কাঁচের চূড়ি ব্যাগ বোঝাই করে নিয়ে যেত।বাবা মা ভাই বোন সবার মুখ গুলো হাসিতে ঝকঝক করতো আর সেই খুশি ছোঁয়াচে রোগের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতো কলাবতীর মন শরীর। এক গলা সোহাগে ডুবে যেত সবটুকু আনন্দ নিয়ে নবীনের বুকে।

এরপর ফিরে আসা দক্ষিণেশ্বর লাগোয়া রেললাইনের পাশে ঝুপড়ি তে। তার নিজের স্বর্গে। গায়ে গায়ে লাগা বাঁশ কঞ্চির ঝুপড়ি। তাই শরীর ভোগের শীৎকার বা মদ গিলে মরদের হাতে বেধড়ক মার, সব আওয়াজ সব ঘরেই পৌঁছে যেত। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না কারও। যে যার কাজ নিপুণ ভাবে করে যেত রাতের গভীরে।

প্রেম ভালোবাসা ভরা সংসার
সুখের স্বর্গ হাসে
সাতমহলার ক্রন্দন নেই
ঝোপড়া কঞ্চি বাঁশে

নবীন আর কলাবতীর ভালোবাসার সংসারে এক এক করে নতুন অতিথির আবির্ভাবে ভাঙা ঝোপড়ায় থাকা, খাওয়া সবেতেই টান পড়ে। খিদের জ্বালায়, বাচ্চাদের কান্নায়, টান কমে নবীনের শরীর ভালোবাসায়। রিক্সার আয় সংসার সামলানো দায়। আকণ্ঠ মদ গিলে ঘরে এসে বাচ্চাদের মারধোর আর কিছু বলতে গেলে বৌকেও মেরে ক্লান্ত নবীন ঘুমিয়ে পড়তো।

ফুরফুরে দিন এখন গড়াতেই চায় না। বাচ্চা গুলোর কথা ভেবে কয়েক বাড়ি কাজ নেয় কলাবতী। যাহোক তাহোক আবার চলতে শুরু করলো সংসার মেল ট্রেন না হলেও মালগাড়ির মতোই ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে। নবীনের নেশা করা বেড়ে গেল। বেড়ে গেল ঘরে এসে অশান্তির পরিমাণ।মা’কে বেদম মার খেতে দেখে বাচ্চা গুলো ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতো। কেঁদে ফেললে বা মা’ কে বাবার মারের হাত থেকে বাঁচতে গেলে, মার জুটতো ওদেরও। তাই সবাই চুপ করে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখতো। প্রতিকার হীন, প্রতিবাদ হীন।

রেললাইনের পাশে ঝোপড়ার ঘরের কিস্সা নিয়ে চলছিল দিন।

এর মাঝেই নবীন একদিন বেরিয়ে আর ফিরলো না ঝোপড়ার সংসারে। থানা পুলিশ ক্লাবের ছেলে পার্টির দাদা, সবাই কে হাতে পায়ে ধরে কলাবতী। কোথাও টাকা আবার কেউ বিনিময়ে চায় কলাবতীর ডাগর শরীর। রিক্সা ওয়ালা নবীনের বৌ ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে ছুটে যায় সেই রিক্সা স্ট্যান্ডে যেখানে আরও অনেকের সাথে নবীনও অপেক্ষা করতো সওয়ারীর। সব শুনে সবাই চেষ্টা করে অনেক কষ্টে রিক্সা টা উদ্ধার করে।
কিন্তু কি করবে কলাবতী?? রিক্সা চালক না থাকলে মালিক রিক্সা নিয়ে নেবে। কিভাবে সংসার চলবে ক’টা বাড়ি কাজের টাকায়?? এত বড় শহরে সে একা…. কিভাবে যাবে দেশ??

এইসব ভাবনার মাঝে উদয় হয় রিক্সা স্ট্যান্ডের নবীনের বন্ধু ইলিয়াস। ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় সে। কলাবতীর একার লড়াই দেখতে দেখতে কখন যে সে শক্ত করে তার হাতটা ধরে ফেলেছে….. সেও বিহারের। নবীন আর কলাবতীর ভাঙা সংসারের গল্প তার অজানা নয়। নবীনের রিক্সা এবং সংসারের ভার অলিখিত চুক্তি তে তুলে নেয় সে। আর এই প্রান্তিক মানুষদের জীবনে ধরা বাঁধা, নিয়ম থাকে না। থাকে না বাধা নিষেধের বেড়াজাল। থাকে না সমাজপতির চোখ রাঙানি বা পন্ডিত মৌলবীর নিদান… বিধান।

এ শহর।
এখানে যে যার নিজের।
আপন হলেও পর।

থাকতে শুরু করে সে কলাবতীর ভাঙা ঘরে… রেললাইন ধারে। পূর্ণ করে বন্ধুর শূন্য স্থান সানন্দে।

এখনকার কথা..

ধীরে ধীরে নয় খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসে আগের মতোই সেই ঝমঝম আওয়াজ করা ভালোবাসা। রাতের শীৎকার। রিনিক ঝিনিক কাঁচের চূড়ির ঝনক। বগবগ ফোটা ভাতের সাথে উবলানো দুধ প্রেম। হারিয়ে যাওয়া দিন ফিরে পেয়ে কলাবতী আগের সেই নতুন বৌ। মাঝের কষ্টের দিন গুলো ভুলে যেতে চায় সে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই ফজরের নমাজে ঘুম ভাঙে কলাবতীর। আশেপাশের ঝোপড়া ঘরের সবার, ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে।

মুছে যায় ধর্মের ব্যারিয়ার
ভালোবাসা সব কিছু কে ছাপিয়ে,
নেই চোখ রাঙানো পাহারাদার
গরিবী দেয় সবকিছু কে দাবিয়ে।

মিলে যায় শরীর, মেলে মন
নেই চেঁচামেচি, হৈ হল্লা
মিলেছে বন্ধু, সুজন, স্বজন
শুভ সূচনায়, বিসমিল্লা।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *