।।চন্দন সিংহ।। কলমে: অর্ণব পাল

।।চন্দন সিংহ।।
কলমে: অর্ণব পাল

হলদিঘাটির যুদ্ধের অব্যহিত পরের এক অপরাহ্ন। আরাবল্লির পাদদেশে একটি প্রস্তরাকীর্ণ প্রান্তর। ইতিউতি লম্বা ঘাসের ঝোপ। বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল ঘাস ঝোপের ঘনত্ব। ভিতরে কিছু রাজপুত যোদ্ধা বসে। তাঁদের শরীর দেখে সহজেই অনুধাবন করা যায় তাঁরা প্রত্যেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আরেকটু কাছে গেলে দেখা যাবে তাঁদের পিছনে অর্ধ শায়িত মেবার নরেশ মহারাণা প্রতাপ সিংহ। ক্লান্ত অবসন্ন দৃষ্টি তাঁর।
আলোচনা চলছিল রাণা পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে। প্রতাপ বলে উঠলেন , ” হে বীর যোদ্ধা গণ!! আজ আমরা নিজ গৃহে পরবাসী। তোমরাই বলো কোথায় রাখবো পরিবার কে। মুঘলরা আমাদের হিংস্র শ্বাপদের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে।” এমন সময় চন্দাবত বীর তেজ সিংহ বলে উঠলেন, ” মহারাণা! দেবী সিংহের দুর্গ নিকটেই। কিন্তু দেবী সিংহ সেখানে নেই। তিনি পশ্চিম সীমান্তে মুঘলদের এখনো ঠেকিয়ে রেখেছেন। অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে দুর্গ রক্ষা করছেন তাঁর চোদ্দ বছরের নাবালক পুত্র চন্দন সিংহ। সেইখানে এক রাত্রিরের আশ্রয় পাওয়া সম্ভব। ” প্রতাপ সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন।
দুর্গে পৌঁছে তেজ সিংহ খবর দিলেন দুর্গাধিপ কে। বালক চন্দন অভিবাদন করে দ্রুত সপরিবার মহারাণা কে ভিতরে নিয়ে গেলেন। সকলে চলে গেলে একান্তে তেজ সিংহ চন্দন সিংহ কে বললেন, ” হে দুর্গাধিপতি! রাঠোর বীর দেবী সিংহের সুযোগ্য পুত্র আপনি। আজ আবার মাতৃভূমির রাঠোর রক্ত প্রয়োজন। আজ রাতেই রাণা পরিবার কে নিয়ে আমরা রওনা দেবো। ঝালোর দুর্গে পৌঁছতে আমাদের ভোর হয়ে যাবে। তাই এই পুরো দিন আপনাকে আশি সহস্র মুঘল সৈনিক কে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। প্রাণ দিতে রাজপুত পিছপা হয় না। কিন্তু আপনাকে প্রাণ ত্যাগ করলে চলবে না। আপনাকে সূর্যোদয় পর্যন্ত জীবিত থেকে যুদ্ধ করে মুঘল দের প্রতিহত করতেই হবে। মনে রাখবেন, মেবার স্বাধীনতা সূর্য আপনার শৌর্যের উপর নির্ভরশীল। ”
স্মিত হাসিতে চন্দন সিংহ জবাব দিলেন,” চন্দাবত বীর তেজ সিংহ আপনি। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্বরূপ আমার। আপনার বীরত্বের কাহিনী আজ সমগ্র রাজপুতানার আলোচ্য বিষয়। এমন বীরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি আমার পিতা রাঠোর বীর দেবী সিংহের নামে শপথ নিলাম রাণা পরিবার নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো অবধি মুঘলদের সামনে আরাবল্লির ন্যায় দন্ডায়মান থাকবো। ”
