গল্প— মধুসূদন কলমে– #শ্বেতা_ব্যানার্জী
গল্প— মধুসূদন
কলমে– #শ্বেতা_ব্যানার্জী
লক্ষ্মী, ও লক্ষ্মী. হাঁক দিয়ে ঘরে ঢোকে পাড়ার মেজ খুড়িমা। তোর ঘরে নাকি নতুন বৌ এয়েছে!!!
তা- বলি, তুলে আনলেই বৌ হয় না কি!!
হ্যাঁ লা, বাপের ঘরের ঠিক ঠিকানা নেই,শুনলুম।কোথা থেকে না কোথা থেকে মেয়েমানুষ এনে ঘরে পুরলেই, সে ঘরের বৌ হয়ে যায়!!
আমাদের সমাজ -সংসার কি বিসর্জন দিলি!!
না..খূড়ি…মা….। থাম,তোতলাতে হবেনা।
ঘোলাটে আকাশ, ঝুঁকে পরা জীবনে অশেষ কে পেয়ে, ঊর্মিলা জীবনের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল।
সুন্দরবনে গোসাবায় বাড়ি ঊর্মিলার, ছোট থেকে জল থেকে মীন ছেঁচেই চলে তাদের সংসার।
আজ জলের তলায় তাদের বাড়িঘর, মাথার উপর খোলা আকাশ নিয়ে বেঁচে থাকা। শ’য়ে শ’য়ে মেয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে –কাজের লোভ দেখিয়ে।
বাঁচার তাগিদ নিয়ে ঊর্মিলার দৌড় পাড়াতুতো দাদার সংগে।দাদার উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। ঊর্মিলার জীবনে ঘোলাটে আকাশে এক ঝলক রোদ্দুর হয়ে অশেষের আবির্ভাব।
অশেষ একজন সমাজসংস্কারক। এক এন জি ওর হয়ে ছোটখাটো ক্যাম্পেইন করছে।
মাইকে তার ভাষণ শোনা যাচ্ছে….দৌরাত্ম্য আর নৃশংসতা কোমলতা কে নিংড়ে নিচ্ছে…
সমাজের হাতে আক্রান্ত কুঁড়ি থেকে শেষ পাপড়ি মেলা ফুল, নির্লজ্জ সংকীর্ণতা সমাজ ও সভ্যতার
দখল নিতে সীমা অতিক্রম করে আবহাওয়া কলুষিত করছে…।
আজ অনেকক্ষণ ক্যাম্পেইন করে, টায়ার্ড ছিল অশেষ। পিচ ঢালা রাস্তায়,তাঁবুর বাইরে এসে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে…আপন মনে ভাবে।
সত্যিই কি সমাজ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে!!
নারী কী সত্যিই কোনদিন সুরক্ষা পাবে!! অসহায় মেয়েগুলোর মুখ, তাকে ভাবিয়ে তোলে।
কোনদিন কী তাদের বাড়ীর লোকেরা তাদের মেনে নিয়ে…সমাজ-সংসারে ফিরিয়ে নেবে!!
সমাজ কী !!সমাজ কেন!!
সমাজ কী মানুষের কল্যাণ কামনায় নয়!!
না কী সংকীর্ণ স্বার্থ কে চরিতার্থ করাই উদ্দেশ্য।
যেখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ অস্বীকৃত। মননের জাগরণ শুধুই টাকা দিয়ে মাপা!! সহমর্মিতা এই কথাটি আজ বড়ই উপেক্ষিত—-
হঠাৎ ভাবনায় টান —, দেখে পায়ের কাছে
একটি মেয়ে,উপুড় হয়ে কাঁদছে আর বলছে দাদা বাঁচান, দাদা বাঁচান।
শিউরে উঠা জীবন তাকে কি ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল…সেই কাহিনী শোনাতে গিয়ে সে বার বার কেঁপে উঠছিল। অহেতুক লজ্জা ঢাকতে সে যেভাবে বেআব্রু হয়ে যাচ্ছিল…সেই ঘটনা অকপট
অশেষ কে বলে যাচ্ছিল এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে….
অশেষ অভয়দাতা হয়ে তার পাশে দাঁড়ায়।
তার সহকর্মীরাও একে-একে বেরিয়ে এসে ঘটনার
সম্মুখীন হয়। অশেষ তাদের বলে…এক কঠিন বাস্তবের মুখ আমরা। সংস্কৃতি-কৃষ্টির ধ্বজাধারী হয়েও.. আমরা প্রত্যাশী দৃষ্টিভঙ্গী মেলে ধরতে পারিনি, তাই এত কিন্তু বোধ!!
সবাই বলে কি ভাবছো অশেষ দা।
এই বোন কে আমরা কোথায় রাখবো!!
কেন!! আমাদের এন জি ও তে কিছুদিন রেখে।
কোন হোমে রাখার চেষ্টা করবো।
যেখানে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ও পৃথিবী চিনতে শিখবে।
হঠাৎ হইচই এ ওদের কথার ছেদ পরে।দেখে এক
দঙ্গল মারমুখী ছেলে ওদের দিকে তেরে আসছে….
মেয়েটি ভয় পেয়ে তাঁবুতে ঢোকে।
ছেলেগুলো এসে সোজাসুজি বলে, ওকে বের করে দে–।কোথায় রেখেছিস?
ক্যাম্পেইন না ছাই, …. যত ফুর্তিবাজের দল, সকালে ক্যাম্পেইন আর রাতে সেই গলির মেয়ে নিয়ে ফুর্তি।
অশেষ কিছু বোঝাতে যায় ওদের, ওরা বলে,
আরে থাম, থাম,বুকনি বাজি রাখ, মেয়েটা’কে
তুলে দে… নাহ’লে সব কটাকে পুঁতে রেখে দেবো
এই গলির মধ্যে, কুত্তারা শুঁকেও বের করতে পারবেনা লাশ। অশেষ বলে, সম্মান দিতে শেখো মহিলাদের।
চুপ বে….
যা বলছি শোন, নাহ’লে দুটো দানাই যথেষ্ট।
এই ঝন্টু বের করতো, সম্মান কা’কে বলে বুঝিয়ে দি।
অশেষ দু’হাত দিয়ে তাঁবুর দরজা আগলে দাঁড়ায়।
প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি শুরু হয়…..ধস্তবিধ্বস্ত অবস্থায়
অশেষ মাটিতে লুটিয়ে পরে।কিন্তু হাল ছাড়েনা।
গুন্ডার দল মেয়ে টাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে….
অশেষ দৌড়ে এসে বলে, ওকে তোমরা নিয়ে যেতে পারোনা। ও আমার বাগদত্তা।
আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, আজ যখন ফিরে পেয়েছি, বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যাবো–
অশেষের অহেতুক মিথ্যে বলাতে বন্ধুরা হকচকিয়ে যায়। মেয়েটি সপ্রশ্ন দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে!!
ভিজে যাওয়া জীবনে লজ্জাটুকু ঢাকতে এক আধারের কত প্রয়োজন, ভাবে ঊর্মিলা।
টাটকা ফুল, আঁচল দিয়ে মোছা আয়না, শতছিন্ন শতরঞ্চি । আতরের গন্ধ, ছেঁড়া ব্লাউজ,
ঊর্মিলার চোখে জল…..।
অশেষ বলে, “আত্মদীপ ভবঃ”
ট্রেন ছুটছে হুইসেল দিয়ে… রাতের বুক বিদীর্ণ করে…ঊর্মিলার জীবন ফেলে যাচ্ছে একটি একটি করে ষ্টেশন. ছেঁড়া শরীর আজ ঢেকে যাচ্ছে মোম জ্যোৎস্নার আলো তে….
ঊর্মিলা অশেষের বাড়ির লোকজনের ব্যবহারে আপ্লুত হয়, ভাবে মানুষ নামে জীব এখনো আছে,আর আছে বলেই পৃথিবী শুকিয়ে যাইনি—
কিন্তু তার ভাবনায় ছেদ পড়ে – — যখন পাড়ার মেজখুড়ি, তার জীবনে অভিশাপ ডেকে আনে– পাড়ার লোকজন জড়ো করে পরিচয় হীন মেয়েকে পাড়া ছাড়া করতে পাড়ার ক্লাবের শরণাপন্ন হয়।
ফেলে আসা অতীত যখন হেঁটে ফিরে আসে—
তখন শামুকের আর খোলে ঢোকা হয়না,বেআব্রু জীবন আরও বেআব্রু হয়ে ফিরে যায় অতীতে —।