দ্বি-ধারা —- সফিক আহমেদ
“দ্বি-ধারা
সফিক আহমেদ
-১-
পাখির ডাকে ঘুমটা ভেঙে যায়। তাও যদি আসল পাখি হতো, এ তার বরের আদিখ্যেতা করে কিনে আনা কলিং বেল। অসময়ে বেজে উঠলে মনে হয় কাকের ডাকের থেকেও বেসুরো। রবিবারের সকালে একটু যে গড়িমসি করে উঠবে তার ও জো নেই। রাজধানী এক্সপ্রেস, দুরন্ত এক্সপ্রেস যদিও দু দশ মিনিট লেট করবে, লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল হচ্ছে সময়ানুবর্তিতার মিশাল। ঠিক সকাল পৌনে ছটায় এনে পৌঁছে দেবে তাদের জীবনের লাইফলাইন মিনতি মাসিকে।
ঘরে ঢুকেই ঝাড়ু হাতে মাসি নেমে পরে স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পায়ানে। কর্কশ হাতের এক এক টানে সরিয়ে দেয় ছাত থেকে মেঝে পর্যন্ত ঝুলে থাকা বাহারি পর্দা গুলো যারা সযত্নে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে রাতের অন্ধকারকে। পুবমুখো জানলা পেরিয়ে আছড়ে পড়া আলো এক মুহূর্তে খান খান করে দেয় আলো আধারির রোমান্টিকতা।
মাসি দক্ষ হাতে ঝাড়পোছ করতে করতে রান্নাঘর, ড্রয়ইং রুম, গেস্ট রুম পেরিয়ে এগোতে থাকে বেডরুমের দিকে। রঞ্জনা হাহা করে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘খবরদার, দাদাবাবু কাল উইকএন্ডের পার্টি করে এসেছে গভীররাতে। এখন বিরক্ত করলে আর রক্ষে নেই।’
অসম্পূর্ণ সাফাই অভিযান ছেড়ে যেতে যেতে মাসির বিরস মুখে যেন স্বগতোক্তি শোনা যায়
‘সব মরদগুলোই এক, আমার রেনুর বাপের খোয়ারি ভাঙতে ও এক বেলা কেটে যায়’
সকালের ঘুমভাঙার তিক্ততা কেটে যায় যখন মিনাতিমাসির করে দেয়া গরম ধোয়া ওঠা চায়ে চুমুক দেয় আর হালকা আওয়াজে শুনতে থাকে তার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে তোমায় পাইনি
বাহিরপানে চোখ মেলেছি
আমার হৃদয়পানে চাইনি——”
ঝড়ের বেগে যাবতীয় কাজ সেরে ১০টার মধ্যে বেরিয়ে যায় মিনতি মাসি। আরো চার বাড়ির কাজ সেরে সন্ধ্যা ৬টায় আবার আসবে সেকেন্ড শিফটে।
বেলা বাড়তে রজত উঠেই শুরু করে উথলে পড়া প্রেমের আদিক্ষেতা। এখনো রাতের অনিয়মের রেশ যায়নি তবুও আদুরে গলায় আবদার, ‘আজ ক্লাব এ ব্রাঞ্চ। সেজেগুজে তৈরি হও। জেনারেল ম্যানেজার নায়ার আর তার পার্সোনাল সেক্রেটারি সুজান এসেছে শহরে। ওদের এন্টারটেইন করতে হবে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও হালকা হলুদ শাড়ি, হস্ত শিল্প মেলা থেকে কেনা একটা পোড়া মাটির নেকলেস
আর ম্যাচিং দুল পরে হালকা প্রসাধন করে বেরিয়ে পড়লো গল্ফ ক্লাব এর উদ্দেশ্যে।
সারাটা দিন ভালোই কাটলো। হালকা শীতে রোদে পিঠ দিয়ে, মখমলের মতো সবুজ গালিচার গল্ফ কোর্স এর দিকে তাকিয়ে’ হরেক রকমের প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য খাবার সহযোগে জিন এন্ড টনিক এ চুমুক দিতে দিতে আর Mr নায়ারের বাঙালিমহিলা প্রীতি আর স্তুতি শুনতে শুনতে।
এদিকে রজত মশগুল অফুরন্ত বিয়ার সহযোগে এংলো ইন্ডিয়ান সেক্রেটারি Goan সুজান কে কলকাতার ক্লাব culture আর নাইট লাইফ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করতে। নতুন শহর এ বদলি হয়ে আসা সুজান এর যাবতীয় সুবিধা অসুবিধা দেখভাল করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে উদগ্রীব রজত।
Mr নায়ার এর থেকে অব্যাহতি নিয়ে কোনোরকমে রজতকে টেনে নিয়ে উঠতে উঠতে শীতের ছোট দিন শেষ । পড়ন্ত বিকেলের আলোতেও অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো গল্ফ কোর্সের চোখ জুড়ানো সবুজকে ।
বাড়িতে মিনতি মাসি অপেক্ষা করছিলো বন্ধ দরজার সামনে। মুখের ভাষার কোনো আগল নেই। কাউকে রেয়াত করেনা কিন্তু অদ্ভুত সময়ানুবর্তিতা আর দক্ষতা এই মিনতি মাসির। আগামী ২ ঘন্টায়, বিকেলের জল খাবার, রাত্রের খাবার আর সকালের ব্রেকফাস্ট এর জোগাড় করে বেরিয়ে যাবে ৮ টার লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ধরতে । রঞ্জনা গত জন্মের কোনো সুকর্মের ফল হিসাবে পেয়েছে এই মাসিকে। দুজনের কর্মব্যস্ত জীবনের ভারসাম্য ধরে রেখেছে এই মিনতি মাসি।
সন্ধেটা সোফায় বসে রিয়ালিটি শো দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিয়ে আর্লি ডিনার করে গোছগাছ শুরু।
কাল সকাল ৮টায় বেরোতে হবে। নতুন প্রজেক্টের প্রেসেন্টেশন সকাল ৯টায়। রজত তখন ও ল্যাপটপ নিয়ে ড্রয়িং রুম এ রাত জেগে ওর সেলস রিপোর্ট তৈরি করতে ব্যস্ত। কাল Mr নায়ার কে ইমপ্রেস করতে হবে পরের প্রোমোশনের জন্য।
বেডরুম এ হালকা নীল আলোটা জ্বালিয়ে চাদর ঢেকে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে রবিবার শেষ রঞ্জনার।
*********(ক্রমশ)******
সফিক আহমেদ
হিউস্টন, টেক্সাস , ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা