তীর্থের পথে পথে — অম্বিকা কালনা – দ্বিতীয় পর্ব — কোয়েলী ঘোষ
তীর্থের পথে পথে
অম্বিকা কালনা – দ্বিতীয় পর্ব
কোয়েলী ঘোষ
অম্বিকা কালনার ১০৮ শিব মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে চলে এসেছি একেবারে উল্টোদিকে কালনা রাজবাড়ি ।
বড় ফটক , দুদিকে কাঠের ভারী পাল্লা , পেরিয়ে বিশাল রাজবাড়ি চত্বর সুন্দর সাজানো । চওড়া রাস্তার দুদিকে ফুলের কেয়ারী । শীতের গাঁদা ফুলের সমারোহ ।
বাঁদিকে একটি কামান পেরিয়ে , চোখে পড়ল টেরাকোটার কারুকার্য মন্ডিত এক মন্দির ।
এটি প্রতাপেশবর দেউল মন্দির । ১৭৭১ শকাব্দ বা ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে রাজ মহিষী প্যারীকুমারী দেবী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । সিঁড়ি দিয়ে উঠে গর্ভগৃহে দর্শন করলাম কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ । নিত্য পুজো হয় বোঝা গেল ।
মন্দিরটি ঘুরে দেখি অপূর্ব পোড়ামাটির কাজ । রাম সীতার অভিষেক , সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা , রাধা কৃষ্ণ , কালী , কীর্তনদলসহ গৌর , নিতাই ইত্যাদি অনবদ্য কারুকার্য মুগ্ধ করল । শিল্পী ছিলেন বাঁকুড়ার সোনামুখী র রামহরি মিশ্র । এটি উড়িষ্যার শিল্পরীতির পরিবর্তিত রূপ , দৃষ্টিনন্দন ।
এই মন্দিরের পিছনে লক্ষ্মী বাড়ি । এই মন্দিরটি প্রায় ধ্বংস হতে চলেছে । একটিতে গণপতি মূর্তি আর একটিতে পিতলের লক্ষ্মী দেবী আর একটিতে শিব পার্বতী ।
সামনে এগিয়ে যাই । বাঁদিকে ছাদ বিহীন রাস মঞ্চ । এবার একটু এগিয়ে লালজি মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলাম ।
কালনায় এটি বহু প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত পঁচিশ চূড়া মন্দির । সারা বাংলায় যে ছটি পঁচিশ চূড়ার মন্দির আছে তার মধ্যে এই মন্দিরটি শ্রেষ্ঠ বলে অনেকে মনে করেন ।
১৭৪০ অব্দে বর্ধমানের জমিদার কীর্তিচন্দ্রের জননী ব্রজকিশোরী দেবীর প্রতিষ্ঠিত এই লালজি মন্দির । তিনি তাঁর রাধিকা মূর্তির সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে পাওয়া শ্রীকৃষ্ণের ।সেই থেকে নিত্য পূজিত হয় শ্যাম রাই বিগ্রহ ।
চত্বরের প্রবেশ পথের ওপরে আছে নহবতখানা । বাঁদিকে গিরি গোবর্ধন মন্দির । ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে কালো শ্লেট পাথর দিয়ে তৈরি এই অভিনব স্থাপত্য । । প্রাচীন ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের মত একটি ঝুলন্ত পাহাড় দেখে বিস্মিত হতে হয় ।
লালজী মন্দিরের সামনে চারচালা নাটমন্দিরে সুন্দর আলপনা দেওয়া আছে । এখানে রামায়ণ আর শ্রীকৃষ্ণ লীলার অপূর্ব পোড়ামাটির অলংকরণ দেখে মুগ্ধ হলাম । ভেতরে লালজিকে প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে এলাম ।
বাইরে পর পর পাঁচটি শিব মন্দির ।
এবার দর্শন করলাম বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আরো একটি পঁচিশ চূড়ার মন্দির কৃষ্ণচন্দ্রজীর মন্দির । ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের মাতা লক্ষ্মী কুমারী দেবী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । এই মন্দিরটি স্থাপত্য আর অলঙ্করণে শ্রেষ্ঠ । টেরাকোটার মন্দিরটি তিনতলা । ভেতরে দারু নির্মিত রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ দর্শন করে মনে এলো বিদ্যাপতির পদ ।
“”আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুৃঁ
পেখলুঁ পিয়া মুখ চন্দা ।
জীবনযৌবন সফল করি মানলুঁ,
দশদিশ ভেল নিরদন্দা ।।
আজু মঝু গেহ গেহ করি মানলুঁ
আজু মঝু দেহ ভেল দেহা ।
আজু বিহি মোহে অনুকূল হোয়ল
টুটলু সবহুঁ সন্দেহা । “”
কবি বিদ্যাপতি
মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্যে আছে কল্পলতা বা মৃত্যুলতা । অশ্বমেধযজ্ঞ , বকাসুর বধ , নৌকা বিলাস , মহিষাসুরমর্দিনী , রাধাকৃষ্ণ মূর্তি আর ফুলকারি নকশা আছে দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে ।
মন্দিরের বিগ্রহ প্রতিদিন পূজিত হন মাখন , মিছরি আর ভোগ নিবেদনে ।
মন্দির সংলগ্ন আর একটি মন্দিরে রাম সীতা বিগ্রহ ।
এই মন্দিরের পূর্বদিকে আছে বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির । ভিতরে পূজিত শিবলিঙ্গ ।
এই কৃষ্ণচন্দ্রজির মন্দিরের প্রাঙ্গণে বিশাল এক বৃক্ষ , তিনটি বৃক্ষ মিশে আছে একসাথে । সেখানে বসে সামনের টেরাকোটার মন্দিরের অপরূপ শিল্প দেখতে দেখতে মনে হয় শিল্পীর শিল্প নৈপুণ্যের কথা , আমাদের গর্বের ঐতিহ্যের এই শহর স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যায় না ।
এবার উঠতে হলো । আমাদের টোটো রাজবাড়ীর বাইরে অপেক্ষায় ছিল । আবার টোটো চলতে শুরু করল । আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মহাপ্রভু বাড়ি ।
বেজে ওঠে নূপুর ধ্বনি
বেজে ওঠে বাঁশির সুর ,
অনুভূতির অতল স্তরে ।
পোড়া মাটির ফলকে ফলকে
মূর্ত ইতিহাস …
এই প্রাচীন মন্দির প্রাঙ্গণে
প্রতি পলকপাতে দেখার স্বাদ ।
টেরাকোটার রঙে এঁকে নিই দুচোখ
নম্র এক আলো ছড়িয়ে পড়ে
আঁধারের কোনে কোনে ।
চলবে