এই বলে চন্দন সিংহ থামলেন। তেজ সিংহের অশ্রু আর বাধা মানলো না। তিনি জানেন যে কর্তব্য তিনি এই বালক টিকে দিলেন তার পরিণাম নিশ্চিত মৃত্যু। মনে মনে বললেন,” হে দেশমাতৃকা! আর এরকম কত বীর যে তোমায় রক্ষা করতে প্রাণ দেবে! ” চন্দন তেজ সিংহকে প্রণাম করে দ্রুত প্রস্থান করলেন। তেজ সিংহ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সেই চপল অথচ দৃঢ় পদক্ষেপ দেখতে লাগলেন।
অনতিবিলম্বে সবাই বেরিয়ে গেলে চন্দন তাঁর পাঁচ শত রাজপুত বীর কে ডেকে বললেন, ” বন্ধুগণ! আজ মেবার স্বাধীনতা সূর্য রক্ষার দ্বায়িত্ব আবার রাঠোরদের। সমগ্র ভারত দেখবে রাজপুত তার স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষা করে। প্রত্যেক বীর দশ জন মুঘল কে বধ না করে যেনো নিজেকে রাজপুত মনে না করে। তিনশত বীর আমার সঙ্গে যুদ্ধে যাবেন। বাকি দুইশত বীর দূর্গ রক্ষার দ্বায়ীত্বে থাকবেন। ” সমবেত রাজপুত বীর গণ সমস্বরে সিংহ নিনাদ করে উঠলেন,” জয় একলিংগজি !” ।
চন্দন তাঁর মাতার আশীর্বাদ নিতে অন্দরে গেলে তাঁর মা তাঁকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে বললেন, ” যাও পুত্র! মুঘলদের পরিচয় করাও রাঠোর তরবারির সঙ্গে! ” চন্দন বললেন, ” মা, প্রাণ দিতে বা নিতে আমি ভয় পাই না। ভয় শুধু তোমাদের নিয়ে। ” মা বলে উঠলেন, ” পুত্র, রাজপুত রমণীরা তাঁদের পুরুষদের মতোই বীর। উপায়ান্তর না থাকলে জহর ব্রত পালন করবেন তাঁরা। তবু যবন সম্মুখে মর্যাদা বিসর্জন দেবেন না। ” আকাশ বাতাস মুখরিত হলো মাতা পুত্রের হর্ষ ধ্বনিতে , ” জয় একলিংগজি!!”
চন্দন সিংহ রাতের অন্ধকার কে আশ্রয় করে গিরিখাতের প্রত্যেক বাঁকে পঞ্চাশ জন করে যোদ্ধা মোতায়েন করলেন এবং নিজে অশ্বের পিঠে সম্মুখে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
রাত্রি দ্বিপ্রহর। মুঘল সিপাহসালার মামুদ খাঁ তার সৈন্যদের সারিবদ্ধ ভাবে নিয়ে গিরিখাতে প্রবেশ করলেন। তাচ্ছিল্য ভাবে পার্শ্ববর্তী সৈনিককে বলে উঠলেন, ” রাজপুত গুলো আচ্ছা আহাম্মক। বাদশাহ আকবরের শরণে গেলে শরাব, শবাব কিছুরই কমতি হতো না। তা না করে এই বানজার মরুভূমির জন্য প্রাণ দিয়ে চলেছে। মরবে তবু পালাবে না। বেহুদ্দ কাফের ! ” আচমকা আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হলো চন্দন সিংহের বজ্রগম্ভীর কণ্ঠের চিৎকারে, ” জয় মহারাণা প্রতাপের জয়! জয় একলিংগজি! আক্রমণ!!”
সহসা মুঘলরা উপলব্ধি করলো ইঁদুর যেমন যাঁতাকলে আটকে পড়ে তারা তেমনি গিরিখাতে আটকে পড়েছে। অন্ধকারে শত্রু অদৃশ্য, পিছনে খাদ। সামনে এগোনোর পথ নেই। তারা তরবারির আঘাতে, তিরের ঘায়ে এবং প্রস্তরাঘাতে প্রাণ ত্যাগ করতে লাগলো। অল্পকাল পরে তারা ধাতস্থ হয়ে পাল্টা আক্রমণে গেল। মাঝে মাঝে এক পক্ষ চিৎকার করে ” আল্লাহু আকবর” তো আরেপক্ষ চিৎকার করে ” জয় একলিংগজি !!” উষা লগ্নে দেখা গেলো বিংশতি সহস্র মুঘল মৃত ও আড়াইশত রাজপুত শহীদ হয়েছেন। চন্দন চিৎকার করে বলে উঠলেন, ” সাথীরা! চলো দুর্গে ফিরে যাই। আমাদের কার্য সম্পন্ন। আর যুদ্ধে লাভ নাই। ” সবাই দ্রুত অশ্বের পিঠে প্রস্থান করলেন । দুর্গে পৌঁছে চন্দন আদেশ করলেন দুর্গ দ্বার খুলে দিতে। দ্বার খোলা হলে সবাই ভিতরে প্রবেশ করলেন, চন্দন ছাড়া। তিনি বললেন, ” দরজা বন্ধ কর!” সবাই জিজ্ঞেস করল , ” কিন্তু আপনি ? ” চন্দন বললেন, ” আগে তোমরা নিরাপদ হও। ” দুর্গের দরজা বন্ধ হলে চন্দন অশ্ব সমেত এক লাফ দিয়ে দূর্গ প্রাচীর অতিক্রম করে দুর্গে প্রবেশ করলেন।
অন্দরে গিয়ে চন্দন মাকে বললেন, ” মা! কার্য সম্পন্ন। আমরা এবার সাকার জন্য প্রস্তুত!” মা তাঁর ললাট চুম্বন করে বললেন, ” ধন্য পুত্র! ধন্য রাঠোর তরবারি! আমরা এবার জহর এর জন্য প্রস্তুত। ”
বাইরে অপেক্ষা রত মুঘল সৈন্য দেখলো আগুনের লেলিহান শিখা। জানলো না তারা দূর্গ স্থিত সকল রাজপুত রমণী আত্ম মর্যাদা রক্ষার্থে সেই লেলিহান শিখায় আত্মবলিদান করলেন। সকল পুরুষরা এরপর স্নান করে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হলেন। জীবনে তাঁদের আর কিছুই নেই। মা, বোন, পত্নী সবাই ছেড়ে চলে গেছেন। তাই তাঁরাও একে অপরকে আলিঙ্গন করে সাকা র জন্য প্রস্তুত হলেন। সকলের পরনে রক্তবর্ণ বস্ত্র, রক্ত বর্ণ শিরোস্ত্রাণ।
মুঘলরা দেখলো দূর্গের দ্বার খুলে গেলো। তারা বুঝলো আরেকটি কঠিন সংগ্রাম অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। সাদা বিদ্যুতের ন্যায় অল্প সংখ্যক রাজপুত ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই মুঘল সমুদ্রের বুকে। সেই রাজপুত সংখ্যাও দ্রুত নিঃশেষ হলো, কিন্তু রেখে গেলো বীরত্বের এক অমরগাথা।
মামুদ খাঁ দেখলো চন্দন সিংহ অন্তিমকালেও তরবারি হাতছাড়া করেননি। সে সশ্রদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো, ” হে রাজপুত বীর! ধন্য তুমি! আর ধন্য রাজপুতানা! যে দেশে তোমার মত বীর জন্মায় সে কোনোদিন পদানত হবে না। বৃথা বাদশাহের চেষ্টা।
আল্লাহ! আমারও যেন এমনি এক পুত্র সন্তান হয়! “। এই বলে সে তার অশ্রু মোচন করলো।
চন্দন সিংহের মতো এমন কত সহস্র বীর আছেন যাঁরা যুগে যুগে ভারতের বুকে এমন অসামান্য বীরত্বের সাক্ষ্য রেখে গেছেন। এই অপটু লেখার মাধ্যমে তাঁদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কাহিনী শেষ করলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *